তখন ছোটবেলা, প্রতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বের হতাম-- একা একাই। রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে কিছুটা হেঁটে গেলেই ঘোষের বাড়ি। এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়ি ওঁদের। বাড়ির সামনেই কালী মন্দির। রাস্তায় দাড়িয়ে কালী দেখতাম। বেশ বড় কালো রঙের প্রতিমা, মস্ত এক লাল জ্বিভ বের করে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে। ভয় পেতাম না। ভয়ঙ্কর জিনিস প্রতিদিন দেখলে ভয় কেটে যায়। প্রতি সকালেই কে যেন ফুল দিয়ে পুজো করে যেত। ঘোষের বাড়িরই কেও হবে হয়তো। আমি কখনো দেখিনি তাকে। তবে অনেক ধরনের পুজোর ফুলের মাঝ থেকে আমি হলুদ রঙের 'মাইক ফুল' তুলে নিতাম-- চুমুক দিয়ে মাইক ফুলের মধু খেতাম। প্রতিদিন সকালে কালীঘরে হেঁটে যাওয়ার পেছনে মাইক ফুলের মধুও একটা প্রধান কারণ ছিল। কালীঘরটি পশ্চিম দিকে থাকাতে আমার ভয় করত না। মা বলত পশ্চিম দিকে কাবা ঘর, কক্ষনো পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমিও না। পশ্চিম দিকে মুখ করেই হাজাম আমাকে খাতনা দিয়ে পূর্ণ মুসলমান করেছে। তাই ছোটো বেলায় ভাবতাম পশ্চিম দিকে কোনো খারাপ বা অশুভো কিছু থাকতে পারে না।
তখনও কাফের, আস্তিক, নাস্তিক, মালু, শহীদ, গাজী, জিহাদ এই শব্দ গুলোর সৃষ্টি হয়নি। অথবা হলেও আমি শুনিনি। আমি শুধু শুনতাম আজান--- আজান পরলেই মা-খালারা মাথায় কাপড় দিত। আজানের সময়ই শুধু মা তার আঁচল আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার মাথায় দিত--- বাকি সময় ওই আঁচল আমার! সকাল বেলায় কালী মন্দিরের মাইক ফুলের মধু খেয়ে বাসায় ফিরে দেখতাম হুজুর এসে বসে আছেন। আমি তারাতারি অজু করে সুর করে পড়তে শুরু করে দিতাম: আলিফ লাম মিম----জালিকাল কিতাবু লারায়বা ফিহি হুদাল্লিল মুত্তাকিন---। হুজুর বলতেন, সবসময় পশ্চিম দিকে মুখ করে কোরান পড়বা। হুজুরের কাছে শুনতাম, কোরান পাঠের সওয়াব। হুজুর সব সময় বলতেন, 'হল্লা কইরো না, ফল্লা কইরো না'। মনে পরে না হুজুর কখনো আমাকে কালী ঘরে যেতে বারণ করেছিলেন। তবে হুজুর আমাকে 'হল্লা' করতে নিষেধ করতেন প্রতিদিন। তখনও সম্ভবত: চাপাতি আবিষ্কার হয়নি।
কালী মূর্তির অগ্নিরূপ দেখে ভয় না পেলেও, দূর্গা পূজায় অসুরের মূর্তি দেখে ভীষণ ভয় লাগত। বছরে দুটো সময় খুব আনন্দ হত: এক, ঈদ আর আরেক, দূর্গা পূজা। কারণ, ঈদ এবং দূর্গা পূজাতে স্কুল ছুটি থাকত। যে কোনো কারণে স্কুল ছুটি হলেই আমার আনন্দ হত। ঈদে যে আনন্দ পেতাম-- পূজাতেও তা ছিল সমানে সমান। প্রতি দূর্গা পূজাতেই বন্ধুরা দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে পূজামন্ডপ দেখতে বের হতাম। দূর্গা পূজার বিকেল মানেই শহর ভর্তি মানুষ আর মানুষ। আম্মা পকেটে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলত, সাবধানে যেও। সবার সাথে এক সাথে থেকো। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে এস।
