আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে পীরের মাজার ছিল। এখনও আছে। পীরের মুরিদরা বলতো মাজার; আমরা বলতাম পীরের বাড়ী। এখনো বলি 'খোকা পীরের বাড়ি'। আমাদের বাসার উত্তর-পশ্চিম কোণে, একটা ছোট মাঠ, মাঠ পেরোলেই একটা ছোট পুকুর, ওই পুকুরের পরেই পীরের বাড়ি। ওই পুকুরটাকে আমরা বলতাম পীরের বাড়ির পুকুর। এখনও বলি। নতুন গড়ে ওঠা বাসা-বাড়ির চাপে মাঠটি আজ অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে। তবে পুকুরটা রয়ে গেছে আগের মতোই; শুধু পানি নেই! আর এ কারণেই কোনো হাঁসও আসেনা ইদানিং ওই পুকুরে। অযত্নে পরে থাকা খোকা পীরের কবরের মতো পুকুরটিও আজ প্রাণহীন। আমি যখন ছোট ছিলাম অথবা খোকা পীর যখন বেঁচে ছিল তখন ওই পুকুরটা ছিল প্রাণবন্ত। প্রতি শীতে জীবন্ত হয়ে উঠতো নরম সোনালী রৌদ আর চকচকে হাঁস-হাঁসির জলকেলিতে।
দুপুরের খাওয়া হলেই আমি দৌড়ে চলে যেতাম পুকুর পারে। কনকনে শীতে ক্ষনিকেই উষ্ণ হয়ে উঠতাম দুপুরের রোদে। বসে বসে দেখতাম হাঁসের জলকেলি। জাফরান রঙে রাঙা ঘাস ফড়িং যখন উড়ে এসে খুব কাছে আসতো, আমি ওদের পিছু নিতাম। উড়ন্ত ঘাস ফড়িং কখনো ধরা যায় না- এই সত্যটা আমি তখনিই শিখেছি। কখনো কখনো একটা দুষ্ট হাঁস আরেকটা হাঁসের উপরে চড়ে বসতো। উপরের হাঁসটা নীচে থাকা হাঁসটার মাথার পালকে কামড়দিয়ে নিষ্ঠুর ভাবে লেজ বাঁকিয়ে পানির মধ্যে চেপে ধরতো। আমি বুঝতাম না কেন। পরে জেনেছি ওটা হাঁস-হাঁসির সঙ্গম।
ছোট বেলায় পীরের বাড়ির প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল প্রবল। আকর্ষণটা ছিল প্রধানত দুটো কারণে: এক হলো এই পুকুর আর আরেকটা হলো পীরের বাড়ির ইটের ভাটা। তৃতীয় আরেকটা কারণ অবশ্য ছিলো। কিন্তু সেটা ছিল বছরের শুধু মাত্র একটা বিশেষ দিনের জন্য। না, সেটা পীরের বাড়ির উরসের দিন নয়। ওটা ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী।
ছোট বেলায় প্রতি বছর আমরা ২১ ফেব্রুয়ারী উজ্জাপনের জন্য শহীদ মিনার বানাতাম। মিনারের বেদী সাজানোর জন্য অনেক ফুলের দরকার পড়তো। আর এই ফুলের প্রধান উৎস ছিল পীরের বাড়ির বাগান। পীরের বাড়ির বাগানে ছিল হরেক রকম ফুল: মোরগ ফুল, গাঁদা ফুল, গোলাপ ফুল, জবা ফুল, ঘাস ফুল। বাগানটা ছিল শক্ত বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। খুব উঁচু করে বেড়া দেয়া থাকতো সবসময়। ওই বাগানে কোনো মালি ছিল না। বাগানের দেখা শোনা করতো মুরিদরা। আর ওই মুরিদরা তাদের জীবন দিয়ে রক্ষা করতো বাগানের প্রতিটি ফুল। ঝরে পরে থাকা ফুলও তারা ছুঁতে দিতো না। যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতো।
ছেলে বেলায় আমরাও ছিলাম বিচ্ছুর দল। কোনো কিছুর ভয় করতাম না। রাতের আঁধারকে ভয় করতাম না, সাঁপ ভয় করতাম না, ভয় করতাম না ওই বাগানের পাহারাদার মুরিদদেরও। আর ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে আমরাও পেতাম স্বাধীনতা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছিল আমাদের ছেলেবেলার স্বাধীনতা দিবস। ওই দিনই বছরের একটি মাত্র দিন যেদিন আমরা সবাই রাতে বাইরে থাকতে পারতাম। রাতের কালো আঁধার ভেদ করে চারদিক রাঙিয়ে ভোর কিভাবে হয় তা আমরা প্রথম দেখেছি ওই ২১ শে ফেব্রুয়ারিতেই। ২০ তারিখের সারা রাত আমরা সবাই নির্ঘুম কাটাতাম। সকালে উপভোগ করতাম বিজয়ের এক অসাধারণ টলমলে স্বাদ! ছেলে বেলার প্রতিটি বছর এই একটা ভোরের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম।
