somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আষাঢ়ে গল্প- ৬ঃ কুঁড়ে জোলা যখন গণক ঠাকুর !

১৮ ই নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১। আষাঢ়ে গল্প - ১ ! ঘটকালি !!
২। আষাঢ়ে গল্প - ২ ! কাঁঠাল খাওয়ার বাজি !
৩। আষাঢ়ে গল্প - ৩ "তিন বোকার গল্প"
৪। আষাঢ়ে গল্প- ৪ , বোকা রাজ্যের বোকা রাজা
৫। আষাঢ়ে গল্প-৫, দৈত্য ও নাপিত
আষাঢ়ে মানে অদ্ভুত, মিথ্যা, অলীক। আষাঢ় মাসের অলস মুহূর্তের গল্পের আসর থেকেই আমাদের দেশে ‘আষাঢ়ে গল্প’ প্রবাদটির সৃষ্টি হয়েছে এমনটা মনে করা হয়। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা অভিধানে ‘আজাইড়া’, ‘আজাড়া’ (আজাড়ে অর্থ অবিশ্বাস্য), অদ্ভুত, অমূলক, অহেতুক ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার আছে। ফারসি অভিধান অনুসারে ‘আযার’ বা ‘আজার’ শব্দ থেকে ‘আজুরে’ বা আজাড়ে শব্দ এসেছে। আর এই আজাড়ে গল্প থেকেই ‘আষাঢ়ে গল্প’ কথাটির সৃষ্টি। সামুর পাঠকের জন্য আজ আষাঢ়ে গল্প সিরিজের ৬ষ্ঠ গল্প কুঁড়ে জোলা যখন গণক ঠাকুর


রুপকথার রাজ্যে এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের এক পাশে বাস করত এক জোলা আর তার বউ। জোলা ছিল বোকার হদ্দ আর কুঁড়ের একশেষ। রাতে ঘুম আর দিনের বেলায় টো-টো করে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার কাজ। এ ছাড়া আর কোনো কাজই সে করত না।
সংসার চলত জোলার বউয়ের রোজগারে। একদিন খাবার খেতে বসে জোলার বউ বলল, তুমি রাজার কাছে যাও, একটা কাজ চাও। তিনি তো কত লোককে চাকরি দেন। কত লোক তাঁকে কিত্সা-কাহিনি শুনিয়ে টাকাকড়ি পায়। খালি হাতে তাঁর কাছ থেকে কেউ ফিরে আসে না। তুমিও যাও, একটা কিছু চাও তাঁর কাছে। তুমিও পাবে।

জোলা তার বউয়ের কথা শুনে যায় ঠিকই। কিন্তু এক কান দিয়ে শোনে, আর এক কান দিয়ে বের করে দেয়। কারণ, রাজা কাজ দিলে কী হবে, সে তত কোনো কাজই জানে না। খামোকা লাভ কি রাজার কাছে গিয়ে।
জোলা-বউয়ের তাগাদা কিন্তু শেষ হয় না। রোজ রোজ একই কথা বলে। তাতে বিরক্ত হয় না জোলা। নানা ছুতাছাতায় বউকে ভুলিয়ে সে খাবার সময় খায়। খায়-দায় আর রাজবাড়ি যাবার নাম করে ঘর থেকে বের হয়। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে ঘরে আসে রাতে।
এভাবে তো দিন আর চলে না। জোলা-বউ খুব রেগে যায়। একদিন বলল, ঘরে বসে বসে তুমি রাক্ষসের মতো আর কতদিন খাবে? রাজবাড়ি গিয়ে কিছু পয়সাকড়ি কামাই করো না।

জোলা বলল, আমি তো কিছুই জানি না, রাজার কাছে কী কাজ চাইব? আমি কী কাহিনি শোনাব তাকে?
জোলা-বউ বলল, তুমি যা জানো তাই শোনাবে রাজাকে। |
কিন্তু তাতেও কাজ হল না। বউয়ের যাবতীয় গালমন্দ ধৈর্যের সঙ্গে হজম করে সে। কুঁড়ের মতো বসে বসে খায়, ঘুমায় আর ঘুরে ফিরে বাকি সময় কাটায়। বউ বুঝল সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না।
একদিন জোলা খাবার খেতে এলে বউ ঝাড়ু হাতে চোখ রাঙিয়ে বলল, অকর্মার সর্দার। আজ আমি তোমাকে রাজবাড়ি না পাঠিয়ে ছাড়ছি না। কামাই করার মুরোদ নেই, বিড়ালের মতো খেতে পারো শুধু। আজ ঝাড়ুর বাড়ি খাওয়াব তোমাকে।

