প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশালের উজিরপুর উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রাম। সাপলা ফুলের স্বর্গ সাতলা গ্রাম/ইউনিয়ন নিয়ে সুন্দর একটি ভিডিও।
বিভিন্ন ধর্মের মেলবন্ধন ঐতিহ্যবাহী এবং অসাম্প্রদায়ীক গ্রাম সাতলায় যে কয়টি গোত্র বা বংশ আছে বালী বংশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বালী বংশ শক্তি ধন-জন ও শৌর্য-বীর্যে ও প্রতিপত্তিতে প্রভাবশালী ছিলো বিধায় এই গোত্র প্রথমে বলীয়ান পরবর্তীতে বলীক বা বলী এবং সবশেষে বালী বংশ বা গোত্র হিসেবে নিজেদের আলাদা পরিচয় ধারণ করে। এই বংশে বহু সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারক ও জন প্রতিনিধির আগমন ঘটে যারা ঘটনাবহুল জীবন অতিবাহিত করে সাতলার ব্যপক উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করতে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। বালী বংশের প্রাতস্মরণীয় অনেক প্রতিথযশা মহৎজনের অন্যতম আলহাজ্ব দলিলউদ্দিন বালী। হাজী দলিলদ্দিন বালী ১৮৫৯ ইংরেজী এবং বাংলা ১২৫৬ সালে সাতলার ঐতিহ্যবাহী বালী বংশের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুন্সি ছকরি বালী এবং মাতার নাম আলেকজান বিবি। সচেতনতার অভাব অথবা প্রতিকুল পরিবেশে তার সঠিক জন্ম তারিখ সংরক্ষিত হয় নাই বিধায় তাঁর জন্ম তারিখ উল্লেখ করা গেলনা। শিক্ষা জীবনে দলিলউদ্দিন বারী মক্তবে পড়াশুনা শেষ করে মুন্সি উপাধি ধারণ করেন। পরবর্তীতে মক্তব মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে আদালতে নিরপেক্ষভাবে বিচার কাজ পরিচালনায় সহয়তা করার জন্য তিনি বরিশাল জেলার বিচার বিভাগের জুরি বোর্ডের সদস্যের দ্বায়িত্ব পালন করেন। জীবদ্দশায় তিনি সাতলা এবং সাতলার জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। অনস্বীকার্য যে তৎকালীন সময়ে ভৌগলিকভাবে সমগ্র গ্রামটি ছিলো বিল এলাকা।
বরিশালের ঐতিহ্যবাহী শাপলার সর্গরাজ্য সাতলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
জনশ্রুতি আছে সাতলার গোড়াপত্তনের সময় সাতলায় উল্লেখযোগ্য সাতটি বসতবাড়ি ছিলো এবং তা একটির থেকে অন্যটি অনেক দূরত্তে অবস্থিত। অর্থাৎ সাতলায় পাতলা পাতলা সাতটি বাড়ির নাম অনুসারে সাতলার নামকরণ হয় সাতলা। সাতলার যোগাযোগ ব্যবস্থ্যা ছিলো খুবই নাজুক। এক বাড়ী থেকে অন্য বাড়ীতে যাতায়াত করা ছিলো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলো নৌকা। তুলনামূলকভাবে অনুন্নত সাতলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অর্জনের জন্য সুদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি সাতলার যোগাযোগ ও শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণীভূমিকা পালন করেন দলিলউদ্দিন বালী। জনপ্রতিনিধিত্ব ও সমাজ সেবার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি সাতলায় পঞ্চায়েত সভা গঠন করেন এবং সাতলার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বলাবাহুল্য সে সময়ে সাতলায় পাণীয় জলের সুব্যবস্থ্যা না থাকায় নদী ও পুকুরের পানিই ছিলো একমাত্র ভরসা। নদী ও পুকুরের দুষিত পানি পান করার কারণে সাতলা গ্রামে কলেরা মাহামারী হিসেবে দেখা দিতো। সমাজ সেবার অংশ হিসেবে গ্রামের মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার জন্য নিজ বাড়িতে টিউবওয়েল স্থাপন করেন দলিলউদ্দিন বালী। যেখানে ছিলো সবার অবারিত দ্বার। তাঁর সময়কালে সাতলার বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ বিরাজমান ছিলো। মুসলানদের ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে যেমন অন্যধর্মের মানুষেরা আতিথিয়তা গ্রহণ করতো তেমনি মুসলমানরাও অন্য ধর্মের উৎসবে অবাধে যোগ দিয়ে সার্বজনীন উৎসবের আবহ সৃষ্টি করতেন । তাঁর নেতৃত্বে সাতলার বাজারটি এক সময়ে সাতলা বন্দরে রূপ লাভ করে। দূর দুরান্ত থেকে বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকায় বিভিন্ন পন্যের পসরা সাজিয়ে মহাজনরা এখানে ব্যবসায় করতে আসতেন। সারাদিন মাঝি মাল্লাদের কলরবে মুখর থাকতো সাতলা বন্দর। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ সফলভাবে প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বিচার বিভাগের জুরি বোর্ডের সদস্যের দ্বায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে সাতলায় সমাজসেবক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, মোহাম্মদ সিদ্দিক বালী, হাজী ফেলান উল্লাহ বালী, বাবু হরনাথ বাইন প্রমূখ। ধর্মভীরু দলিলউদ্দিন বালী ইসলামের অন্যতম রোকন হ্জ্বব্রত পালনের জন্য ইস্টিমার যোগে পবিত্র মক্কানগরীর উদ্দেশ্যে গমণ করেন। যাত্রার পর প্রায়একমাস নানা চড়াই উৎরাই পার করে তিনি সফলভাবে হজ্বব্রত পালন করে গ্রামে ফিরে আসেন। তিনিই ছিলেন সাতলার প্রথম হাজী। হজ্বব্রত পালনের পর বহুদিন তিনি সাতলার ঐতিহ্যবাহী জুম্মা বাড়ির মসজিদে ইমামতি করেছেন। সে সময় এই মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়ানো হতো বলে এই বাড়িটি জুম্মা বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ব্যক্তিগত জীবনে হাজী দলিলউদ্দিন বালী ছিলেন দৃঢ়চেতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যার কারণে কখনো কখনো তাকে হতে হয়েছে কঠোর। অন্যায়কে দমন করেছেন কঠোর হস্তে। তাই কারো কারো কাছে তিনি অপ্রিয় হলেও সংখ্যাগুরুদের মাঝে তিনি ছিলেন জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। দুই পুত্র ও ৫ কন্যার জনক হাজী দলিলউদ্দিন বালীর প্রথম পুত্র হেমায়েত উদ্দিন বালী অকালে মৃত্যুবরণ করলে তিনি মুষড়ে পরেন। তাঁর অপর পুত্র মকসেদ আলী বালী সাতলার বিভিন্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন। দীর্ঘ কর্মময় জীবন অতিবাহিত করে ১৯৬৪ সালের ১৪ জুলাই বাংলা ১৩৭১ সালের ১লা শ্রাবণ পরলোক গমন করেন সাতলার প্রথম প্রেসিডেন্ট হাজী দলিল উদ্দিন বালী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ১১৫ বছর। জীবন সায়হ্নে তিনি ১ পুত্র ও ৫ কন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। হাজী দলিলউদ্দিন বালীর সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত সর্ব জনাব সোহেল চৌধুরী ও ড. আব্দুর রাজ্জাক সম্পাদিত সাতলার ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ "ফিরে আসি বারে বারে মা ও মাটির টানে" তে সংযোজন করাতে তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আজ হাজী দলিলউদ্দিন বালীর ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। সাতলা ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব মোহাম্মদ দলিলউদ্দিন বালীর ৫৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্য সরবরাহেঃ উকিলউদ্দিন বালী,আচমত আলী বালী, নূর হোসেন বালী, মিজানূর রহমান বালী
গ্রন্থনাঃ নূর মোহাম্মদ বালী
লাল শাপলার স্বর্গরাজ্য সাতলা বিল নিয়ে একটি গান
যেভাবে যাবেন সাপলা ফুলেল স্বর্গ সাতলা গ্রামে
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০২০ দুপুর ১২:০৫