ফেব্রুয়ারির উনিশ তারিখেই আমরা শহীদ মিনার তৈরী করে ফেলতাম। বিশ তারিখের সাড়াটা দিন রাখতাম মিনারকে সাজানোর জন্য। আর সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো আমাদের ফুল সংগ্রহের অভিযান। পীরের বাড়ির ফুল বাগানটা ছিল মাজারের একদম পেছনে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। বাগানের পেছন ঘেঁষেই ছিল একটা গভীর গর্ত আর তার পরেই দুটো উঁচু টিলা। আমরা বিকেলে দলবেঁধে যেতাম বাগানের ফুল পরিদর্শনে। টিলায় উঠে ফুলের পর্যাপ্ততা পর্যবেক্ষণ করতাম। উঁচু বেড়া থাকায় টিলায় না উঠে বোঝা যেত না বাগানে কি পরিমান ফুল আছে। কখনো কখনো কালো দাঁতওয়ালা পাহারাদার মুরিদ আমাদের দেখে ফেলতো আর তখনি শাসাত, "বাগানের ত্রিসীমানায় আসলে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেব!" আমরা দৌড়ে পালাতাম।
রাত এগারোটায় শুরু হতো আমাদের ফুল সংগ্রহ অভিযান। ফুল সংগ্রহকে আমরা কখনোই চুরি ভাবতাম না। আজও যদি আমি অন্যের বাগান থেকে না বলে ফুল তুলে এনে শহীদ মিনারের বেদিতে দেই, আমি ওটাকে চুরি ভাববো না। রাত এগারোটায় ওই পাহারাদার মুরিদ গভীর ঘুমে থাকতো। আমরা পাঁচ জন সুরসুর করে নেমে যেতাম বাগানের পেছনের কাদাপানি গর্তে। ওই রাতে সকল সাঁপ-ব্যাঙও ওই পাহারাদার মুরিদের মতো গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে থাকতো। আমরা একটা একটা করে বাঁশের চটি ভাঙতে থাকতাম। কটমট শব্দ হতো। তবে, ওই শব্দে মুরিদ বা সাঁপ কেউ জেগে উঠতো না। কোনো টর্চ বা বাতি নেই। চাঁদের মৃদু আলোতে আমরা সব দেখতে পেতাম পরিষ্কার। ছেলেবেলায় আমাদের সবার চোখ ছিল বিড়াল চোখ।
বেড়া ভেঙে দুজন ঢুকে পড়তাম বাগানে। দ্রুত ফুল ছিড়তে থাকতাম গাছ থেকে। মাঝে মাঝে ফুল সহ গাছ উপরে ফেলতাম। গাঁদা ফুল গাছের শেকড় খুব নরম। বেশির ভাগ সময় ই গাঁদা ফুল গাছ সহই তুলে আনতাম। দশ মিনিটেরও কম সময়ে আমাদের ফুল তোলা শেষ হয়ে যেত। আমরা ফিরে আসতাম আমাদের শহীদ মিনারের আলোকিত চত্বরে। ওখানে অপেক্ষা করতো আমাদের দলের আরো কয়েকজন। ওদের কাজ ছিল ফুলগুলোকে বাছাই করে মিনারে দেয়ার জন্য প্রস্তুত করা। বারোটা এক মিনিটের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম। ক্যাসেট প্লেয়ারে চলতো শেখ মুজিবের ভাষণ অথবা কখনো 'আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার'!
রাত বারোটা বাজলেই আমরা ফুল দিয়ে মিনারটিকে সাজাতাম। ইট আর মাটি দিয়ে বানানো মিনার। উচ্চতায় আমাদের চেয়ে কিছুটা কম। কালো রং করা। সকাল হলেই আমাদের মা, বোন, বড়ো ভাই, মামারা একে একে এসে শহীদ মিনার দেখে চলে যেত। ততক্ষনে আমরা সবাই ঘুমে ঝিমুচ্ছি। সকাল হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসতো। শরীরের ভেতর কেমন জ্বর জ্বর অনুভব করতাম। তেরো চোদ্দ বছর বয়সে রাত জাগার ধকল সহ্য করা কঠিন। আমরা সবাই সেই কঠিন কাজটি করে তৃপ্ত হতাম। আমরা তখনও বুঝতাম না ভাষা আন্দোলন কি অথবা সালাম-বরকত-রফিক-জব্বার কেন জীবন দিয়েছিলো। আজও বুঝতে পারি না কেন মানুষ ভাষার জন্য জীবন দেয়।
আজ, বাঙালি যারা বাংলায় কথা বলে, তারা বলে বেদিতে ফুল দেয়া হারাম। মিনার বানানো হারাম। আমার ছেলে বেলায় আমাদের কেও এ কথা বলেনি। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। পীরের বাড়িতে এখন নতুন পীর। সে তার ফুল বাগানে এখন সবজি চাষ করে। সবজি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক।
নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আজ ব্যস্ত তাদের সফ্টটাচ মোবাইল নিয়ে। তারা আজ কথা বলে হ্যাশ ট্যাগ আর ইমোজি দিয়ে। যে ছেলেবেলায় আমরা হাঁসের সঙ্গম বুঝিনি; সে ছেলে বেলায় আজ ওরা বুঝে গেছে 'লিটনের ফ্ল্যাট'। ওদের গ্যালাক্সীর ক্যালেন্ডারে আজ কোনো ২১ তারিখ নেই। ১৪ তারিখের উম্মাদনায় ওরা আজ উজ্জীবিত। সময় অনেক পেরিয়ে গেছে। শীতের রৌদ্র আজ বড়োই বেমানান, কটমটে।
খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
লন্ডন, ৫ জানুয়ারী ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:২৫