জোলা ভাবল এ তো ভারী বিপদ। নিরুপায় হয়ে ছুটতে থাকে রাজবাড়ির দিকে। ছুটতে ছুটতে ভাবে, বউ বলে দিয়েছিল, তুমি পথে যা দেখবে তাই বলবে রাজাকে। কিন্তু রাজবাড়ির পথ আর ফুরায় না! ফুরাবেই বা কীভাবে? জোলা তিন পা এগোয় আর এক পা পিছোয়। আসলে রাজবাড়ি জোলার বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল পথ।
চলার পথে জোলার একটাই ভাবনা, সে কিছুই জানে না, রাজাকে কী বলবে, কী শোনাবে কিসসা? কিছু দূর গিয়ে জোলা দেখতে পায় একটা ব্যাং। ব্যাংটি লাফ দিয়ে বসে, আবার লাফ দেয়, আবার বসে। বিষয়টি দেখে বউয়ের কথা মনে পড়ে জোলার। তার মুখ থেকে একবার উচ্চারিত হয়—‘ফাল্দা বইসা যায়’।

তারপর জোলা কথাটি বার বার আওড়ায় আর রাজবাড়ির দিকে যায়। আর কতটুকু পথ এগিয়ে দেখতে পায় একটা বেজি। কিছু দূর ছুটে গিয়ে জোলা পেছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় বেজি উঁকিঝুঁকি দিয়ে পালিয়েছে জঙ্গলে। জোলা তখন প্রথম কথাটির সঙ্গে আরো কিছু কথা জুড়ে দিয়ে বলতে থাকে –

ফাল্দা বইসা যায়
দৌড়ে ফিরা চায়।
উঁকি দিয়া লুকায়।

কথাগুলো বলে আর পথ চলে জোলা। এসব কথাই আজ সে রাজাকে শোনাবে। কিন্তু পা যে তার চলতে চায় না আর। এক মাইল পথ, অথচ এক দুপুর হেঁটেও শেষ করতে পারে না।

রাজদরবারে হাজির হয়ে জোলা দেখল, লোকজনের অভাব নেই। একেবারে জমজমাট দরবার। কেউ গান গেয়ে, কেউ কিসসা শুনিয়ে, কেউ হাসি-তামাশা করে আনন্দ দিচ্ছে রাজাকে। রাজা বেশ খুশি-খুশি মুখ করে বসে আছেন।
জোলা মনমরা হয়ে বসে থাকল দরবারের এক কোণে। এত বড় রাজার সামনে সে কেমন করে কথা বলবে, এ ভাবনায় সে অস্থির। একবার মনে করে বাড়ি ফিরে যাবে। আবার ভাবে, হয়তো তার বউ ঝাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এখন গেলেই ঝাড়ুপেটা করবে।

এদিকে যার যার কাজের পর রাজা নানাজনকে নানা পুরস্কার দিলেন। টাকাকড়ি, হীরা জহরত পেয়ে রাজাকে ধন্য ধন্য করে চলে গেল তারা। জোলার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। সে বসে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছিল আর ভাবছিল পথের কথাগুলো বলবে কি না।
মুহূর্তের মধ্যে দরবার লোকশূন্য হয়ে গেল। জোলা আগের মতোই বসে রয়েছে চুপচাপ। হঠাৎ রাজার চোখ পড়ল জোলার দিকে। তিনি জানতে চাইলেন, তুই বসে আছিস কেন? কোনো কাজে এসেছিলি?

জোলার বুকটা কেঁপে উঠল। বুকের ভেতর কেমন যেন ধুপুড় ধুপুড় শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। দুতিনবার গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে হালকা করতে চাইল। সাহস করে বলল, মহারাজ। আমি আপনাকে কিছু কথা শোনাতে এসেছি।
জোলার কথা শেষ হতে না হতেই নরসুন্দর হাজির হল রাজার ক্ষৌরকর্মের জন্যে। রাজা বসলেন। নরসুন্দর তার কাজ শুরু করল। রাজা শুনতে চাইলেন জোলার কথাগুলো। জোলা সাহস করে বলতে থাকে—

ফাল্দা বইসা যায়
দৌড়ে ফিরা চায়।
উঁকি দিয়া লুকায়।


জোলার কথা শুনে রাজা খুব অবাক হলেন। এতক্ষণ তিনি তাকে নিরেট বোকা মনে করেছিলেন। আসলে সে অনেক বড়ো পণ্ডিত। রাজাকে কথায় ঠকাবার জন্যে সে ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। যে সব কথা সে বলেছে, মস্তবড়ো গণক ছাড়া অন্য কেউ এর অর্থ বুঝতে পারবে না।
জোলার কথাগুলো নিয়ে কেবল রাজা ভাবছেন তা নয়, সাত-ছালা বুদ্ধির নরসুন্দরও জোলার কথা শুনে থ হয়ে গেল। তখন রাজবাড়ির প্রধান গেটের পাশ দিয়ে একটা শেয়াল দৌড়ে পাচ্ছিল। তা দেখে জোলা বলল-

