গত তিন দিন একটানা তুষাড়পাত। পুরো সাপ্পোরো শহর ভারী তুষাড়শুভ্র হয়ে উঠেছে। সকাল থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টিজল রাস্তার ছোট ছোট বরফ স্তুপ গুলোকে কেমন করে ভাঙতে শুরু করেছে। তিন দিন ধরেই সোনালী ঘরে অদ্ভুতুড়ে জীবন পার করছে। জাপানের আকাশে বাংলাদেশের মতো রিমঝিম বৃষ্টি নেই। এখানকার বৃষ্টির আলাদা ভাষা। সোনালীর বর চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। পদার্থ বিজ্ঞানে সে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করলেও ব্যক্তি মানুষ হিসেবে ভীষন অপদার্থ প্রকৃতির। সেচ্ছাচারিতা আর স্বার্থপরতা যেন ভদ্রলোকের সাধারন স্বভাব । বিয়ের পর পরই সোনালী কে নিজের চেনা জগৎ ছেড়ে বরের সাথে এই বিচ্ছিন্ন হোক্কাইডো দ্বীপে চলে আসতে হয়েছিল। বরের উপর নির্ভরশীল জীবন নিজের চিন্তাজগত কে অসহায় করে তুলেছে। নিজের বারান্দা থেকে দেখা রাস্তার গলে যাওয়া তুষাড় গুলো মন টাকে সিক্তা করে তুললো। গল্প টা ঠিক এমন হওয়ার কথা ছিল না। সোনালীর প্রতিটি অনুভুতির মুল্য দিবে। মাস শুরুতেই হাত খরচ দিবে। সোনালীর উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করবে। মিথ্যা সীমাহীন অজস্র প্রতিশ্রুতির দৃশ্যগুলো সোনালী কে আঘাত করতে লাগলো। নিজের ভিতরের স্বপ্ন গুলো অসহায় হয়ে উঠলো। সারাদিনের দুঃখ শোনার ও কেউ নেই। নিঃসঙগতা যেন গলা চিপে ধরছে। এমন সময় মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। জাপানি বান্ধবী আরিসার নাম ভাসছে। আরিসা ভাল ইংরেজী পারে। তিন বার সোনার মেডেল পেয়েছে আর্চারি প্রতিযোগিতায়। সোনালীর একা একা দিন গুলোতে আরিসা যেন এক চিলতে সুখ। আরিসা হলো সোনালীদের জাপানি বাড়িওয়ালার ভাইয়ের মেয়ে। ভিন দেশী দেখলে জাপানিরা খুব আন্তরিকতা নিয়ে সাহায্য করে। আরিসা অবসরে ফোন করে জানালো মারুয়ামা পাহাড়ের যে ক্যাফেতে পার্ট টাইম কাজ করে সেখানে আজকে জাপানি ট্রাডিশনাল অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু সেখানে একা যেতে পারেনা। রাস্তা আর সাবওয়ে ঠিক ভাবে চিনে না। সব সময় সে আরিসার সাথে গিয়েছে। আজকে আরিসা খুব ব্যস্ত
আজকে ক্যাফেতে গান গাইতে হবে
জাপানি মিউজিক ইন্সট্রুমেনট সুর তুলতে হবে। সোনালী কে সে গুগল ম্যাপ থেকে লোকেশন দিয়ে ঠিকানা ফেসবুকে দিল। বিকেলের দিকে একটু তুষাড়পাত কমলো। প্রায় আধা ঘণ্টার রাস্তা যেন দশ মিনিটে এল। সাবওয়ে থেকে নেমে গেট দিয়ে বের হয়ে যেন অন্য পৃথিবী দেখলো। হয়তো কোন মেলা হচেছে। বুকের ভিতরটা নড়ে উঠলো। চারপাশের মানুষ গুলোর চেহারা ঠিক জাপানিদের মতো নয়। সে কি কোন ভুল করেছে? অন্যকোন জায়গায় চলে এসেছে? অনেক ভাবনা মনের ভিতর ঘুরপাক করছিল। এমন সময় আরিসা এলো। দুজনে ক্যাফেতে ঢুকার পর আরিসা জানাল তাকে গানের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই ক্যাফের ভিতরে গেল।সেদিনের সব অনুষ্ঠান সোনালী দেখল। ক্যাফের নাম "মেঘ ভাসে নীল আকাশে "। এই ক্যাফে সব ক্যাফের মতো সাধারন নয়। এখানে অনেক গানের শিল্পীরা আসে তাদের গান পরিবেশন করতে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। আরিসা ভিতর থেকে আর বের হলো না। সোনালী কে বাসায় ফিরতে হবে। পরিচিত ম্যানেজার কে আরিসার কথা জিজ্ঞেস করাতেই সে কপাল কুচকালো। আরিসা! সে তো দুই মাস হলো কিউশু দ্বীপে দাদীর কাছে যাওয়ার পর প্রিয় দাদীর ক্যানসারে মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। সোনালীর বুকের ভিতরটা আতংকে মোচর দিয়ে উঠলো। মাথাটা চক্কর দিল। তবে আজকে সারাদিন যা কিছু ঘটেছে সব কি মিথ্যা? আরিসা নেই সে জানতো না। তবে কে যোগাযোগ করলো। মোবাইলে কল চেক করে দেখলো আরিসা কোন ফোন নেই। ভয়ে সোনালীর হাত পা কাপতে লাগলো। খুব দ্রুত সে বাসায় ফিরে এলো। গভীর বন্ধুত্ব হয়তো মানুষের অনুভুতিতে মিশে থাকে। জীবনের হিসাব বরাবর ব্যাখাহীন। নিজের চারপাশে ঘটনাগুলো বিশ্বাস না হলেও আরিসার জন্য খারাপ লাগতে শুরু করলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ বিকাল ৫:২০