দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী হেলেন কেলার একজন মার্কিন লেখিকা ও সমাজসেবী। মানুষ বিধাতার সৃষ্টির সেরা জীব। তাই যুগে-যুগে কিছু মানুষ জন্ম গ্রহণ করেন যাদের দেখে খুবই বিস্ময়কর হতে হয়। চোখ দিয়ে সুন্দর পৃথিবী দেখেনি, কান দিয়ে শুনেনি কোন বাক্য, পারেনি মুখ দিয়ে কথা বলতে। এই জগৎ তাদের কাছে অদৃশ্য, মানুষের কথা তাদের কাছে নিঃশব্দ, বাক্যহীন, নীরব, নিস্তব্ধ। পৃথিবীতে এধরণের মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। জীবন যার ভাষাহীন, প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ থেকে যিনি বঞ্চিত, এক কথায় শ্রবণহীন জীবন- এ ধরনের মানুষকে বিধাতার চরম অভিশাপ হিসেবেই মনে করেন অনেকে। কিন্তু এমনও একজন ছিলেন যিনি তা কখনোই বিশ্বাস করতেন না। এরকম অসহায়ত্বকে জয় করে পৃথিবীর ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন যে ব্যক্তি, তিনি আর কেউ নন- মানবতার পূজারিণী মহীয়সী নারী হেলেন কেলার। একাধারে তিনি ছিলেন সাহিত্যিক ও মানবতাদী। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি । দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী হেলেন কেলার আজন্ম লড়াই করে গেছেন। কখনো নিজের জন্য, কখনও বা প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য। নিজের শারীরিক অক্ষমতার জন্য তিনি দমে যাননি। বরং নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা দিয়ে পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন। এই মহীয়সী নারী একাধারে ছিলেন একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক, মানবতাবাদী সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রিয় বক্তা। শারীরিক সব অক্ষমতাকে প্রচন্ড মানসিক শক্তি দিয়ে কিভাবে জয় করতে হয়, তিনি সেটা শিখিয়ে গেছেন। পৃথিবীর সকল প্রতিবন্ধীদের অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসের নাম হেলেন কেলার। সারা বিশ্ব জুড়ে আছে তার বিরল প্রতিভার খ্যাতি। অনন্য সাহিত্য প্রতিভা দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে পৃথিবীর বুকে নিজের নামটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন। সাহিত্যিক হেলেন কেলারের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১২ টি। এর মধ্যে প্রধান গ্রন্থ গুলো হচ্ছেঃ ‘দি স্টোরি অফ মাই লাইফ, লেট আস হ্যাভ ফেইথ, দি ওয়ার্ল্ড আই লিভ ইন, ওপেন ডোর ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বাক-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অভিশপ্ত বিড়ম্বনা জীবনের বিষাদের ওপর একটি চলচ্চিত্র (ডেলিভারেন্ট-১৯১৯) নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রে তার নিজের ভূমিকায় তিনি নিজেই অভিনয় করেছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করা হেলেন কেলার বলতেন, ‘অন্ধত্ব নয়, অজ্ঞতা ও অনুভূতিহীনতাই দুনিয়ার একমাত্র দুর্ভেদ্য অন্ধকার। তার কিছু অদ্ভুত আচরণের কথা শোনা যায়। যেমনঃ তিনি কারো সাথে একবার হাত মিলালে অনেকদিন পরে আরেকবার হাত মিলালে বলে দিতে পারতেন তার সাথে হাত মিলানো মানুষটি কে! তিনি নাকি নৌকা চালাতে, দাবাও খেলতেন। বাদ্যযন্ত্রের উপর হাত রেখেই বলে দিতে পারতেন কেমন সুর উঠছে ও গায়ক-গায়িকাদের গলায় হাত রেখে বলতে পারতেন তারা কি গাচ্ছে। এজন্য তাকে রহস্যময়ী নারীও বলা হয়। আজ মানবতার পূজারিণী মহীয়সী নারী হেলেন কেলারের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৮ সালের আজকের দিনে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় মৃত্যুরণ করেন। চিরস্মরণীয়, বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভা হেলেন কেলারের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
হেলেন কেলার ১৮৮০ সালের ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের আলবামায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম হেলেন অ্যাডামস কেলার। হেলেন কেলারের বাবার নাম আর্থার কেলার তিনি ছিলেন সামরিক বিভাগের একজন অফিসার এবং মায়ের নাম কেইট অ্যাডামস। কেইট আডামসের ভালবাসা ও আদরে বেড়ে উঠা হেলেন শৈশবে ছিলেন ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির। কিন্তু তার এই চঞ্চলতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এক বছর সাত মাস বয়সে দুর্ভাগ্যজনক এক ঘটনা ঘটে তার জীবনে। স্নান করানোর সময় মায়ের কোল থেকে হঠাৎ পড়ে যান শিশু হেলেন। সেই আঘাতে সাময়িক জ্ঞান হারানোর পর তা ফিরে এলেও তার মা লক্ষ্য করলেন তার আদরের সন্তানের দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি একেবারেই লোপ পেয়েছে। নিরুপায় পিতামাতা তখন শরণাপন্ন হলেন ডাক্তারের নিকট। