ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্য প্রতি দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ। এটি মহান আল্লাহর নির্দেশ। এ বিধান লঙ্ঘনে রয়েছে কঠোর শাস্তির ঘোষণা। মুসলমানরা পরকালের উপকারের কথা ভেবে তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে বেহেশতে যাওয়ার জন্যই নামাজ পড়ে। তাইতো আল্লাহ তাআলা মানুষকে সার্বিকভাবে উজ্জীবিত করতে নামাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। আর তা না পড়লে শাস্তির বিধানও রেখেছেন। কর্মক্ষম উজ্জীবিত মানসিকতা লাভে নামাজ আল্লাহর এক মহা নেয়ামত। বান্দার জন্য অন্যতম রহমতও বটে। এ নামাজ আদায় থেকে পাওয়া যায় ইহকালেও নানাবিধ উপকার। যেমন—পরিচ্ছন্নতা, সামাজিকতা, ব্যায়াম ইত্যাদি। নামাজ পড়লে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অনেক উপকার সাধিত হয়। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য নামাজ এক কার্যকরী টনিক। ওজু থেকে শুরু করে নামাজ আদায় সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কাজই মানুষের সুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এবার নামাজ আদায়ে শারীরিক ও মানসিক উপকারিতার কথা উঠে এসেছে বিজ্ঞানের গবেষণায়। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিংহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে সুস্থ থাকা যায়। নামাজ পড়ার মাধ্যমে মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পারে। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, ‘যদি নিয়মিতভাবে নামাজ পড়া হয় তবে বেক পেইন তথা পিঠের ব্যথা কমে যায়। নিস্তেজ ও ঝিম ধরা শরীরে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক হয়। নামাজ পড়ার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদকম্পনও কমে যায়। যা মানুষের পেশীকে শিথিল করতে সাহায্য করে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, ‘যদি কেউ (যথাযথভাবে) রুকু করতে পারে তাহলে তার পিঠে ব্যথা থাকবে না, রুকুতে গেলে মানুষের পিঠ সমান্তরাল হয়। কিছু সময় পিঠ সমান থাকে। নিম্নে এ বিষয়ে বর্ণনা করা হলোঃ
পরিচ্ছন্নতাঃ নামাজ পড়ার আগে অজু করতে হয়। অজু ছাড়া নামাজ হয় না। অজু হচ্ছে নামাজের প্রস্তুতি। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা যখন নামাজের জন্য প্রস্তুত হবে তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নেবে এবং তোমাদের মাথা হাত দিয়ে মুছে নেবে (মাসেহ করবে) এবং দুই পা গোড়ালি পর্যন্ত ধুয়ে নেবে।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৬)
শুধু যে নামাজের জন্য অজু তথা হাত-পা ইত্যাদি ধুতে হয় তা নয়, গড়গড়া করে কুলিও করতে হয় এবং নাকের ভেতরে পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। এছাড়া শরীর, নামাজের স্থান ও পোশাক পাক-পবিত্র হতে হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের জন্য মুসলমানদের সারা দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়।
সামাজিকতাঃ নামাজের সময় মুসলমানরা নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যায়। ফলে পরস্পর দেখাশোনা, খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ হয়। তাই তাদের মধ্যে একতা, মমতা, সহমর্মিতা বাড়ে। জামাতে দাঁড়ানোর সময় গরিব-ধনী, আমির-ফকিরের কোনো ভেদাভেদ থাকে না।
আল্লাহর সাহায্যঃ নামাজ পড়ার মাধ্যমে দুনিয়াবি বহু সমস্যা সমাধান হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে (আল্লাহর কাছে) সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৫৩)
