জীবনভর যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকা মানুষগুলোকে বলা হয় মধ্যবিত্ত। সংসারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হয় তাদের। করোনার ভয়াল থাবায় আরো জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। একদিকে বাড়ছে জীবনযাত্রার খরচ, অন্যদিকে কারো চাকরি যাচ্ছে, কারো কমেছে বেতন। ভো'গবাদী এই সমাজে মধ্যবিত্ত প্রায় সবসময়ই বি'পদে ছিল। তাদের টিকে থাকাই ছিল ক'ঠিন। যদিও শহরের মধ্যবিত্তদের চাহিদা খুব একটা বেশী নয়। গাড়ী বাড়ি চাইনা তাদের। শুধু বাচ্চারা একটু ভালো স্কুলে পড়ুক। চলার মতো রুটি-রুজির ব্যবস্থা হোক। এই নিয়েই তাদের দৈনন্দিন চলা। জীবনের সঙ্গে এ্ই ল'ড়াই তাদের দীর্ঘদিনের। বারবার হোঁ'চ'ট খে'য়েছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন তবে থেমে থাকেন নি। কিন্তু কালা'ন্তক করোনা তাদের জীবনে যে বি'প'র্যয় নিয়ে এসেছে তা অভা'বনীয়। একদল ফিরে গেছেন বাড়ি। দীর্ঘকালে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার মধ্যরাতে, সকালে অথবা দুপুরে তারা তু'লে দিচ্ছেন পিকআপে। ফিরে যাচ্ছেন গ্রামে। অনেকদিন আগে যে গ্রাম ছে'ড়ে এসেছিলেন। কথা হচ্ছে, সেখানেও তাদের সামনে অপেক্ষা করছে অনি'শ্চয়'তা। বাকিরা ল'ড়ছেন এখনো এই শহরে। স্রে'ফ টি'কে থাকার সংগ্রাম। জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে সেভাবে তাদের মানিব্যাগ বড় হয়নি। পরিবারের সদস্যদের চাওয়া পাওয়ার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। এখন তাদের টিকে থাকাই ক'ঠিন। চিরকালীন মধ্যবিত্তের জীবনটা সবসময়ই ক'ঠিন। আগেও এখনও। তাল গাছের আড়াই হাতের বাস্তবতা তাদের জীবন আটকে দিয়েছে। এই আড়াই হাত তারা কোনদিনই পাড়ি দিতে পারেনাই। বাংলাদেশের ১৬কোটি মানুষের চার কোটি পরিবারের মধ্যে ৬০ ভাগ নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। যার সংখ্যা আড়াই কোটি পরিবারের মতো। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম নভেল করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। প্রথম দিনই তিনজনের শরীরে করোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১০ দিন পর ১৮ মার্চ আক্রান্ত বেড়ে ৩ থেকে দাঁড়ায় ১৪ জনে। ওইদিনই করোনায় প্রথম মৃত্যুসংবাদে কেঁপে উঠেছিল দেশ। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এর সপ্তাহখানের পর ২৬ মার্চ থেকে সরকার সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। একে একে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থল বন্ধ হতে শুরু করে। করোনার কারনে মার্চের শেষ সপ্তায় সাধারণ ছুটি বা লকডাউন শুরুর পর সবচেয়ে বি'পর্য'য়ে পড়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের বেশির ভাগই নিজেদের জীবিকা হা'রিয়ে ফেলেন। অনেকে শহর ছে'ড়ে চলে যান। এসব নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যো'গ দেখা যায়। মধ্যবিত্তের ওপর আ'ঘা'তটা আসে আরেকটু পরে। সঞ্চয় ভে'ঙে খাওয়া শেষে তারা দেখেন হাতে কিছুই নেই। পরিবর্তিত সময়ে তারা সবচেয়ে বেশি সং'ক'টে পড়ছেন বাসা ভাড়া মে'টা'তে গিয়ে। যা বেতন পান দেখা যায় তার অর্ধেক চলে যায় বাসা ভাড়া মেটাতে। বাকি অর্ধেকে টে'নেটু'নে চলেন। কিন্তু এমন মধ্যবিত্তের অনেকেই চাকরি হা'রিয়েছেন। পোশাক খাত বাদ দিলেও অন্তত দেড় কোটি মানুষ চাকরি হা'রাতে বসেছে। এ সেক্টর ধ'রলে সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে। সব কারখানায় কর্মী ছাঁ'টাই শুরু হয়েছে। এভাবে চ'লতে থাকলে দেশে বেকারের সংখ্যা দিন দিন ভ'য়াব'হ আ'কা'রে বেড়ে যাবে এবং তাদের জন্য এই শহরে টে'কা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বেতন আ'টকে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। কেউবা দু’মাসে একবার বেতন পেয়েছেন। বেতন কমে গেছে অনেকের। এমনকি কয়েকটি ব্যাংকও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়েছে। ক'ঠিন এ সময়ে জীবিকার টা'নে পেশা পরিবর্তন করেছেন কেউ কেউ। মধ্যবিত্তরা শত কষ্টের মধ্যেও সহজে হাত পাততে পারেন না। প্রাণ খুলে বলতে পারেন না অভাব অনটনের কথা। সামাকিজ মর্যাদা ও স্টাটাস রক্ষা কথাও ভাবতে হয় অভাব মেটানোর পাশাপাশি। তাই বাধ্য হেয়ে নানা ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিজেদের জ'ড়িয়েছেন তারা। বাস্তবতা হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবী ছা'ড়া কেউই আসলে ভালো নেই।
