ব্লগটির উৎস "পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে কতটা জরুরী? " এই পোষ্টটা কে কেন্দ্র করে। পারমানবিক শক্তি অবশ্যই এখন প্রয়োজনীয় কিন্তু অনেকেই এই প্রযুক্তিটিকে সন্দেহের চোখে দেখেন। পোষ্টে ব্লগার "দিনমজুর " ও আরোও কিছু সহব্লগারদের পারমানবিক বিদ্যুৎ সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছি।
দিনমজুরপ্রশ্নঃ ১। অন্য দেশসমূহের অভিজ্ঞতা কি? নিউক্লিয়ার এ্যাকসিডেন্ট কি কমেছে? উন্নত বিশ্বেই যেখানে দুর্ঘটনা মুক্ত নয়- সেখানে আমরা কতখানি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি? পরিবেশের উপর প্রভাব বিবেচনায়- জার্মানী কিন্তু এরই মধ্যেই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কমানো শুরু করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এখন নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট না বাড়িয়ে অন্য সেক্টরগুলোর মাধ্যমে পাওয়ারের চাহিদা মেটানোয় আগ্রহী।
=> উত্তরঃ => ধনী দেশ গুলোর উদাহরন সম্পর্কে বলার আর কিছুই নেই। কারন ওরা নিজেদের আখের অনেক আগেই গুছিয়ে নিয়েছে। তাই জার্মানী ও অন্যন্য ধনি দেশগুলোর উদাহরন বাংলাদেশের জন্য কতখানি প্রযোজ্য হবে সেটি ভেবে দেখার বিষয়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাংলাদেশের শুধু নয় সমস্ত বিশ্বের সমস্যা, কিন্তু এতে বাংলাদেশের কন্ট্রিবিউশান দশমিকের পরে তিন-চারটা শুণ্য দিলে যা হবে % তত ভাগও নয়। এযেন পরের পাপে নিজের শাস্তি।। তাই বাংলাদেশ তার দেশের উন্নতির জন্য যদি একটু পরিবেশ দুষন করে, তবে সেটা বৈশ্বিক ভাবে ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না, কারন যা ক্ষতি করার যুক্তরাষ্ট্র করে এখন সে অরন্যের রোদনে দরিদ্র দেশগুলোকে আমেরিকার মধু পিয়াসী বিশ্বব্যঙ্ক ও আই.এম.এফ-দের দিয়ে পরিবেশ সচেতন করানোর মহান তালিমে নেমেছেন, কিন্তু নিজেই কিওটো প্রটোকল মানছে না। মানুষ হিসেবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য এ বিপর্যয়ের হাত থেকে বিশ্বকে উদ্ধার করা, কিন্তু বাংলাদেশী হিসেবে আমি মনে করি, পরিবেশের সর্বনিম্ন ক্ষতি করে হলেও আমাদের উন্নয়নের পথ ধরা উচিত। এ কেবল-ই আমার ব্যক্তিগত মতামত।
দিনমজুরপ্রশ্নঃ ২। হাই কস্টিং সামাল দিব কি করে? এই নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি রপ্তানী বাণিজ্যের পাশাপাশি চলা ঋণ বাণিজ্যটাও চলে হরদম। ব্রাজিল সহ আরো কয়েকটি দেশের উদাহরণ এখানে দেখা যেতে পারে- ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা থাকলো।
উত্তরঃ => হাই কস্টিং? বেশ ডিবেটেবল ইস্যু। আসলে আমরা অনেকটা না জেনেই পারমানবিক শক্তির বিরোধিতা করি, টেকনিক্যাল ব্যাপার গুলো না বুঝে এর বিরোধিতা করা শুরু করি আমরা, যা অনুচিত। মার্কিন একটি বিশেষজ্ঞ দলের সমীক্ষার ফলাফল তুলে দিচ্ছি, এটা নিয়ে আরো কথা লিখবার ইচ্ছে ছিল, আপাতত সময়ের অভাবে তা দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত।
কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ পড়ে প্রায় ০.৬ থেকে ১.৬ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসে খরচ পড়ে প্রায় ০.০৭ থেকে ১.১ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় এবং জ্বালানী তৈল থেকে ১.২ সেন্ট।
এবার নবায়ন যোগ্য শক্তির প্রসঙ্গে আসা যাক, সৌর শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ প্রায় ৫০ থেকে ৮০ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায় আর বায়ু শক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ প্রায় ৫.৫ থেকে ১৩ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায়, কিন্তু আমাদের দেশের একমাত্র কিছু উপকূলীয় এবং দ্বীপাঞ্চল ছাড়া বায়ু শক্তি কাজে লাগানোটা দুস্কর, তার ওপর এই উপকূলে ঝড়-ঝঞ্ঝার পরিমান বেশী হবার দরূন সব উপকূলীয় এলাকায় এগুলো স্থাপন করাটাও কতটুকু সমীচীন সেটা বিবেচনায় আনাটা জরুরী। কিন্তু নিউক্লীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন খরচ বেশ কম, আর তা মাত্র ০.২৫ থেকে ০.৬ সেন্ট প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টায়।