সময়ানুবর্তিতা : কোরআন শরিফে বলা হয়েছে, ‘নির্ধারিত সময়ে নামাজ পড়া মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০৩)। একজন মুমিন ব্যক্তিকে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঁচটি নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হয়। ফলে সে সময়ের প্রতি সচেতন হয় এবং সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। এভাবে সে সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা পায়, যা তাকে জীবনের সব কাজে সময়নিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল করে তোলে।
মনের প্রশান্তিঃ কোরআনে এসেছে, ‘যারা ঈমান আনে আল্লাহর ওপর এবং তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে (জিকিরে) প্রশান্ত হয়, জেনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)
আর নামাজের দ্বারা মুমিন ব্যক্তির মন সর্বাধিক প্রশান্ত হয় এবং সে মানসিকভাবে শান্তিতে থাকে।
বিপদে অবিচল থাকা : নামাজ আদায়কারী বিপদ-আপদে অবিচল থাকে। সে কোনো কাজে বা বিষয়ে বিরূপ অবস্থায় পতিত হলে হতাশায় ভেঙে পড়ে না। কোরআনে এসেছে, ‘মানুষ তো স্বভাবতই বড়ই অস্থিরচিত্ত। সে বিপদে পড়লে হা-হুতাশ করতে থাকে। আর যখন কল্যাণপ্রাপ্ত হয় তখন কৃপণ হয়ে পড়ে। তবে তারা নয়, যারা নামাজ আদায়কারী, যারা তাদের নামাজে নিরন্তর নিষ্ঠাবান।’ (সুরা : মাআরিজ, আয়াত : ১৯-২৩) অর্থাৎ যথাযথভাবে নামাজ আদায়কারী বিপদে অবিচল থাকতে পারে।
ব্যায়ামঃ নামাজের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক উভয় ব্যায়ামই সাধিত হয়। নামাজের দ্বারা শরীরের সব অঙ্গের নড়াচড়ার ফলে এগুলো সচল থাকে এবং স্বাস্থ্য রক্ষিত হয়। নামাজের মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় বিধায় নামাজিদের হৃদয় প্রশান্ত থাকে। তাই নামাজিদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং তারা মানসিক অসুখসমূহ যেমন- হতাশা, বিষণ্নতা, অস্থিরতা, অহেতুক ভয় ইত্যাদি থেকে নিরাপদ থাকে। নামাজ শরীরের জোড়াগুলোকে (Joint) শক্ত হয়ে অচল হয়ে যাওয়া রোগ (Paralysis)থেকে রক্ষা করে। নামাজের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে রুকুতে ও সিজদাতে যাওয়া-আসার এবং রুকু ও সিজদায় কিছুক্ষণ অবস্থানের কারণে কোমর ও পিঠের সংশ্লিষ্ট হাড়ের জোড়াগুলো শক্ত হতে পারে না। ফলে সেগুলোরও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা বজায় থাকে। এখন নামাজের বিভিন্ন অবস্থায় যেসব ব্যায়াম সাধিত হয় এবং এর দ্বারা যেসব উপকার পাওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হলোঃ
(১) তাকবিরে তাহরিমাঃ ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নামাজে যখন হাত দুটো কান পর্যন্ত ওঠানো হয় এবং এরপর হাত বাধার জন্য নামানো হয় তখন বাহুদ্বয়ের ব্যায়াম হয়ে যায়। এছাড়া কনুইয়ের সামনে যে অঙ্গগুলো এবং কাঁধের জোড়ার যে অঙ্গগুলো এ নিয়ত বাধার সময় ব্যবহৃত হয় সেগুলোরও এর সঙ্গে ব্যায়াম হয়ে যায়।
(২) দাঁড়ানো (কিয়াম)ঃ নামাজে দাঁড়ানোর সময় মেরুদণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে দাঁড়াতে হয়। এটা মেরুদণ্ডকে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।
(৩) হাত বাধাঃ নামাজে দাঁড়ানো অবস্থায় হাত বাধার সময় কনুইয়ের আগে-পিছে থাকা পেশি এবং বগলের পেছনের পেশির ব্যায়াম হয়ে যায়। নামাজে বাঁ হাত নিচে পেটের ওপর রাখা হয় এবং এর ওপর ডান হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রাখা হয়। এর ফলে হাতের তালু, আঙুল ও কবজির ব্যায়াম হয়।
