তখন অক্টোবর মাস। ২০০৬ এর কথা। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটানা দশ ঘন্টা জার্নির ধকল কাটিয়ে, ইমিগ্রেশন অফিসারদের সকল প্রাসংগিক এবং অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে হিথ্র এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাড়িয়েছি। বাইরে এসেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিশ্রী রকমের একটা ডিজেলের গন্ধময় বাতাস বইছে। ঠান্ডা - ওটাকে ঠিক শীত বলা যায়না। শীত আরো সুন্দর! চারদিকে গাড় হলুদ রং- গেরুয়া রং। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। বড় চাচার আসার কথা। কোথাও দেখছি না। চারদিকে সব অপরিচিত মানুষ। প্রায় আধা ঘন্টা ঠান্ডা বাতাসে দাড়িয়ে আছি। চাচার কোনো দেখা নেই। লন্ডনে এসে আমার প্রথমে চাচার বাসায় ওঠার কথা। ভাবছি কি করি। এমন সময় দেখি চাচা! এয়ারপোর্টের বহি:র্গমন পথ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে। হাজার অপরিচিত মানুষের মাঝে চাচাই একমাত্র পরিচিত - দেখেই চিনে ফেলতে কোনরকম অসুবিধা হলো না। "কিরে তুই বাইরে চলে এসেছিস কেন? আমি তোর জন্য এরাইভাল লাউঞ্জে এতক্ষণ অপেক্ষা করছি!" বুঝতে পারলাম আমারই ভুল হয়েছে। আমার ভেতরেই অপেক্ষা করা উচিত ছিল- এরাইভাল লাউঞ্জে। বাংলাদেশের এয়ারপোর্টের এরাইভাল লাউঞ্জ হচ্ছে একদম এয়ারপোর্ট বিল্ডিংএর বাইরে-- ওটা ভেবে আমি হিথ্র এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাড়িয়ে ছিলাম। নিজেকে বেশ বোকা মনে হলো।
ঐ দিনই জীবনের প্রথম আমি মার্সেডিজ গাড়িতে চড়ি- চাচার গাড়ি- মার্সেডিজ সি-ক্লাস। তখন পর্যন্ত আমি জানতাম মার্সেডিজ হচ্ছে বড়লোকদের গাড়ি। বাংলাদেশে কেও মার্সেডিজ চালায় মানে হচ্ছে লোকটি ধনীদের মধ্যে অন্যতম! তবে চাচার মার্সেডিজ দেখে আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছিলাম তার এক মাস পরে। আসলে ইউকেতে এসে অনেক কিছুতেই আমি বড় অবাক হয়েছি, এবং এখনো হচ্ছি।
আমার ইউনিভার্সিটি ছিল পশ্চিম লন্ডনে, আর আমার চাচার বাসা হলো পূর্বে। পশ্চিম থেকে পূর্বে গিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করা খুব ক্লান্তিকর এবং ব্যয়বহুল। তাই আমি চাচার বাসা ছেড়ে চলে গেলাম পশ্চিম লন্ডনের আরেক বাসায়। ইউনিভার্সিটির নোটিশ বোর্ডে 'টু-লেট' দেখে একটা রুম ভাড়া নিলাম। ওই বাসার মালিক পাকিস্থানি। বাসাটা ভালই। বেশ বড়। বাসায় থাকে বাসার মালিক, তার ইস্ত্রী এবং তার ছোটো ভাই। একদিন বাসার মালিক (মালিকের নামটাও আবার মিস্টার মালিক!) আমাকে বলল, "মেহেদী, আজ বাসায় কারেন্টের মিস্ত্রী আসবে বিদ্যুত লাইন এবং সুইচ চেক করতে। তুমি একটু বাসায় থেক।" আমি বললাম, "ওকে, নো প্রবলেম।"
দুপুরের দিকে একটা ঝকঝকে মার্সেডিজ গাড়ি এসে থামল বাসার সামনে। আমি জানালা দিয়ে দেখছি। একজন ভদ্রলোক এসেছেন, দরজায় নক করছেন। আমি দরজার ওপাশ থেকে জানতে চাইলাম কে। সে বলল যে তার আজকে দুইটার সময় এই বাসায়ই আসার কথা। আমি বললাম, মিস্টার মালিক বলেছে দুইটার সময় ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আসবে। লোকটি বলল সে-ই ইলেকট্রিক মিস্ত্রী। আমি দরজা খুলে দিলাম। লোকটি ভেতরে ঢুকে ঘরের প্রতিটি সুইচ খুলে খুলে পরীক্ষা করলো। এক ঘন্টা পর আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে বলল, "অল ওকে।" ঐদিন আমি অবাক হয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম এই দেখে যে, বাসায় কাজ করতে আসা ইলেকট্রিক মিস্ত্রী চালায় মার্সেডিজ আর বাড়ির মালিক, মিস্টার মালিক চালায় একটা কোমর বসে যাওয়া সবুঝ রঙের নিশান গাড়ি!
