শোলাকিয়ায় বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ঈদের জামাত হয়। প্রতিবারের মতো এবারও হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছে ঈদের নামাজে। আর এর ভিতরেই, ঈদগাহ থেকে কিছু দূরেই মৌলবাদী চক্র গুলি বোমা করে মেরে ফেললো চারজনকে আর আহত করলো গোটা পঞ্চাশ। মুসলমানদের জন্য ঈদ একটা আনন্দের দিন। আর এই আনন্দের দিনেই মৌলবাদীরা, চাপাতি, পিস্তল, বোমা নিয়ে বের হলো হত্যাযজ্ঞ চালাতে। আমি যখন এই খবরটা পেলাম, তখন খুব খারাপ লাগলো। আমার দেশের ঈদগাহও আজ আর নিরাপদ নয়।
আমার ঠিক ঠিক মনে আছে, যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদেরকে ঈদের দিন স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দিতেন। ঐ ছোট ছেলে বয়েসে, ঈদের দিন আমরা দল বেঁধে বাসা থেকে অনেক দূরে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহ এ যেতাম নামাজ আদায় করতে। নামাজ শেষে দলবেঁধে ঘুরতে বের হতাম এদিক ওদিক। বছরের অন্য কোনো দিন আমাদের বাবা-মায়েরা ঐ বয়সে আমাদের কখনো একা একা বাসার বাইরে বেশী দূরে যেতে দিতেন না, পাছে ছেলে ধরা ধরে নিয়ে যায়! অথবা বড়ো রাস্তায় একটা গাড়ি এসে চাপা দিয়ে যায়।
ঈদের দিন কেন যেন, আমাদের বাবা-মায়েরা এই ভয় পেতেন না। আমাদেরকে ইচ্ছে মতো ঘুরতে দিতেন। শুধু বলতেন আমরা যেন সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসি। আমরাও তখন কোনো ভয় পেতাম না। আমরা ভাবতাম: ঈদের দিন কোনো ছেলেধরা বের হবে না; ঈদের দিন কোনো বড়ো গাড়ি আমাদের চাপা দিবে না; অথবা আমরা অচেনা রাস্তায় গিয়ে কখনো হারিয়ে যাবো না।
আমাদের শৈশবের ঈদের দিনগুলোতে কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠী চাপাতি, গুলি, বোমা নিয়ে বের হতো না। ঈদের দিনগুলো ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ দিন। সবচেয়ে আনন্দের দিন।
ছেলেবেলায় আমাদের একটা ছোট গ্রূপ ছিল। প্রথম রোজা থেকেই আমরা ঈদে কি করবো তার একটা প্লান বানাতে শুরু করে দিতাম। প্রিতিদিন দিনের অনেকটা সময় আমরা ব্যায় করতাম এই ঈদ প্ল্যানিংয়ে! কত ঘন্টা রিক্সায় ঘুরবো। আমাদের সাত-আটজনের কে কোন রিক্সায় উঠবে। কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো। রিক্সায় আমরা কি কি খাবার সাথে নিবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার মনে আছে একবার আমরা প্ল্যান করলাম সবাই মিলে সিগারেট খাবো। তখন আমরা কেও সিগারেট খাওয়া শিখিনি। আমাদের বড়ো ভাইদের দেখে আমাদেরও সিগারেট খাওয়ার শখ জাগলো। আমরা সবাই প্ল্যান করলাম আমরা ঈদের দিন নামাজ পড়ে রিক্সা নিয়ে অনেকদূর চলে যাবো যেন সেখানে আমাদের কেও চিনে না ফেলে। তারপর সেখানে গিয়ে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাবো!
প্ল্যান মতোই সেবার আমরা সিগারেট খেয়েছিলাম। বাসা থেকে অনেক দূরে, অচেনা একটা জায়গায়। সাথে নিয়েছিলাম অচেনা এক রিক্সাওয়ালা। হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় ছিলোনা মনে।
জীবনের প্রথম বাবা-মা ছাড়া বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে নিউমার্কেটে গিয়েছিলাম ঐ ঈদের দিনই। পকেট ভর্তি ঈদ সালামীর টাকা। কিছুক্ষন পরপরই পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে গুনে দেখতাম কত টাকা হয়েছে। ঈদের দিন কোনো ছিনতাই করিও বের হতো না। তাই আমরা ছিলাম নিরাপদ। আমার পরিষ্কার মনে আছে: নিজের টাকায়, নিজে নিজে মার্কেটে থেকে আমার জীবনের প্রথম শপিং করা ঐ ঈদের দিন ই! আর প্রথম শপিং ছিল 'চশমাওয়ালা নাক'!
আজ যখন পত্রিকার পাতা ভরে খবর আসছে মৌলবাদীরা ঈদগাহের ময়দানে বোমা বিস্ফোরণ করে মানুষ হত্যা করেছে; তখন ভাবছি আর হয়তো কোনোদিন বাংলদেশের ছোট ছোট ছেলেরা ঈদের দিন নির্ভয়ে রিক্সা নিয়ে ঘুরতে বের হবে না। একা একা ঈদ গাহে যেতে সাহস পাবে না অথবা নিজের পয়সায় কোনো ছেলে কিনবে না ‘চশমাওয়ালা নাক’। অথবা হয়তো এটা আমার ভুল, হয়তো কিছুই হয়নি। হয়তো আজকের ঘটনা একটা দুর্ঘটনা। প্রতিটা ঈদ থাকবে ঈদের মতোই নিরাপদ, ঈদের মতোই আনন্দময়- যেমনটা আগে ছিল- তেমনটিই থাকবে আজীবন। বাংলদেশের সবার জন্য শুভ এবং আনন্দময় ঈদ।
লন্ডন, ৭ জুলাই ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৪১