মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। যিনিই প্রেসিডেন্ট হন, তার হাতে থাকে বিশ্বের মানচিত্র বদলে দেয়ার ক্ষমতা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তারা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন। তার মধ্যে হোয়াইট হাউজে থাকা বা বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে ভ্রমণ করা আমাদের কাছে দৃশ্যমান। এগুলোর পাশাপাশি আরো অনেক সুবিধা পান। যার কারনে পরাজিত হয়েও উন্মাদ ট্রাম্প কচ্ছপের মতো কামড়ে ধরে রাখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদ
ছয় অঙ্কের বার্ষিক বেতনঃ
অন্যান্য পেশার মতো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করাটাও একটা চাকরি। এর জন্যও রয়েছে বেতন ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা তাদের দায়িত্বের জন্য বছরে চার লাখ মার্কিন ডলার পেয়ে থাকেন। ২০০১ সালে বার্ষিক বেতন দুই লাখ ডলার থেকে দ্বিগুণ করে তা চার লাখে আনা হয়। বেতন বৃদ্ধি পাওয়ার পর প্রথম এর সুবিধা পান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। তবে পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের বার্ষিক বেতনের সাথে তুলনা করলে বুশ, ওবামা বা ট্রাম্পের বেতন কমই মনে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের বার্ষিক বেতন ছিল ২৫,০০০ ডলার। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় নিলে বর্তমানে যা ৬,৬৯,৪৬৯ ডলার! এছাড়া প্রেসিডেন্টরা বছরে ৫০,০০০ ডলার আলাদা ব্যয় ভাতা পেয়ে থাকেন। শুধু তা-ই নয়, ভ্রমণের জন্য এক লাখ ডলার এবং বিনোদনের জন্য ১৯,০০০ ডলার বোনাস পেয়ে থাকেন। বার্ষিক বেতন করের অন্তর্ভুক্ত হলেও বোনাসের জন্য তাদের কোনো কর দিতে হয় না। প্রেসিডেন্টদের বার্ষিক বেতনই তাদের আয়, এটা মনে করলে ভুল হবে। বারাক ওবামা বই লিখে ও বিভিন্ন বিনিয়োগের মাধ্যমেও আয় করতেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে। আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ব্যবসায়ী হিসেবে তার আয়ের তুলনায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে পাওয়া বেতন অনেক কমই বলা যায়। ফোর্বসের তথ্যানুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ ৩.১ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য নির্বাচিত হওয়ার আগেই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কোনো বেতন নেবেন না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী একেবারে বেতন না নেয়ার অনুমতি না থাকায় তিনি বার্ষিক এক ডলার বেতন নিয়ে থাকেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি ও হার্বার্ট হুভার তাদের বেতনের পুরো অর্থই দাতব্য কাজে দান করে দেন।
হোয়াইট হাউজে থাকার সুযোগঃ
মার্কিন প্রেসিডেন্টরা পরিবার নিয়ে হোয়াইট হাউজে থাকতে পারেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ১৭৯২ সাল থেকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়টা হোয়াইট হাউজে পরিবার নিয়ে থাকার সুযোগ পেয়ে আসছেন। এতে রয়েছে ছয়টি ফ্লোর ও ১৩২টি কক্ষ। নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউজে প্রথম আসার সময় প্রেসিডেন্টরা এক লাখ ডলার পেয়ে থাকেন তাদের মতো করে সাজানোর জন্য। ওবামা অবশ্য এই ভাতা গ্রহণ করেননি। নিজের খরচেই হোয়াইট হাউজ সাজিয়েছিলেন তিনি। