রাজন নামের ১৩ বছরের ছোট্ট ছেলেটিকে নিষ্ঠুর ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। তার অপরাধ চুরি। চুরির দায়ে নরপিশাচেরা রড দিয়ে পিটিয়ে ছেলেটির প্রতিটি হাড্ডি থেকে মজ্জা আলাদা করে ফেলল। পিশাচেরা রাজনের আর্তচিত্কার উপভোগ করলো তাদের সয়্তানি অট্টহাসিতে। দানবের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে রাজনের শেষ নিঃশ্বাসটি মিলিয়ে গেল মনুষত্বহীন অসীমতায়। আমরা মানুষেরা আজ রাজনের মৃত্যু-ভিডিও দেখি আর ক্রন্দন করি। আমরা মানুষেরা আজ প্রতিবাদ জানাই। আমরা মহান বিবৃতি দেই। আমাদের মহান ফেইসবুক স্টাটাস আমাদেরকে পৃথক করে রাজনের হত্যাকারীদের থেকে! আমরা দায় মুক্ত। শাহবাগে আমরা মানুষেরা সমবেত হই- রাজন হত্যার বিচার চাই। আর রাজন পড়ে থাকে চাপা মাটির নিচে- দূরে অখ্যাত কোনো কচুক্ষেতে। অনাহারী শৃগালগুলো হয়ত এতক্ষণে খেয়ে নিয়েছে থেঁতলে যাওয়া রাজনের প্রতিটি মাংসপেশী।
রাজন হত্যা শিশু নির্যাতনের এক নির্মম পরিহাস। বাংলাদেশে শিশু নির্যাতন নতুন কিছু নয়। আবার শিশু নির্যাতন যে শুধু চুরির মত অপরাধের দায়েই করা হয় তা নয়। যে কোনো ছোটোখাটো অপরাধেও শিশুদেরকে প্রহার করা হয় অহরহ। শাসন করা অথবা শাস্তি দেয়ার বাহানা দিয়ে এই শিশু নির্যাতন করা হয় নিয়মিত। এই নির্যাতন শুরু হয় ইস্কুল থেকেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হয় ‘প্রাতিষ্ঠানিক শিশু নির্যাতন’। মানুষেরা অবশ্য একে শিশু নির্যাতন বলতে নারাজ। তারা একে বলে শাসন। আমার কাছে অবশ্য তা' শিশু নির্যাতনই। প্রহারে কারো মৃত্যু না হলে কি তাকে নির্যাতন বলা যাবে না?
যুক্তরাজ্য সহ পৃথিবীর সকল সভ্য দেশে শিশুদের গায়ে হাত তোলা বা প্রহার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইস্কুলে কোনো শিক্ষক কোনো ছাত্রের গায়ে আঘাত করতে পারবে না। বাসায় কোনো মা-বাবা তাদের সন্তানদের গায়ে হাত তুলতে পারবে না। কারণ এ সবই উন্নত বিশ্বে শিশু নির্যাতনের আওতায় পরে।
আমার মনে আছে, আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমাদের ক্লাসের গণিতের শিক্ষক মেঘলা নামের একটি মেয়েকে স্কেল দিয়ে পিটিয়ে স্কেল ভেঙ্গে ফেলেছিল। মেঘলার অপরাধ ছিল, সে মিথ্যে কথা বলেছিল- মিথ্যে বলে ইস্কুল ফাঁকি দিয়েছিল। আমিও ওই একই ক্লাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। আমাকে আমাদের 'বাংলা আপা' এমন ভাবে প্রহার করেছিল যে আমার দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার বয়স তখন ১০ বছর। আমার অপরাধ ছিল আমি ক্লাস চলাকালীন সময় আমার সহপাঠি সাগরের সাথে কথা বলেছিলাম। দুষ্টামি করলে, পড়া না করলে, কথা না শুনলে আমাদের কে প্রহার করা হবে এটা ছিল আমাদের কাছে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। শিশু নির্যাতন প্রাইমারি ইস্কুলেই যে শেষ তা নয়। হাই ইস্কুলেও চলে শিশু নির্যাতন!
আমরা যখন জিলা ইস্কুলে ভর্তি হলাম তখন দেখা পেলাম আরেক শিশু নির্যাতনকরি শিক্ষকের। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘টাইগার স্যার’ নামে। নামেই বোঝা যায় তার কাম! পড়া না করে আসলে তিনি আমাদের প্রহার করতেন অমানুষিক ভাবে। আরেকজন শিক্ষকের নাম ছিল 'পাগলা মিজান'! নামেই বোঝা যাচ্ছে তার মানুষিক অবস্থা। পড়া না করলে পাগলা মিজান স্যার আমাদের বেত অথবা যেকোনো ধরনের লাঠি দিয়ে এমন ভাবে পেটাতেন যে গায়ে দাগ বসে যেত। এ ধরনের শিক্ষকগণ সায়কলোজিকেলি যে এমন ডিস্টার্ব তা তখন বুঝতাম না। তখন ভাবতাম, আমরা পড়া না করে অপরাধ করেছি তাই এই শাস্তি। এখন বড় হয়ে বুঝি ওই শাস্তি ছিল শিশু নির্যাতনের এক টিপিক্যাল রূপ।
শিশু নির্যাতনকে অতি স্বাভাবিক একটা ঘটনা জেনেই জাতি হিসেবে আমরা বেড়ে উঠছি। আমাদের সমাজে ‘শিশু নির্যাতন’ আর ‘শাসন’ এর মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। এই রকম একটা সমাজে রাজনের মত ১৩ বছরের ছেলেটি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে নির্মম ভাবে মারা যাবে, এটাই তো স্বভাবিক।
এক রাজন হত্যার বিচার চেয়ে আগামী দিনের আরেক রাজন হত্যা বন্ধ করা যাবে না। রাজন হত্যা বন্ধ করার জন্য দরকার গোটা সমাজ থেকে 'শিশু নির্যাতনের' কালচারটাকে সমূলে উপড়ে ফেলা।
তাই, আসুন আজ আমরা সবাই এক সাথে শপথ নেই- শাহবাগে গিয়ে নয়, নিজের ঘরে বসেই। আজ থেকে আমরা আমাদের কাজের ছেলে বা মেয়ের গায়ে হাত দিব না। আমরা আমাদের সন্তানদের প্রহার করব না। যেসব শিক্ষক ইস্কুলে ছাত্রদের কে শাসনের নামে প্রহার করবে তাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। আজ থেকে বন্ধ হউক সকল রকম প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শিশু নির্যাতন।
রাজন হত্যাকারীদের ধরে অতিদ্রুত বিচার করা হউক। বিচারের রায় একটিই। মৃত্যুদন্ড।
খোন্দকার মেহেদী আকরাম,
শেফিল্ড,
১৪ জুলাই ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:৩৩