ঝড়ের বেগে পূজা দেখতাম! এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপ। হাতের কর গুনে গুনে হিসেব রাখতাম কতগুলো পূজামণ্ডপ দেখা হলো। এ যেন কোনো এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে পূজা দেখা! আমার হিন্দু বন্ধুরা কেও কেও হাত জোড় করে মন্ত্র পড়ত। আমি পরতাম না। আমি অবাক হয়ে প্রতিমার বৈচিত্রতা দেখতাম, লাইটিং দেখতাম অথবা কখনো আরতি হলে তা দেখতাম। তখন কোনো ফেইসবুক ছিল না। তাই কখনো দেখতাম না যে প্রতিমার মাথা ধর থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে অথবা গনেশের স্ফিত পেট ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু মণ্ডপে আধুনিক মোটোরাইজড প্রতিমা দেখে অভিভূত হতাম। এক মণ্ডপে দেখেছিলাম অসুরের ছিন্ন মস্তিস্ক এপাশ-ওপাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে! কি ভয়ঙ্কর! মন্ডপের দায়িত্বে থাকা একজনকে জিজ্ঞাস করে জানতে পারলাম, এটা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে মা দূর্গা অসুরের গর্দান কেটে ফেলেছে। ঐবার ওই মণ্ডপ প্রথম পুরুস্কার জিতে নিয়েছিল।
তাড়াহুড়ো করে পূজা দেখে বাসায় ফিরে দেখতাম পকেটের দশ টাকা পকেটেই রয়ে গেছে, খরচ করা হয় নি! ইচ্ছে ছিল হালুয়া খাব, চিনি দিয়ে বানানো বাদামের তক্তি খাব-- কোনো কিছুই খাওয়া হয়নি। তখনও সিগেরেট খাওয়া শিখিনি। শিখলে হয়ত দশটি টাকা নিমেষেই শেষ হয়ে যেত!
আজ, অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। জানিনা আজ আমার শহরে ছোট ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে পূজা দেখতে যায় কি না। ঘোষের বাড়ির কালী ঘরটি থাকলেও, কালী মূর্তিটি যে আর নেই তা জানি। হলুদ মাইক ফুল বিলুপ্ত হয়েছে অনেক আগেই। হলুদ মাইক ফুলের মধু আর আজ কেও খায় না--- সবাই আজ মধুহীন, গন্ধহীন জিএমও ফুল হাতে অথবা খোপায় নিয়ে সেলফি তুলে। ফেইসবুকের যুগে পশ্চিম বা পূর্বে কোনো ভেদাভেদ নেই, শুভো অশুভর বালাই নেই। তবে ধর্মের ভেদাভেদ যেন প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের সময় আমরা শিখেছি 'ক' তে কলম, আর আজ শিশুরা শিখছে 'ক' তে কাফের! যাদের সামর্থ নাই স্বশরীরে মূর্তি ভাঙ্গার, তারা মূর্তি ভাংছে ফেইসবুকে!
আমার এক আরব কলিগ আছে শেফিল্ড ইউনিভার্সিটিতে। আমি যখন তাকে আমার দেশের দূর্গা পূজা উত্সবের কথা বললাম তখন তার চোখ কপালে উঠে গেল। সে বলল তাদের দেশে কেও মূর্তি পূজা করবে এটা স্বপ্নেও ভাবা যায় না! তাদের দেশে কেও মূর্তি পূজা করলে তা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়। আমি তাকে আর বললাম না যে ইদানিং আমার দেশেও মূর্তি ভাঙ্গার প্রবণতা চালু হয়েছে। ত্রিশ লক্ষ প্রানের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি তা যে কোনো একদিন আরবের মত কোনো একটা দেশে পরিণত হবে চিন্তা করেই আঁতকে উঠলাম।
খোন্দকার মেহেদী আকরাম
শেফিল্ড,
২৩ অক্টোবর ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:০৩