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন নতুন ফার্নিচার, ডেস্ক ও অন্যান্য কাজে প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। ট্রাম্প এই অর্থ নিজে দিয়েছেন কি না তা নিশ্চিত নয়। প্রেসিডেন্ট পরিবার ছাড়াও হোয়াইট হাউজ আরো ১০০ স্থায়ী কর্মচারীদেরও বাসস্থান। এদের মাঝে রয়েছে গৃহ পরিচারিকা, রাঁধুনি, মালী, প্রকৌশলী ও একজন মূল তত্ত্বাবধায়ক। হোয়াইট হাউজে থাকার জন্য প্রেসিডেন্টদের কোনো ভাড়া দিতে না হলেও সেখানকার কর্মচারীদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে হলে ঘণ্টা হিসেবে খরচ করতে হয় নিজের পকেট থেকে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট পরিবার হোয়াইট হাউজের বাগানে জন্মানো টাটকা ফল ও সবজিও প্রতিদিনের খাবারের মেন্যুতে পান। হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টদের জন্য একটি মুভি থিয়েটারও রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট হোয়াইট হাউজের একটি কক্ষকে ৫১ আসনের থিয়েটারে রূপান্তরিত করেন। ট্রাম্প প্রশাসনকে এখানে প্রথম মুভি হিসেবে ‘ফাইন্ডিং ডোরি’ মুভিটি দেখানো হয়। ফার্স্ট লেডি ম্যালানিয়া ট্রাম্পের উদ্যোগে ২০১৭ সাল থেকে দর্শনার্থীদের জন্য এই থিয়েটারটিও দেখার সুযোগ করে দেয়া হয়।
ব্লেয়ার হাউসঃ
ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্তিত প্রেসিডেন্টের সরকারি গেস্ট হাউস ব্লেয়ার হাউস। যা হোয়াউট হাউসের চেয়েও বড়। এর আয়তন ৭০ হাজার বর্গফুট। এতে রয়েছে ১৪টি বেডরুমসহ ১১৯টি ঘর ও ৩৫টি বাথরুম।
অত্যাধুনিক যাতায়াত ব্যবস্থাঃ
এয়ার ফোর্স ওয়ান। প্রেসিডেন্টকে নিয়ে উড্ডয়নের জন্য রয়েছে বোয়িং ৭৪৭-২০০বি, যাকে বলা হয় এয়ার ফোর্স ওয়ান। এই বিমানে রয়েছে ৪,০০০ বর্গ ফুট জায়গা। যাতে একটি কনফারেন্স রুম, একটি ডাইনিং রুম, প্রেসিডেন্টের জন্য ব্যক্তিগত কক্ষ, একটি মেডিকেল অস্ত্রোপচার কক্ষসহ আরো বিভিন্ন সুবিধা। প্রতি উড্ডয়নে একজন চিকিৎসক সবসময় উপস্থিত থাকেন। এর ধারণক্ষমতা ১০০ জন মানুষের। এয়ার ফোর্স ওয়ান পরিচালনার জন্য প্রতি ঘণ্টায় খরচ হয় দুই লাখ ডলার। রাজনৈতিক কাজে উড্ডয়নের জন্য এর খরচ আসে সরকার ও প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক সংগঠন থেকে। তবে প্রেসিডেন্ট যদি নির্বাচনী প্রচারণার কাজে এয়ার ফোর্স ব্যবহার করেন, তখন সরকারের কাছে তার খরচ পরিশোধ করতে হয়। এয়ার ফোর্স ওয়ান ছাড়াও প্রেসিডেন্ট যেখানেই যান না কেন, তার জন্য একটি হেলিকপ্টারও থাকে। এই হেলিকপ্টারের নাম মেরিন ওয়ান। এটি জরুরি মুহূর্তে প্রেসিডেন্টের উদ্ধারকার্য পরিচালনা করার জন্য নকশা করা হয়েছে। এর একটি ইঞ্জিন যদি বিকলও হয়ে যায়, ঘণ্টায় ১৫০ মাইলের বেশি বেগে ছুটতে পারে।
মেরিন ওয়ানঃ
এতে রয়েছে ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপের সুবিধা এবং মিসাইল আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা। প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন বাহিনীর সম্মানজনক এইচএমএক্স-১ ‘নাইটহকস’ স্কোয়াড্রনের মাত্র চার জন পাইলট এই হেলিকপ্টার উড্ডয়নের সুযোগ পান।
প্রেসিডেন্টের গাড়িঃ
প্রেসিডেন্ট যখন সড়ক পথে ভ্রমণ করেন, তখন তিনি বুলেটপ্রুফ ও বোমানিরোধী গাড়ি ব্যবহার করেন। প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহরকে বলা হয় ‘দ্য বিস্টস’। এই গাড়িগুলোর ডিজাইন করে থাকে সিক্রেট সার্ভিস। গাড়ির সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণও করে থাকে সিক্রেট সার্ভিস।
চিকিৎসা সুবিধাঃ
দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের জন্য সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক থাকেন যেকোনো সময় চিকিৎসার প্রয়োজনে উপস্থিত থাকার জন্য। হোয়াইট হাউজের একটি আলাদা ক্লিনিকই আছে, যেখানে শারীরিক পরীক্ষা করার কক্ষ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মিলিটারি চিকিৎসকরা থাকেন। প্রেসিডেন্টের পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিবারও হোয়াইট হাউজ থেকে একই চিকিৎসা সেবা পাবেন। প্রেসিডেন্টরা পাঁচ বছর বা তার বেশি সময় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করলে স্বাস্থ্য সেবায় অগ্রাধিকার ও প্রবীণ হাসপাতালের সুবিধা পেয়ে থাকেন। আগ্রহী প্রেসিডেন্টরা ওবামা কেয়ারের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ের শতকরা ৭৫ ভাগ বীমার সুবিধা পান।
একঘেয়েমি দূর করার জন্য আছে ‘ক্যাম্প ডেভিড’
ওয়াশিংটন ডিসির কোলাহলে পরিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে প্রেসিডেন্ট যদি কোথাও নির্জনে সময় কাটাতে চান, তাহলে তার জন্য রয়েছে ‘ক্যাম্প ডেভিড’। মেরিল্যান্ডের ফ্রেড্রিক কাউন্টিতে অবস্থিত এই বাড়িতে জিম, সুইমিং পুল, এয়ারক্রাফট হ্যাঙ্গারসহ অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। এটি ত্রিশের দশক থেকেই প্রেসিডেন্টদের কাছে একান্তে কিছু সময় কাটানোর জায়গা। ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও প্রিয় জায়গা এটি। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম বছরেই পাঁচবার সেখানে ভ্রমণ করেছেন তিনি। টুইটারে জানিয়েছেন এটি তার কাছে একটি বিশেষ জায়গা। ক্যাম্প ডেভিডকে প্রেসিডেন্টরা কূটনৈতিক আলোচনার জন্যও ব্যবহার করে থাকেন।
সাবেক প্রেসিডেন্টদের ভাতাঃ
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও রাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন। ছবিতে বাম থেকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন;
প্রেসিডেন্টদের নিরাপত্তার জন্য দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে সিক্রেট সার্ভিস। তবে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও আজীবন তারা এই নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। তাদের সন্তানরাও ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত এই নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। ২০১৭ সালে সিক্রেট সার্ভিসের বাজেট ছিল ১.৯ বিলিয়ন ডলার। সাবেক প্রেসিডেন্টরা হোয়াইট হাউজ ছাড়ার পর বড় অঙ্কের অবসর ভাতাও পেয়ে থাকেন। ২০১৬ সালে জিমি কার্টার, জর্জ বুশ সিনিয়র ও জুনিয়র এবং বিল ক্লিনটন প্রত্যেকে ২,০৫,৭০০ ডলার ভাতা পান। বারাক ওবামা ২০১৭ সালে ২,০৭,৮০০ ডলার গ্রহণ করেন। এছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্টরা ছুটি কাটানো বা ভ্রমণের জন্যও ভাতা পেয়ে থাকেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে ওবামাকে প্রতি বছর দুই লাখ ডলার ভাতা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। যদিও ওবামা সেই বিলে ভেটো দেন।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনঃ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও তাদের পরিবারকে আমেরিকান আইকন মনে করা হয়। কোনো প্রেসিডেন্ট বা তার পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে তাদের পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। এই অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সাত থেকে দশ দিন পর্যন্ত চলতে পারে। এতে তিন ধাপে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। মৃত প্রেসিডেন্ট পরিবার ‘টুয়েন্টি ওয়ান গান স্যালুট’ পেয়ে থাকেন। নিজের ভলো পাগলেও বোঝে ! এত সুবিধার লোভে পাগলা ট্রাম্প পরাজিত হয়েও কচ্ছপের মতো কামড়ে ধরে রাখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পদ।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:০৮