প্রজেক্ট রিপোর্টটি এখানে গিয়ে দেখতে পারেন।
নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ যেখানে স্ট্যাবল আছে বহু বছর হল, গ্যাস আর তেলের দাম বাড়ছেই। তার ওপর আছে ফসিল ফুয়েল পোড়ানোর জন্য পরিবেশ বিপর্যয় আর গ্রিন হাউজ গ্যাসের প্রকোপ।
দিনমজুর প্রশ্নঃ ৩। বর্জ্য আসলেই একটা বিশাল সমস্যা- আমরা এটা কোথায় পাঠাবো? কি করবো? বর্জ্য পরিশোধনের প্রতিষ্ঠান গুলোর ব্যাপারে আপনার কাছে আরো কিছু শুনতে পারলে ভালো হতো- তারা কি করে- কিভাবে পরিশোধন করে- কোথায় ফেলে- চার্জ কেমন.. ইত্যাদি। ভবিষ্যতে কিছু বলার আগ্রহ থাকলো।
উত্তরঃ => বর্জ্যের ব্যাপারে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তদারক করে। আর বলা বাহুল্য তারা আফ্রিকায় এগুলো ডাম্পিং করে। হ্যাঁ শুনে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি। পৃথিবীর সব জাতিই উঠেছে আরেকজনকে ব্যাবহার করে। আজ পিরামিড দেখে আমরা বিমূর্ত আনন্দ লাভ করি, কিন্তু সেগুলো কিন্তু আরেক জাতির রক্ত ঝড়ানো ইতিহাসের প্রতিবিম্ব। চায়নার দিকে তাকিয়ে দেখুন। তারা নিজেদের সমাজতান্ত্রিক বললেও আফ্রিকাকে নগ্নভাবে ব্যবহার করছে নিজেদের প্রয়োজনে। আমাদেরও ইউরোপিয়ানরা ব্যবহার করেছে ২০০ বছর, এখন আমাদের এর শোধ দেয়ার পালা, এর জন্য কঠোর কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতে হলেও তা নেয়া উচিৎ।
কথা প্রসঙ্গে বলা উচিৎ, দক্ষিন কোরিয়া এখন নিউক্লিয়ার ফুয়েল রিসাইকেল করে পুণঃ জ্বালানী তৈরীর কাজ হাতে নিয়েছে । তাই বর্জ্য খুব কম উৎপন্ন হয়।
দিনমজুর প্রশ্নঃ ৪। আমাদের মত জনবহুল দেশে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট বসানোর মত লোকেশন আদৌ আছে কি? এর সামান্য একটা একসিডেন্টের ফলাফল কি হতে পারে?
উত্তরঃ => লোকেশন একটা বিশাল সমস্যা, এটা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু তাই বলে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে উন্ন্যাসিক হওয়াটাও ভালো চিহ্ন নয় বিলক্ষণ। এমন স্থান নির্বাচিত করা উচিৎ যেখানে জনসংখ্যা আপেক্ষাকৃত কম। দুর্ঘটনা ও ব্যাবস্থাপনার ব্যপারে পরে আলোচনা করছি।
এখানে দেখুন, ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ক্যাজুয়ালিটির হার দেয়া আছে, যেখানে স্পশটতই দেখা যাচ্ছে নিউক্লিয়ার টেকনোলজি কতটা নিরাপদ। আর এখন তো আরও ২ যুগ পরে দুর্ঘটনার কথা চিন্তাও করা যায় না।
দিনমজুর প্রশ্নঃ ৫। প্ল্যান্টের অর্থায়ন, প্ল্যান্ট বসানো ও মেইনটেইনেন্সের টেকনিক্যল এক্সপার্টিজ এবং জ্বালানি- তিনটার কোনটারই আমাদের হাতে নেই- মানে আমরা পুরোটাই বাইরের প্রভু রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল। ফলাফল কি?
উত্তরঃ =>" প্ল্যান্টের অর্থায়ন, প্ল্যান্ট বসানো ও মেইনটেইনেন্সের টেকনিক্যল এক্সপার্টিজ এবং জ্বালানি- তিনটার কোনটারই আমাদের হাতে নেই- মানে আমরা পুরোটাই বাইরের প্রভু রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল।"
আচ্ছা, গ্যাস প্ল্যান্ট যেগুলো আমাদের দেশে আছে, এগুলো কি আমাদের দেশের অর্থায়নে বা ডিজাইনে তৈরী? সবগুলোই আপনার কথিত প্রভূ রাষ্ট্রের কারিগরী সহায়তায় তৈরী। এপর্যন্ত জ্বালানীর অভাবে কোন রিয়েক্টর শাট-ডাউন হয়েছে বলে শুনেছেন (ইরানের কথা বাদ দেন, ওইটা ভিন্ন কেইস) আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ইউরেনিয়াম এর গ্রেড আর উইপন্স গ্রেড এক না, এইটা সবাই জানে। আর আই.এ.ই.এ-র কাছ থেকে জ্বালানী শর্ত সাপাক্ষে নেয়া যাবে, এমনকি পারমানবিক বর্জ্য ডাম্পিং করার কাজ-ও। আমরাতো আর পারমানবিক অস্ত্র বানাচ্ছিনা, শুধু বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবো, আমাদের আর কি ভয়?