২০০৮ সালের গোড়ার দিকের কথা। বউ-বাচ্চা নিয়ে লন্ডনে এসেছি। মাস্টার্স শেষ করে তখন পিএইচডি'র জন্য স্কলারশিপ খুঁজছি। একটা শেয়ার বাসায় উঠেছি। বাসার মালিক বাংলাদেশী, কিন্তু তার নামটা মিডল ইস্ট এর একটা দেশের নামে। ভদ্রলোক তখন পিএইচডি করছেন। তিনি সারাদিন কাজ করতেন আমের দোকানে। আমের দোকানে সারাদিন কাজ করে কিভাবে পিএইচডি করা যায়-- এর উত্তর আজও আমি খুঁজে পাইনি!
ওনাকে আমি অবশ্য কখনো জিজ্ঞেস করিনি কিভাবে পিএইচডি'র জন্য স্কলারশিপ এর ব্যবস্থা করা যায়। তবে যেহেতু চাকরিহীন কয়েকমাস কাটানোর পর পকেটের টাকা প্রায় শেষ হয়ে আসছিল; আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিভাবে 'অড জব' ম্যানেজ করা যায়। বেঁচে থাকার জন্য একটা যেকোনো ধরনের জব তখন খুবই দরকার হয়েছিল। ওই ভদ্রলোক আমাকে বলেছিল 'ল্যাডব্রোক' এ জব খুঁজতে। আমি অবাক হয়েছিলাম। ল্যাডব্রোক হলো জুয়ার ঘর। একজন মানুষ যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে, যে খবর রাখে কোথায় হালাল মাংশ পাওয়া যায়, সে কিভাবে আমাকে জুয়ার ঘরে হারাম কাজের খোঁজ দেয়! মনে মনে ওকে আমি মাদারচোদ বলেছিলাম। হিপোক্রেটদেরকে আমি সবসময় মাদারচোদই বলি।
বউ বাচ্চাকে বাসায় রেখে প্রতিদিন সকালে বেড়িয়ে পরতাম অড জবের সন্ধানে। লন্ডনের প্রতিটি কোনায় কোনায় গিয়ে জব খুজতাম। দু’ পায়ে ব্যথা নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসতাম। রাতে পিএইচডি'র স্কলারশিপ এর জন্য এপ্লিকেশন করতাম। ইমেইল খুলে হতাশ হতাম। প্রায় পঞ্চাশটা জায়গায় এপ্লিকেশন করেছি। কোনো সারাশব্দ নেই। বার্গার কিং এর দোকানে চাকরির জন্য পরীক্ষা দিলাম, এবং পরীক্ষায় ফেল করলাম। ওটাই জীবনের প্রথম আমি কোনো পরীক্ষায় ফেল করলাম। এরপর পরীক্ষা দিলাম সেইনসব্রি দোকানে চাকরির জন্য- সেখানেও ফেইল করলাম! অড জবের বাজারে আমার অবস্থা তখন খুবই শোচনীয়।
