খোশ আমদেদ মাহে রমজান। বাংলাদেশের আকাশে পবিত্র রমজান মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ফলে আগামীকাল বুধবার থেকে মাসব্যাপী শুরু হচ্ছে সিয়াম সাধনা। মঙ্গঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) ইসলামী ফাউন্ডেশনের গণসংযোগ কর্মকর্তা শায়লা শারমিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। পবিত্র রমজানের চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে শুরু হলো পবিত্র রমজান মাসের শুভ সূচনা। নতুন চাঁদ দেখলে বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া পড়তেন। উচ্চারণঃ আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস্সালামাতি ওয়াল ইসলামি ওয়াত্তাওফিকি লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।
অর্থ: আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদয় কর। আর তুমি যা ভালোবাস এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও, সেটাই আমাদের তাওফিক দাও। আল্লাহ তোমাদের এবং আমাদের প্রতিপালক’। (তিরমিজি, মিশকাত) শুধুমাত্র রমজান মাসের নতুন চাঁদ দেখেই যে এ দোয়া পড়তে হবে এমন নয়, বরং প্রত্যেক মাসের নতুন চাঁদ দেখলে এ দোয়া পড়া প্রিয় নবীর (সা.) সুন্নত। রমজান মাস ‘রহমতের সওগাত’। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের বাণী নিয়ে বিশ্বের মুসলমানদের দুয়ারে আবারও উপস্থিত হয়েছে পবিত্র রমজান বিশ্ব মুসলিমের কাছে সবচেয়ে মর্যদাপূর্ণ একটি মাস। এ মাসেই মহান আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব মানবতার মুক্তি পথনির্দেশক হিসেবে নাযিল করেছেন আল কুরআন। কুরআন হলো মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো সর্বশেষ হেদায়াতের গ্রন্থ। কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য আর কোনো আসমানী কিতাব আসবে না। আর তাই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষকে সুন্দরভাবে তার জীবন চালাবার জন্য যা দরকার তার সবই আল্লাহ কুরআনে বলে দিয়েছেন। কুরআন নাযিলের কারণে এ মাসের এতো মর্যাদা। হাদিসে এ মাসকে ‘শাহরুল আযিম’ ‘শাহরুম মুবারাকাত’ বলা হয়েছে। যা মানুষের মধ্যে ধর্মভীরুতা সৃষ্টি করে। আগামীকাল বুধবার ১লা রমজান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইসলাম যে পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তার একটি হল সিয়াম পালন। এ সিয়াম জান্নাত লাভের একটি মাধ্যম ; যেমন হাদীসে এসেছে যে, 'আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল, সিয়াম পালন করল রমযান মাসে, আল্লাহ তা‘আলার কর্তব্য হল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো'…। (বুখারী)
একজন মানুষকে গুনাহ মুক্ত করে মুত্তাকী তথা খোদাভীরু-পরহেযগার ও আল্লাহর ওলী বানানোর জন্যই আগমন এই রমযান মাসের। কুরআন কারীমের অনেক আয়াত ও অসংখ্য হাদীসে এই মাসের গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা বর্ণিত আছে। স্বয়ং নবী কারীম (সঃ) রজব ও শা’বান তথা রমযানের দুই মাস আগে থেকে রমযান পর্যন্ত হায়াত বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে দু’আ করতেন। কুরআন কারীমসহ অন্যান্য আসমানী কিতাব আল্লাহ তা’য়ালা এই রমযান মাসে নাযিল করে এই মাসের গুরুত্ব ও ফযীলত আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, "রমযান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।" (সূরা বাকারা : ১৮৪)
এই মাসেই আগমন ঘটে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম ও মর্যাদাপূর্ণ লইলাতুল ক্বদর বা সৌভাগ্যেও রজনীর। প্রকৃতপক্ষে ইহা আল্লহ তা’য়ালার পক্ষ হতে তাঁর বান্দাদেও উপর অর্পিত মহান এক দান ও বিধান। যা বন্দা ও মাওলার মাঝে মহব্বত-ভালোবাসার নিদর্শন ও সেতুবন্ধন। আল্লাহ খালেছ বান্দা-বান্দীরা তা পালন করে এক অতুলনীয় স্বাদ গ্রহণ করেন।
একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক, সুস্থ্য ও জ্ঞাণসম্পন্ন ব্যক্তির উপর রমজানের রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন করা হয়েছিলো তার পূর্ববর্তীদের উপর। আল্লাহ ত’য়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ” হে ঈমানদারগণ, তোমাদেও উপর রোযা ফরয করা করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদেন পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার” (সূরা আল-বাকারাহঃ আয়াতঃ ১৮৩) অপর দিকে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্যমতে ইলমুল হাল তথা প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও ফরজ। সে অনুযায়ী রমযানের রোযা সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল জানা প্রত্যেক রোযাদারের জন্য জরুরী বা আবশ্যকীয়।
রমযান মাস হলো আল্লাহ তা’আলার দয়া ও অনুগ্রহের মাস। এ মাস বন্দার গুনাহ-খাতা ও দোযখ হতে মুক্তির মাস। ছবর ও ধৈর্য়ের মাস। এ মাসে একটি কাজ অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান। একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরেেজর সমান। হাদীস শরীফে এ মাসের অনেক গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা বর্ণিত আছে। যেমনঃ