(৪) রুকুঃ দুই হাঁটুর ওপর হাত রেখে কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত সামনে ঝোঁকানো অবস্থাকে রুকু বলা হয়। এখানে মাথাকে এমনভাবে ঝোঁকাতে হয়, যাতে কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত শরীর মেঝের সমান্তরাল থাকে। এ নড়াচড়ায় শরীরের সংশ্লিষ্ট পেশিগুলোর ব্যায়াম হয়ে যায়। রুকু দ্বারা মূত্রাশয়ের উপকার হয় এবং চোখের প্রান্তে ও মস্তিষ্কে রক্ত পরিসঞ্চালন বৃদ্ধির ফলে চোখের ও মস্তিষ্কের উপকার হয়।
(৫) সিজদাঃ সিজদার সময় মাথা হার্ট থেকে নিচু অবস্থায় থাকে। এতে মাথায় রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। সিজদা যত দীর্ঘ সময় হয় তত বেশি রক্ত মস্তিষ্কে ও মুখমণ্ডলে প্রবাহিত হয়। এর ফলে নামাজি ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং মুখের চেহারার ওপর সতেজতা থাকে। সিজদার ফলে হাত, পা, কোমর ও পিঠের ব্যায়াম হয়। সিজদার দ্বারা পেট, পেটের নিচের অংশের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া হয় ও রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য, বদহজম ইত্যাদি রোগেরও উপকার হয়।
(৬) বৈঠকঃ নামাজের বৈঠক অবস্থায় হাঁটু ও নিতম্বের ওপর চাপ পড়ে, বিশেষ করে চাপ পড়ে পায়ের গোড়ালির ওপর। এভাবে এ অঙ্গগুলোর ব্যায়াম হয়ে যায়।
(৭) সালাম ফেরানোঃ নামাজ শেষে বসা অবস্থায় ডান ও বাঁ দিকে সালাম ফেরানো হয়। এতে শরীরের শুধু মাথা ও ঘাড় ডান দিকে ও বাঁ দিকে ফেরানো হয়। এটা ঘাড়ের উত্তম ব্যায়াম, যা নামাজের মাধ্যমে সাধিত হয়। মূল কথা হলো, নামাজের দ্বারা আত্মিক উন্নতি হয়। নামাজের মাধ্যমে একজন মুসলমান নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে। এই আত্মসমর্পণের ফলে আত্মিক দিক দিয়ে সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর ধ্যানে তার মন প্রশান্ত হয়। এভাবে পরকালের পাশাপাশি ইহকালেও নামাজ বহুমুখী কল্যাণ বয়ে আনে।
উপসংহারঃ বিশ্বের প্রায় ১৮০ কোটি মুসলিমের বসবাস। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নামাজ আদায় করা আল্লাহর নির্দেশ ও ফরজ ইবাদত। যা মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন রাখে। দুনিয়াবী উপকার থাক বা না থাক – “আল্লাহর বিধান” এটা জানাই যথেষ্ট।আল্লাহর বিধান আমরা মানবোই। কারণ এর দুনিয়াবী উপকার থাকুক বা না থাকুক আল্লাহ আখিরাতে অবশ্যই এর প্রতিদান আমাদেরকে দেবেন। আখিরাতের প্রতিদানই সর্বোত্তম। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) হচ্ছেন ঈমান ও অনুসরণের ক্ষেত্রে এই উম্মতের মধ্যে উত্তম আদর্শ। তাঁরা আল্লাহর বিধানগুলোর ক্ষেত্রে দুনিয়াবী উপকার খোঁজেননি। কোনো হুকুম সামনে এলেই তারা বলেছেনঃ “...তারা [ঈমানদারেরা] বলে, “আমরা শুনলাম ও মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই নিকট ক্ষমা চাই, আর আপনারই দিকে চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন।” সুতরাং নামাজের ব্যাপারে অবহেলা নয়, শাস্তির ভয়ে নামাজ আদায় নয়, বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা লাভে নামাজ পড়া আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামাজের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি ও শারীরিক-মানসিক প্রশান্তি ও উপকারিতা লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৯:২৪