করোনা পরিস্থি'তি যে এতটা ক'ঠিন হবে তা অবশ্য শুরুর দিকে আঁ'চ করা যায়নি। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝির পর কিংবা জুলাইয়ের শেষ দিকে শান্ত হতে পারে ভাইরাসটি তাণ্ডব। কিন্তু নিশ্চিত করে সেটাও বলা যাচ্ছে না। আর গত দুই সপ্তাহে যে হারে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেড়েছে সেটা অব্যাহত থাকলে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংখ্যাগুলো কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা আন্দাজ করে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ পড়ছে। এ বাস্তবতায় সল্প আয়ের মানুষ নয়, মধ্য আয়ের মানুষসহ দেশের সব মানুষই এখন বি'পদগ্র'স্ত। একদিকে মানুষ চাকরি হা'রিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিও চা'পের মু'খে পড়েছে। যেখানে গ্রামের মানুষ জীবন মান উন্নয়নের জন্য ঢাকায় আসেন সেখানে তারা ঢাকা ছে'ড়ে চলে যাচ্ছেন। তারা কর্মসং'স্থান চায় সেখানে কর্মসং'স্থান সং'কু'চিত হয়ে আসছে। দেশে বে'কার'ত্বের সংখ্যা এমনিতেই বেশি ছিল। এ অবস্থা'য় নতুন করে হাজার হাজার মানুষ বে'কার হচ্ছেন। ফলে নানামুখি সংকট আর হতাশার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এদিকে লকডাউনের ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধের অজুহাতে দিন দিন বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর দাম। প্রতিটি দ্রব্যের দাম কয়েক দফা বেড়ে তা ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে যাচ্ছে। গত কয়েকদিনের ব্যবধানে চাল কেজি প্রতি ১৪/১৫ টাকা, মোটা ডাল কেজি প্রতি ৩৫ টাকা, খেসারি প্রতি কেজি ৩০/৩৫ টাকা, সোয়াবিন তেল ১০/১৫ টাকা, পেয়াজ কেজি প্রতি ১৭/২০ টাকা, রসুন কেজি প্রতি ৩৫/৪০ টাকা, আদা কেজি প্রতি ৫০/৬০ টাকা, ছোলা বুট কেজি প্রতি ১০/১২ টাকা, কেজি প্রতি ৮/১০ টাকা চিনিসহ প্রায় প্রতিটি দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আর দাম বৃদ্ধিতে সংসার চালাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের। এ পরি্স্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগানও দিতে পারছেন না তারা। আবার তা প্রকাশ্যে বলতেও পারছেন না। প্রায় তিন মাস ধরে দেশের এই করোনা পরিস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতি। আমদানি-রফতানি বন্ধ বললেই চলে। পোশাক কারখানার নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের দুবেলা ভাতের অনিশ্চয়তা আরও প্রগাঢ় হচ্ছে। ঝুঁকি নিয়েও রুটি-রুজির খোঁজে অনেকেই রাস্তায় নামছেন। কর্ম হারিয়ে হাজার হাজার মানুষের বেহাল দশা। অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্মচারীদের বেতনের একটা ভাগ কর্তন করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের টানাপোড়েন। যেন চারপাশ থেকে নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক অন্ধকার দেশটাকে ঘিরে ধরেছে। গত ৪০ বছর ধরে এই ঢাকা শহরে আমার পদচারণা থাকলেও এখন মনে হচ্ছে শহরটা আর আমার নেই। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) কবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে কেউ বলতে পারবে না। দীর্ঘস্থায়ীভাবে এ ভাইরাস পৃথিবীতে রয়ে যেতে পারে। বছরের পর বছর মানুষ করোনা ভাইরাসে প্রাণ হারাবে। মানব জাতিকে করোনা ভাইরাস দীর্ঘস্থায়ীভাবে ভোগাবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেলথ ইমারজেন্সি প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ডা. মাইক রায়ান। তাই সারাবিশ্বের মানুষের কাছে বর্তমানে একটাই চাওয়া করোনা ভাইরাসমুক্ত পৃথিবী। করোনা ভাইরাসের কারনে উদ্ভূত দেশের এই অর্থনৈতিক এ মন্দা কাটিয়ে দেশ কবে আবার ঘুরে দাঁড়াবে সেটাও অনেকাংশে অজানা। দেশের যে কর্মসং'স্থান ছিল তা ধ'রে রাখার জন্য সরকারের কোনো পদ্ধতি নেই। সরকার এ নিয়ে অনেককিছুই করতে চাইছে। সরকারি সেফটিনেটের বাইরে থাকা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এ বিষয়ে তালিকা তৈরি করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু বিভিন্ন পর্যায়ের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে তা পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। এই জায়গাতে আরও জবাবদিহিতা ও নজরদারি বাড়বে- মানুষ এমনটিই প্রত্যাশা করছে। করোনা মোকাবিলায় নতুন করে নতুন পদ্ধতিতে গোটা দেশকে জোনভিত্তিক যে বিভাজন করা হয়েছে, সেটিরও যথাযথ প্রতিফলন প্রত্যাশা করে জনগণ। করোনা নামক দানবের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন অংশগ্রহণও জরুরি। করোনা বিজয়ী হতে হলে সরকার, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও আপামর জনগণের একযোগে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৫:২৫