তখন জিলা স্কুলে পড়ি। অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উঠার সময় গণিতে মার্কস পেলাম ৩৪ (তখন পাশ মার্ক ছিল ৩৩)! স্বাভাবিক ভাবেই এসএসসি পরীক্ষার জন্য আমাকে সাইন্স দেয়া হলো না। জিলা স্কুলে কেও গণিতে ৫৫% এর নিচে নাম্বার পেলে তাকে বিজ্ঞান পড়তে দেয়া হত না। আমাকেও দেয়া হলো না। আমিও নাছরবান্দা। আব্বুকে স্কুলে পাঠালাম আমাদের গণিত স্যার, ফজল স্যারকে রিকোয়েস্ট করার জন্য, যেন আমাকে সাইন্স পড়তে দেয়া হয়। ফজল স্যার বললেন, আপনার ছেলে তো অঙ্কে ফেইল করেছে, বিজ্ঞান পড়বে কেমনে? বাসায় ফিরে আব্বু বলল, তোমার বিজ্ঞান পড়ার যোগ্যতা নেই, তুমি আর্টস পড়; দেখো একবারে এসএসসি পাশ করতে পর কিনা।
আমি কিছু বললাম না। তবে নবম শ্রেণী থেকে নিয়মিত সাইন্স ক্লাসে গিয়ে সাইন্সের ক্লাস করতে শুরু করলাম। কেউ বুঝতে পারল না। আমার আব্বু-আম্মাও কিছু টের পেল না। এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফর্ম ফিল আপ করলাম সাইন্স এ - আমার ক্লাসের শিক্ষকরাও কিছু ধরতে পারল না! এসএসসি'র টেস্ট পরীক্ষায় যখন গড়ে সব সাবজেক্ট এ ৭৫% নাম্বার নিয়ে পাশ করলাম; তখন আব্বু-আম্মার কাছে ধরা পরে গেলাম। আম্মা তারাতারি করে গণিতের একজন গৃহশিক্ষক ঠিক করে দিল। এসএসসি পরীক্ষার আগে সময় আছে মাত্র তিন মাস। খেঁটেখুটে দ্রুত বেগে সাধারণ গণিত এবং ইলেক্টিভ ম্যাথস শেষ করে ফেললাম।
এসএসসি পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগে প্রথমে হলো পক্স, তারপর হলো হাম। চোখে হাম উঠাতে এমন অবস্থা হলো যে চোখে কিছু দেখতে পারছিলাম না। ডাক্তার সম্পূর্ণ বেড-রেস্ট এ থাকতে বলল আর মাথা থেকে পরীক্ষার চিন্তা বাদ দিতে বলল। মায়ের মন আনপ্রিডেকটিবল! কোথা থেকে এক লোক ধরে বাসায় নিয়ে আসলো- সে নাকি দুই দিনেই হাম ভালো করে দিতে পারে! লোকটি আমাকে দিগম্বর করে সারা গা' জ্বিভ দিয়ে চেটে দিল। পরদিন থেকেই আমি সুস্থ্য!
পরীক্ষার আছে আর পাঁচ দিন। আমি বললাম আমি পরীক্ষা দিব! সবাই অবাক! প্রথম পরীক্ষা বাংলা। আব্বু সিক বেডে পরীক্ষার ব্যবস্থা করলো। তখনও আমি ভালো মত হাঁটতে পারি না। প্রথম পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা শুরুর আধা ঘন্টা পর লিখতে শুরু করলাম। পরীক্ষা হলে আমি, আরেকটা অসুস্থ ছাত্র, একজন ডাক্তার আর একজন শিক্ষক! কোনো রকম বাংলা পরীক্ষা শেষ করলাম। বুঝলাম পাশ করব। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। পরবর্তী পরীক্ষা গুলো আর সিক বেডে দিলাম না। সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে পরীক্ষা হলে গিয়ে একের পর এক সবগুলো পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। টেস্ট পরীক্ষার পর আম্মা কথা দিয়েছিল আমি যদি এসএসসি পরীক্ষায় ৮০০ নাম্বার নিয়ে পাশ করি তাহলে আমাকে একটি বাই সাইকেল কিনে দিবে। আম্মা রেজাল্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। আমি পরীক্ষা দিতে পেরেছি তাতেই আম্মা মহা খুশি। যেদিন সবগুলো পরীক্ষা শেষ হলো সেদিন বিকেলেই আমাকে একটি সোজা হ্যান্ডেলওয়ালা বাইসাইকেল কিনে দেয়া হলো।
কিছুদিন পর এসএসসি র রেজাল্ট বের হলো। আমি সাধারণ গণিত এবং ইলেক্টিভ ম্যাথস সহ চারটি সাবজেক্টএ লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করলাম। গণিতে পেলাম ৯০% এর বেশি মার্কস। ভূগোলে লেটার পেলাম না! তবে সর্বমোট নামার পেলাম ৮০০! ঠিক কাটায় কাটায় ৮০০। এরপরে এইচএসসি'ও পাশ করলাম ভালো ভাবেই গণিত এবং পদার্থ বিজ্ঞানে লেটারসহ ষ্টার মার্কস নিয়ে পাশ করলাম; সেখানেও গণিতে পেলাম ৯০% এর উপরে নম্বর। তার পর থেকেই আমার এগিয়ে চলা। সব সময় জিলা স্কুলের ফজল স্যারের কথা মনে পরে। উনি যে বলে ছিলেন যে আমি অঙ্কে ফেইল তাই বিজ্ঞান পড়ার যোগ্যতা আমার নেই-- এ কথাটা মনে পরে। নিজের উপর বিশ্বাস থাকাটা খুবই জরুরি। ডিটারমিনেশন, কনফিডেন্স এবং সেল্ফ-বিলিফ থাকা খুবই জরুরি! অষ্টম শ্রেণীতে এগুলো আমার ছিল---- আজও আছে।
আজ আর অঙ্কে ফেইল করার ভয় নেই। বিজ্ঞানের পড়ালেখার জগতের সকল অধ্যায় পার করে ফেলেছি। তবুও এখনো অনেকটা পথ রয়ে গেছে বাকি। পেরুতে হবে নিজের জন্যই। নিজের কাছে অনেক কথা দিয়ে রেখেছি। স্বম্বল শুধু ওগুলোই: ডিটারমিনেশন, কনফিডেন্স এবং সেল্ফ-বিলিফ। কোয়ান্টাম পদার্থের অনিশ্চয়তার এই ক্ষুদ্র জীবনে আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া; শত সমস্যায়ও আমি যেন আমার 'স্বম্বল' গুলো হারিয়ে না ফেলি।
শেফিল্ড,
২১ অক্টোবর ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:০৬