ছেলেকে যতবারই ক্যান্ডি ফ্লস কিনে দেই ততবারই আমার হাওয়াই মিঠাইয়ের কথা মনে পরে। পলিব্যাগে মোড়ানো পিঙ্ক, পার্পল বা হোয়াট যে রঙের ক্যান্ডি ফ্লসই কিনে দেই না কেন, কোনো বিশেষ উদ্দীপনা ছাড়াই আমার ছেলে তা খেতে থাকে। অথবা আধখানা খেয়ে ফেলে দেয়। ক্যান্ডি ফ্লসের প্রতি ওর কোনো বাড়তি আগ্রহই দেখি না।
মনে পরে, আমি যখন ছোটো ছিলাম, হাওয়াই মিঠাই খাওয়াটা ছিল আমার কাছে একটা চাঞ্চল্যকর ব্যাপার। ব্রিটেনে যেমন কোনো মেলা হলেই ক্যান্ডি ফ্লস পওয়া যায়, বাংলাদেশে তেমনটি পওয়া যেত না। শীতের দিনেই শুধু হাওয়াই মিঠাই পওয়া যেত। আমি ফরিদপুরে যে এলাকায় বড় হয়েছি, যে এলাকাতেই একজন লোক হাওয়াই মিঠাই বানাত। সবসময় তার কাছ থেকে হাওয়াই মিঠাই খেতাম, কিন্ত লোকটির নাম কি কোনো দিন জানা হয়নি! আজও জানি না। আমরা তাকে সবাই হাওয়াই মিঠাইওয়ালা বলে ডাকতাম।
এখন আমি যে দেশে থাকি সেখানে বছরের আট মাসই শীত। বৃটেনের শীত বিরক্তিকর। শীতকাল যে কতটা সুন্দর হতে পারে তা বাংলাদেশে বসবাস না করলে কেউ জানতে পারবে না। বাংলাদেশে শীতের প্রতিটি ভোর উপভোগ করার মত। শীতের ভোর মানে ধীরে ধীরে মঞ্চের কুয়াশা-পর্দা উঠে যাওয়া। শীতের ভোর মানে রাঙা সূর্যের সোনালী আলোতে প্রতিটি প্রাণে জীবনের সঞ্চার। পকেটে চার আনা নিয়ে আমি প্রবেশ করতাম সেই ভোরের নাট্টমঞ্চে। নাটকের সব চরিত্র আমার পরিচিত। নাটকের ঘটনা প্রবাহ সবই আমার জানা। প্রতি শীতেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি। আমি জানতাম, সূর্য উঠার সাথে সাথেই হাওয়াই মিঠাইওয়ালা তার জাদুকরী মেশিনে হাওয়াই মিঠাই বানাচ্ছে। সূর্যের আলো মেশানো গাড় গোলাপী রঙের রেশমী হাওয়াই মিঠাই থরে থরে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে কাঁচের একটি ছোট্ট বাক্সে।
আব্বা-আম্মা ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি উঠে পরতাম চুপি চুপি। তখন বয়স দশ কি এগারো। ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুয়েই বেরিয়ে পরতাম জাদুকরি হাওয়াই মিঠাইওয়ালার বাসার দিকে। আমাদের বাসা থেকে চারটি বাসা পেরিয়েই ব্যাপারী বাড়ি। আর হাওয়াই মিঠাইওয়ালা তার পরিবার নিয়ে ব্যাপারী বাড়ির পতিত একটা জায়গায় কুঁড়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করে। তখনও প্রাচীর দিয়ে একটা বাসা থেকে আরেকটা বাসাকে আলাদা করা হয়নি। প্রতিটা বাসার সামনেই ছিল অনেকটা ফাঁকা জায়গা। ওই ফাঁকা জায়গা বাদেই আমাদের এলাকাতে প্রবেশের একটা লম্বা রাস্তা চলে গিয়েছে পশিম দিকে এবং তারপর একটু বেকিয়ে মিশে গিয়েছে অম্বিকাপুরের প্রধান রাস্তার