বাসে করে এইমাত্র নাটোর থেকে ঢাকার গাবতলীতে এসে পৌছাল মনির। রাত প্রায় এগারটা বাজে। পরদিন তার একটা ইন্টারভিউ আছে। চন্দ্রাতে বেশ বড়সড় জ্যাম লেগেছিল। সেজন্য বেশ রাতই হয়ে গেল। তার এক মামা থাকেন তেজতুরীবাজার। ওখানেই রাতে থাকবে সে। আগেই ফোনে কথা হয়েছে। মামা বলে দিয়েছেন, বেশী রাত হলে সিএনজি নেয়ার দরকার নেই। কারণ সিএনজিগুলো রাতে ছিনতাইকারীদের বাহনে পরিণত হয়।
বাস থেকে নেমে সে দেখল অনেকগুলো সিএনজি সেখানে। মানুষজন দরদাম করে সিএনজিতে উঠছেও। মনির সেদিকে না গিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল। সেখানে কয়েকটি ৮ নম্বর বাস দাঁড়িয়ে আছে। হেলপারেরা সমস্বরে ডাকছে, “আসেন, ফার্মগেট মতিঝিল সায়দাবাদ”। মনির আগেও তার মামার বাসায় গিয়েছে। সে জানে, ৮ নম্বর বাসে করে ফার্মগেট গিয়ে নামলে খুব সহজেই সে তার মামার বাসায় চলে যেতে পারবে।
বাসগুলো প্রায় খালি। উঠবার পর ছাড়তে কতক্ষণ লাগে কে জানে। একটা বাসে মোটামুটি প্যাসেঞ্জার আছে। ১০-১২ জন হবে। ঐ বাসটাতে উঠল মনির। সাথে সাথেই বাস ছেড়ে দিল। বেশ দ্রুতগতিতেই বাস চলছে। কন্ডাক্টর এসে জিজ্ঞেস করল, “কই যাইবেন?” মনির বলল, “ফার্মগেট”। সে আর ভাড়া টাড়া চাইল না।
বাসের যাত্রীদেরকে তেমন সুবিধার মনে হল না মনিরের কাছে। কেমন যেন নেশাখোর টাইপের মনে হচ্ছে। মনিরের একটু খটকা লাগল। খটকা আরো বাড়ল, যখন বাস টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী কোন জায়গা থেকেই প্যাসেঞ্জার উঠাল না। শ্যামলী শিশুমেলার দিকে এসে বাস যখন আসাদগেটের দিকে না গিয়ে আগারগাওয়ের দিকে অন্য রুটে চলতে শুরু করল, তখন মনিরের আর বুঝতে বাকি থাকল না, কি ঘটতে যাচ্ছে।
আগারগাওয়ের রাস্তায় ঢুকেই বাসে গতি কমে গেল। কন্ডাক্টর এসে বলল, “ভাড়া দেন”। মনির মানিব্যাগ বের করল। কন্ডাক্টর মানিব্যাগ জোর করে মানিব্যাগ নিয়ে নিল। মনির বলল, “মানিব্যাগ নিলা কেন? দেও”। কন্ডাক্টর বলল, “হালা, ভাড়া দিবি না ক্যান”। অন্য যাত্রীরা সব দৌড়ে আসল। একজন চিৎকার করে বলল, “ধর শালারে, ভাড়া না দিয়া যাইব কোথায়”।
মনির বুঝতে পারল, যাত্রী সে আসলে একাই ছিল। বাকিরা সব ছিনতাইকারী। সবাই মিলে মনিরকে মুহুর্তেই ধরাশায়ী করে ফেলল। টাকা-পয়সা, মোবাইল, চশমা সব নিয়ে নিল। তার সাথের ব্যাগও ঘাটাঘাটি করতে লাগল। একজন বলল, “হালায় ফকিরের পুত, কিছুই নাই”।
একজন এসে মনিরের চোখে কি যেন লাগাল। চোখ প্রচন্ড জ্বালা করে উঠল। মনির ব্যাথায় চিৎকার করে উঠল। একজন বলল, “ঐ হালা, চিল্লাইলে একদম কল্লা নামায় দিমু, এইটা দেখসস?”। আরো কয়েকজন এসে চোখে মলম আর মরিচের গুড়া লাগাতে লাগল। মনির তখন আকুতি করছে, “ভাই, ছাইড়া দেন, ভাই, দয়া করেন”।
ওদের কি আর দয়া হয়? বরং একজন বলল, “হালায় তো এখনও পিটপিট কইরা চাইতাছে, কি মলম লাগাইলি?”, বলে আরেক দফা মলম চলল। সামনে থেকে ড্রাইভার বলছে, “চালু কর তোরা, এক কাস্টোমারেই তো রাইত কাবাইর কইরা দিতাছস”। মনিরের বাম পাশ থেকে একজন বলল, “হালায় ফকিরের পুত, লস হইয়া গেল”। পিছন থেকে একজন বলল, “হালার ছিনতাই কইরা পুষায়না, কয়ডা পয়সাই পাই। ওস্তাদ, চান্দার বিজনিজে লাইন দেন, গ্যাঞ্জাম কম, পয়সাও বেশী”। ড্রাইভার অর্থাৎ ওদের ওস্তাদ বলল, “হ, চান্দা লইয়া বইয়া আছে আর কি”।
কম গতিতে চলা অবস্থায় মনিরকে ওরা চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিল। আর সাথে সাথেই পগারপাড়। মনির তখন চিল্লাচ্ছে, “কেউ আছেন নাকি ভাই, আছেন নাকি কেউ?” কোন সাড়াশব্দ নাই। প্রায় ঘন্টাখানিক পরে এক রিক্সাওয়ালা দয়াপরায়শ হয়ে তাকে তার মামার বাসায় পৌছে দিল। সেই সাথে মামার কাছ থেকে মোটা অংকের বকশিসও আদায় করে ছাড়ল।
মনিরের আর ইন্টারভিউ দেয়া হয় নি। ১ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। চোখের নানারকম টেস্ট করতে হয়েছিল। আর এই দুঃস্বপ্ন তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে প্রতিদিন।
আর দশটা ছিনতাইয়ের মত, এই ঘটনাতেও কোন মামলা হয় নি। মলম পার্টির উপদ্রবের কথা তাই পুলিশের নথিতে নেই, মন্ত্রীদের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করা হয়, সেখানেও নেই। শুধু আছে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
[আমার ভাইয়ের বন্ধুর এক আত্মীয়ের ঘটনা এটি এবং আরো অনেকের, আমাদের আগোচরেই যা ঘটছে।]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ৮:০১