১। হুজুর (সঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তষ্টি অর্জনের জন্য রমযানের রোযা রাখবে, আল্লাহ তা’য়ালা তার পূর্বের সমস্ত (ছগীরাহ) গুনাহ মাফ করি দিবেন। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ১৯০১)
২। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন যে, রোযাদারের মুখের দূগন্ধ আমার নিকট মেসক তথা মৃগনাভীর চেয়েও বেশী প্রিয়।
৩। হুজুর (সঃ) ইরশাদ করেছেন যে, জান্নাতের মোট আটটি দরজা আছে, তার মধ্যে একটি দরজার নাম হচ্ছে ’রইয়ান’, সে দরজা দিয়ে রোযাদার ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারবেনা। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৩২৫৭)
৪। হুজুর (সঃ) বলেন, রমযান আগিমন কালে আসমানের দরজাসমূহ ও জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ১৮৯৯)
হুজুরে আকরাম (সঃ) বলেন, পবিত্র রমযান উপলক্ষে আমার উম্মতকে পাঁচটি বস্তু দেয়া হয়েছে যা পূর্ববর্তী উম্মতগণকে দেওয়া হয়নি। যথাঃ
১। রোযাদারের মুখের ঘ্রাণ আল্লাহর নিকট মৃগনাভী হতেও বেশী।
২। ফেরেশতারা রোযাদারদের জন্য ইফতার পর্যন্ত দু’য়া করতে থাকে।
৩। জান্নাত রোযাদারদের জন্য প্রতিদিন সজ্জিত করা হয় এবং আল্লাহ ত’য়ালা বলেন, আমার বান্দাগণ দুনিয়ার ক্লেশ যাতনা দুরে নিক্ষেপ করে অতি তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসছে।
৪। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রমযান মাসের প্রথম রজনির যখন আগমন ঘটে তখন শয়তান ও অসৎ জিনগুলোকে বন্দি করা হয়। যার ফলে সে ওই সব পাপ করতে পারেনা যা অন্য মাসে করতে পারতো। এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়, এ মাসে আর তা খোলা হয় না। জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, এ মাসে তা আর বন্ধ করা হয় না। প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে ঘোষণা দিতে থাকে যে, হে সৎকর্মের অনুসন্ধানকারী তুমি অগ্রসর হও ! হে অসৎ কাজের অনুসন্ধানকারী তুমি থেমে যাও ! এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। (তিরমিযী)
৫। রমযানের শেষ রাতে রোযাদারের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। ছাহাবারা আরয করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই ক্ষমা কি শবে কদরে হয়ে থাকে? হুজুর (সঃ) বলেন, না, বরং নিয়ম হচ্ছে শ্রমিক তার শ্রম শেষে পারিশ্রমিকপায়। (সুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৭৯০৪)
হাদীস শরীফে রমযান মাসে ৪টি দোয়া বেশী বেশী করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে যেমনঃ
১। বেশি বেশি কালিমা তাইয়্যিবা পড়া,
২। বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া,
৩। বেশি বেশি বেহেশত কামনা করা
৪। বেশি বেশি জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া।
কালিমা তাইয়্যিবা পড়াঃ হাদীস শরীফে আছে কালিমা তাইয়্যিবকে সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির বলা হয়েছে। হযরত উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সঃ) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ এর স্বাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ তা’য়ালা তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিবেন। ( আল মুর্জামুল কাবীর, হাদীস নং ৫০৭৪)
বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়াঃ অর্থাৎ মহান আল্লাহ তা’য়ালার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) তাঁর উম্মতদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতি দিন একশত বার ইস্তেগফার পড়তেন। তাই সব সময় বেশি বেশি বিশেষ করে রমযানে বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়া আবশ্যক।
বেশি বেশি বেহেশত কামনা করাঃ অর্থাৎ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে বেশি বেশি জান্নাতের জন্য দরখাস্ত করা আবশ্যক। যেমন হে আল্লাহ আমরা আপনার কাছে জান্নাত চাই। এবং
জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়াঃ অর্থৎ জাহান্নামের ভয়াবহতার প্রতি খেয়াল করে জাহান্নাম হতে মুক্তি কামনা করা। যেমন হে আলালাহ আমরা আপনার নিকট জাহান্ন্মা হতে মুক্তি চাই। (ছহীহ ইবনে খুযায়মা, হদিস নং ১৮৮৭)
আমরা উপরোক্ত চারটি আমল এভাবে করতে পারিঃ
লাইলাহা, অস্তাগফিরুল্লাহ, আল্লাহুমা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা, ওয়া নাউজু বিকা মিনান্নার
মহান আল্লাহ পাক আমাদের কঠিন উপবাসব্রত পালনকে তার রেজামন্দি হাসিলের এবং আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণের জন্য কবুল করে নিন আর এ মাসে দিনভর সিয়াম ও রাতভর ইবাদত রিয়াজতের বিনিময়ে বিশ্ব সমাজে শান্তি দান করুন। আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে তাঁর খালেছ বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন। আমীন
সূত্রঃ
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
ব্রেকিং নিউজ২৪.কম ফেসবুক-১ ফেসবুক-২
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৪:২৫