সাথে। আমি কখনো ওই রাস্তা দিয়ে হাওয়াই মিঠাইওয়ালার বাসায় যেতাম না। আমার শীতের নাট্টমঞ্চে ওই রাস্তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আমি যেতাম বাসার সামনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে, একটির পর একটি বাসা পার হয়ে। চতুর্থ বাসটি ছিল আলোদের বাসা। এর পরেই ছিল এক বিশাল বাগান। বাগানটিতে ছিল কাঠবাদাম গাছ। বকুল ফুল গাছ। গাব গাছ। আম গাছ। আরো অনেক গাছ। ঘন বাগানের মাঝ দিয়ে একটা সরু হাঁটা পথ চলে গেছে। ওই পথের শেষেই হাওয়াই মিঠাইওয়ালার বাসা। দূর থেকেই শুনতে পেতাম ঘরঘর শব্দে মেশিন চলছে। হস্তচালিত মেশিন। মেশিনের কাছে গিয়েই আমার আনন্দের আর সীমা থাকত না! আমি অবাক হয়ে দেখতাম ম্যাজিক। একজন ম্যাজিসিয়ান, এক জাদুকরী ভঙ্গিমায় হাত ঘুরিয়ে বের করে নিয়ে আসছে একের পর এক গোলাপী রঙের জাদুর মিঠাই।
আমি পকেট থেকে চার আনা বের করে দিতেই ম্যাজিসিয়ান আমার হাতে তুলে দিত কাঠি বিহীন, ওজন-শূন্য গোলাপী রঙের চারটি হাওয়াই মিঠাই। আমি একটি একটি করে মুখে পুরে দিতাম। নিমেষে গলে যেত মুখের ভেতর তবে একটা অদ্ভুত মিষ্টি স্বাদ লেগে থাকত অনেকক্ষণ। আমার লাল টকটকে জিভ দেখে আম্মা শুধু বুঝতে পারত আমি হাওয়াই মিঠাই খেয়েছি। যেদিন পকেটে আট আনার একটি আধুলি থাকত, সেদিন লটারি ধরতাম।
আট আনায় পাওয়া যেত আটটি হাওয়াই মিঠাই, সাথে একটি বোনাস লটারি টিকেট। লটারি টিকেট গুলো ছিল ছোট্ট বর্গাকৃতির সাদা কাগজ। কাগজে লেবুর রসে লেখা থাকত এক থেকে আট সংখ্যা। লটারির টিকেটগুলো একটি ধাতব রিঙের সাথে গাঁথা থাকত। লটারির কাগজ না ভেজানো পর্যন্ত বোঝা যেত না কোন কাগজে কোন সংখ্যা লেখা। আমি বিসমিল্লাহ বলে চোখ বন্ধ করে একটি লটারি কাগজ তুলে নিয়ে জিহ্বার উপর রাখতাম। ক্ষনিকের মধ্যেই কাগজে লেবুর রসে লেখা একটি সংখ্যা ভেসে উঠত। যদি কখনো নাম্বারটি হত ৮, সেদিন পেতাম ১৬ টি হাওয়াই মিঠাই। সেদিন মনে হত আমি বিশ্ব জয় করেছি! আনন্দে নাচতে থাকতাম। অবশ্য ওই বিশ্বজয়ের সৌভাগ্য আমার খুব কমই হয়েছে।
আমার ছেলে হয়ত কোনদিন জানবে না যে হাওয়াই মিঠাই খেয়েও বিশ্বজয়ের আনন্দ পাওয়া যেতে পারে। আমার ছেলে হয়ত শুধু জানবে ম্যাজিক শুধু হ্যারি পর্টারের হগওয়ার্ট স্কুলেই সম্ভব। সে হয়ত জানবে 'ম্যাজিক ওয়ান্ড' ছাড়া ম্যাজিক সম্ভব না। কিন্তু আমি তো জানি শীতের ভোরে সব ম্যাজিকই সম্ভব। আমার কাছে ওই হাওয়াই মিঠাইওয়ালাই বড় ম্যাজিসিয়ান- ডাম্বেলডোরের চেয়েও বড় ম্যাজিসিয়ান!
খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
লন্ডন, ১৫ জুন ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:২৩