মাত্র দুটি দুর্ঘটনা (তাও কিনা অপারেটরদের দোষে) বাদ দিয়ে আর কোন দুর্ঘটনা হয়নি, আর ভবিষ্যতে হবার সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। বর্তমানে প্রযুক্তিক উৎকর্ষতার পরিধি এত বিস্তার লাভ করেছে, নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের দুর্ঘটনা এখন শুধুই ইতিহাস! বিশ্বের ৩০ টি দেশে ৪৩৭ টি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনা আছে, আর ৫০ টি নির্মানাধিন।
দিনমজুর প্রশ্নঃ৬। এমন হাইলি টেকনিক্যল ও সফিসটিকেটেড প্রযুক্তি আনার মত টেকনিক্যল এক্সপার্টিজ আমাদের আছে? আনলে এক্সপার্টিজ গ্রো করবে? বাংলাদেশে নর্মাল গ্যাসচালিত পাওয়ার প্ল্যান্ট বিস্ফোরণ হলে সেটার রিপেয়ার করার জন্য প্ল্যান্ট বসানো কোম্পানির সহায়তা চাওয়া হলে তারা আসতে চায় ৬ মাস পরে। জাপানের মত দেশে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে দুর্ঘটনা ঘটলে তারা মার্কিন কোম্পানীকে তলব করলে- সেই কোম্পানী তিনমাসের মধ্যে হাজির হতে অপরাগতা জানায়।
বাংলাদেশে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের এমন কিছু ঘটলে তা সামাল দিতে পারবো?
উত্তরঃ => বাংলাদেশের দক্ষ লোকের ব্যাপারটা আগের পোষ্টেই আলোচনা হয়েছে। হাইলি সফিসটিকেটেড টেকনলজির ব্যপারটা বোধগম্য নয়! নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর থেকে শুধু আমরা শক্তি পাব, বাকি পুরোটাই কনভেনশনাল বয়লারে পানি গরম করে স্টিম বানিয়ে টার্বাইন ঘোড়ানো। প্রায় সত্তর-আশি বৎসর আগের একটা প্রযুক্তিকে আপনি হাইলি সফিসটিকেটেড বলতে পারেন না এখন আর। বর্তমানে প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র যে সকল পারমানবিক চুল্লি বন্ধ করে দিচ্ছে, সেগুলো পুরাতন প্রযুক্তির। নিউ জেনারেশন নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর যেগুলো জাপান-কোরিয়া ব্যাবহার করে সেগুলো ১০০% নিরাপদ আর প্ল্যান্ট লাইফ ৭০ বৎসর! তার মানে পুরো এক প্রজন্মের বিদ্যুৎ নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। আর নিউ জেনারেশন নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর 'পিবল বেড' টাইপ। সেই প্রাচীন মান্ধাতা নিউক্লিয়ার ফুয়েল রড দিয়ে চেইন বিক্রিয়া করানো হয় না যার কারনে আরেকটা চেরনোবিল বা থ্রি মাইল আইল্যান্ডের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই বলা যায় এটি শতভাগ সেইফ।
কিন্তু আমি রাশিয়ান টেকনোলজি সম্পর্কে কিছু জানিনা। তারা এখনোও প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে কিনা। ব্যক্তিগত ভাবে এজন্য আমি রাশান প্রযুক্তির বিরোধী, আর সরকার একটু সস্তা দেখে যদি তাদের প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পরে, তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে বলে মনে হয় না। এর চেয়ে জাপানী বা দক্ষিন কোরিয়ান প্রযুক্তি অনেক উন্নতমানের ও নির্ভরযোগ্য। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ডিজাইন, কন্সট্রাকসন, কস্টিং সবকিছু সম্পর্কে ধারনা পেতে চাইলে এম.আই.টি -র একটা প্রসেস ডিজাইন অভিসন্দর্ভ 'নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট ডিজাইন ' দেখতে পারেন।
মূলত মার্কিন প্রভূরা জানেন যদি পারমানবিক শক্তি জনপ্রিয় হয় তাহলে তাদের তেলের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে আর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্ত থাকবেনা। ঠিক এই কারনেই তারা পারমানবিক শক্তির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাতে পটু। এ নিয়ে হলিউডে কিছু ফিল্ম-ও বানানো হয়েছে। কিন্তু আশা রাখি, অতি সত্বর সরকার পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবেন আর আমরা লোডশেডিং এর কবল থেকে রক্ষা পাব।
রেফারেন্সঃ লিঙ্ক এমবেড করা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৩:৫৭