লন্ডনে আমি যেহেতু কোনো বাঙালি গ্রুপের সাথে ছিলাম না, তাই আমাকে হেল্প করার মত আশেপাশে তেমন কেউ ছিল না। একা একা যা বুঝেছি, তাই করেছি। যতটুকু মনে পরে, আমাদের মেডিকেল কলেজেরই কোনো এক বড় ভাই আমাকে বলেছিল মার্বেল আর্চ টিউব স্টেশনের নিচে একটা অফিসে ম্যাকডোনাল্ডসের জন্য কর্মী নিযোগ দেয়া হয়। পরদিনই সকালে চলে গেলাম মার্বেল আর্চের ওই স্টেশনে। প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলাম এবং দ্বিতীয় ইন্টারভিউ এর জন্য আমাকে পাঠানো হলো লন্ডন আইয়ের কাছের ম্যাকডোনাল্ডসে। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি আমি ছাড়া আরো তিনজন বসে আছে। জব না পাওয়ার দুঃশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে গেল! জুয়েল নামক এক ভদ্রলোক আমার ইন্টারভিউ নিল। বিকেলে ফোনে জানতে পারলাম ম্যাকডোনাল্ডসের জন্য আমি নির্বাচিত হয়েছি! একটা দিনব্যাপী ট্রেইনিং এর পরে ফ্রাই-ম্যান হিসেবে জয়েন করলাম লন্ডন আইয়ের ওই ম্যাকডোনাল্ডসে। দিনে ছয় ঘন্টা ফ্রেন্চ ফ্রাই ভাজতাম আর রাতে পিএইচডি'র জন্য এপ্লিকেশন জমা দিতাম। আমার আলুর চিপস ভাজার দক্ষতায় ওই ম্যাকডোনাল্ডসের ম্যানেজার জুয়েল ভাই মুগ্ধ! উনি আমাকে বলল আমাকে খুব তারাতারই ফ্লোর ম্যানেজার বানানো হবে-- আমার প্রমোশন হবে!
আমি তখনও জুয়েল ভাইকে বলিনি যে আমি পিএইচডি’র জন্য একটা স্কলারশিপ পেয়েছি। ইউকে’র মেডিকেল রিসার্চ কউন্সিলের খুবই সন্মানজনক ডরোথি হজকীন পোস্টগ্রাজুয়েট অ্যাওয়ার্ডএর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে আমাকে। তিন বছরে মোট ৭০ হাজার পাউন্ড দেয়া হবে আমার স্টাইপেন্ড এবং গবেষনার জন্য। ২০০৮ এর অক্টোবর থেকে শুরু করলাম আমার জীবনের নতুন আরেক অধ্যায়। শেষ হলো ম্যাকডোনাল্ডসের জব।
আজ অনেকদিন পর একটু সময় পেলাম গুগল ট্রান্সলেটে নিজের স্মৃতি কথা লিখতে। দু-একটি ঘটনা লিখেও ফেললাম। অনেকটা সময় পার করে এসেছি। জানিনা, ওই ভদ্রলোক আজও আমের দোকানে পিএইচডি করছে কিনা; অথবা মিস্টার মালিক আজও কি ওই কোমর বসে যাওয়া সবুঝ রঙের নিশান গাড়ি চালায় কিনা। তবে, আমি যেটা নিশ্চিত ভাবে জানি তা হলো, ইউকেতে কে লিভাইস জিন্স পড়ল আর কে কোন গাড়িতে চড়ল তাতে কারো কিছু যায় আসে না। ইউকেতে আসে-যাওয়ার মানে ভিন্ন। যে দেশে শীতের সৌন্দর্য নেই, আছে শুধু ঠান্ডা, সে দেশের অনেক কিছুই ভিন্ন।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন,
২৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৪