ফাল্দা বইসা যায়
দৌড়ে ফিরা চায়
উকি দিয়া লুকায়।
ওই তো শিবা যায়।


যে নরসুন্দর রাজার ক্ষৌরকর্ম করছিল তার নাম ছিল শিবা। কিন্তু জোলা তা জানত না। তার মুখে শিবা নাম শোনামাত্র নরসুন্দর শিবার হাত থেকে ক্ষুর পড়ে গেল। সে কাপতে কাঁপতে রাজার পায়ে পড়ে বলল, মহারাজ। আমাকে ক্ষমা করবেন—আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ উজিরের। তিনি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, ক্ষৌর করবার সময় ক্ষুর দিয়ে যেন আপনার গলা কেটে ফেলি। আমাকে রেহাই দিন মহারাজ।
রাজা তো বিস্ময়ে হতবাক! আর দেরি করলেন না তিনি। সঙ্গে সঙ্গে উজির আর নরসুন্দরকে হাত-পা বেঁধে বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হল। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন রাজা।

আনন্দে ডগমগ করা চোখে রাজা তাকালেন জোলার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে জোলাকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে গণকঠাকুর, তুমি আমার প্রাণ রক্ষা করেছ। তুমি না এলে শিবা ব্যাটা এতক্ষণে আমাকে কোতল করে ফেলত।
জোলা বুঝল এই তো বড়ো সুযোগ। বোকা জোলা সাহস করে দুটি টাকা চাইল রাজার কাছে। তার ধারণা, দুই টাকার চালডাল কিনে নিয়ে বাড়ি গেলে আজ আর বউয়ের ঝাড়পেটা খেতে হবে না।

রাজা ভাবলেন অন্যকথা। গণকঠাকুর লোভহীন উদার প্রকৃতির লোক। এ জন্যে সে দুটাকার বেশি চাইল না। রাজা অভিভূত হলেন। অনেক ধন-সম্পদ দিলেন তাকে। রাজার পুরস্কার পেয়ে বোকা জোলাও ধনী হয়ে গেল। নটে গাছটি মুড়োলো কুঁড়ে জোলার গল্পটি ফুরালো।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল :-& ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:০২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্রী ও কুশ্রী পদাবলির ব্লগারদের টার্গেট আমি

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৫



আমাকে জেনারেল করা হয়েছে ১টি কমেন্টের জন্য; আমার ষ্টেটাস অনুযায়ী, আমি কমেন্ট করতে পারার কথা; সেটাও বন্ধ করে রাখা হয়েছে; এখন বসে বসে ব্লগের গার্বেজ পড়ছি।

সম্প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবি কখনো কখনো কিছু ইঙ্গিত দেয়!

লিখেছেন ডার্ক ম্যান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭



গতকাল ভারতীয় সেনাপ্রধানের সাথে বাংলাদেশ সেনাপ্রধান এর ভার্চুয়ালি কথা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের অফিসায়াল এক্স পোস্টে এই ছবি পোস্ট করে জানিয়েছে।

ভারতীয় সেনাপ্রধানের পিছনে একটা ছবি ছিল ১৯৭১ সালের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রথম আলু

লিখেছেন স্নিগ্দ্ধ মুগ্দ্ধতা, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



লতিফপুরের মতি পাগল
সকালবেলা উঠে
পৌঁছে গেল বাঁশবাগানে
বদনা নিয়ে ছুটে



ঘাঁড় গুঁজে সে আড় চোখেতে
নিচ্ছিল কাজ সেরে
পাশের বাড়ির লালু বলদ
হঠাৎ এলো তেড়ে




লাল বদনা দেখে লালুর
মেজাজ গেল চড়ে।
আসলো ছুটে যেমন পুলিশ
জঙ্গী দমন করে!





মতির... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশে ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠা করা জরুরী?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০২



বিশ্ব ইসলামের নিয়মে চলছে না।
এমনকি আমাদের দেশও ইসলামের নিয়মে চলছে না। দেশ চলিছে সংবিধান অনুযায়ী। ধর্মের নিয়ম কানুন মেনে চললে পুরো দেশ পিছিয়ে যাবে। ধর্ম যেই সময় (সামন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি হাজার কথা বলে

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৮ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৩:৫৩

আগস্টের ৩ তারিখ আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রগতি স্মরণী গিয়ে আন্দোলনে শরিক হই। সন্ধ্যের নাগাদ পরিবারকে নিয়ে আমার শ্বশুর বাড়ি রেখে এসে পরদিনই দুপুরের মধ্যেই রওনা হয়ে যাই। আগস্টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×