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানালেন তার এই শারীরিক বিপর্যয়ের কারণ হলো মস্তিষ্ক ও পাকস্থলীর আঘাত। আর এভাবে চিরদিনের জন্য শিশু হেলেনের জীবন থেকে হারিয়ে যায় তার কথা বলা, শোনা এবং দেখার শক্তি। জন্মের ২ বছরের মধ্যেই বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হন হেলেন কেলার । এতকিছু সত্ত্বেও তার জীবন থেমে থাকেনি। জীবন চলমান; সেই কথাই যেন তাঁর জন্য উপযুক্ত। হেলেন কেলার প্রতিবন্ধীত্ব নিয়ে বড় হতে থাকেন। যদিও তিনি এই প্রতিবন্ধীত্বকে অভিশাপ হিসেবে দেখেননি। হেলেন কেলার ছোটবেলা থেকেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। ৬ বছর বয়সে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, সহস্রাধিক যন্ত্রের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের সংস্পর্শে এসে তার জীবনে দেখা দেয় নতুন মোড়। মি.বেল তাকে ইপকিন্স ইনিস্টিউশনে ভতিব্র ব্যবস্থা করেও দেন যেখানে অন্ধ, বধিরদের শিক্ষাদান করা হয়। এখানেই হেলেন পরিচিত হন তারই মতো আরেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এনি সুলিভার সাথে। তার সাথে মিলেই হেলেন ‘ব্রেইল পদ্ধতি’ বের করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আট বছর বয়সে এনি সুলিভান নামের এক গৃহশিক্ষকের কাছে হেলেন কেলারের পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। টানা ৩২ বছর ধরে এনিই ছিলেন হেলেনের শিক্ষয়িত্রী, সঙ্গী, সহযোগী। তার গৃহশিক্ষক এনি সুলিভান নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন। এনি সুলিভান হেলেনের হাতে আঙুল দিয়ে চিহ্ন এঁকে এবং বর্ণমালা কার্ড দিয়ে বর্ণমালা শেখান। এরপর হেলেন ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেন। নরওয়েতে উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসরণ করে হেলেন কথা বলা শেখেন। ১৯০০ সালে হেলেন রেডক্লিফ কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েনের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি ১৯০৪ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার সময়ে তিনিই প্রথম প্রতিবন্ধী স্নাতক ছিলেন। স্নাতক ডিগ্রি লাভের আগেই তার প্রথম বই 'দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ' প্রকাশিত হলে তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যান।
প্রতিবন্ধী থাকা অবস্থায় শিক্ষা শেষে হেলেন কেলার একটি পত্রিকা অফিসে কাজ করেন। পরে তা ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রতিবন্ধীদেও সেবা ও শিক্ষাদানের জন্যে আত্মনিয়োগ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের অনুরোধে আহত মার্কিন সেনাদের নিয়মিত দেখতে যেতেন ও তাদের উৎসাহ যোগাতেন। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি বক্তৃতা দিয়ে আয় করতেন। তার জ্ঞান ও দৃঢ় মনোবল দেখে অনেক হতাশাগ্রস্থ মানুষ আশা ফিওে পেতো, মুগ্ধ হতো। তিনি প্রতিবন্ধী হয়েও অনেক মানুষকে শুধু কথার দ্বারাই পরিবর্তন করতে সক্ষম ছিলেন। বক্তৃতাদানের পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করতেন। তার রচিত গ্রন্থ ১২টি। তারমধ্যে 'দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ', 'লেট আস হ্যাভ ফেইথ', 'ওপেন দ্য ডোর' ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়। ‘দি স্টোরি অফ মাই লাইফ’ হলো তার রচিত আত্মজীবনী গ্রন্থ। এছাড়া তার ইচ্ছার কথাগুলো নিয়ে রচনা করেন, ‘আউট অফ দ্যা ডার্ক’। হেলেন রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও লেখালেখি করেছেন। হেলেন ছিলেন American Socialist Party-র সমর্থক। তিনি সেখানে ১৯০৯ সালে যোগদান করেন। তিনি আয়ের সুষম বণ্টন দেখতে চাইতেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসমতার শেষ দেখাই ছিল তার ইচ্ছা। তার বই ‘Out of The Dark’-এ এই বিষয়ে আলাদা আলাদা রচনা লিখেছেন। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি Eugene V Debs এর সমর্থন পেয়েছেন। ১৯১২ সালে তিনি Industrial Workers of the World (IWW)- যোগদান করেন। হেলেন ছিলেন একজন Pacifist এবং তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার জড়িত থাকার বিরুদ্ধে ছিলেন। হেলেন কেলারের সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুসম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ হেলেনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। নোবেল প্রাপ্তির পর আমেরিকার এক সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়ার আমন্ত্রণ পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হেলান কেলারের সাথে সেখানেই তার পরিচয়। হেলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান। তবে রবীন্ত্রনাথ ঠাকুরের জীবিত থাকা অবস্থায় হেলেন শান্তিনিকেতনে আসতে পারেননি। ১৯৫৫ সালে ভারতে আসেন হেলেন। সেই সময়েই দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় হেলেনকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে। ১৯৫০ সালে হেলেনের পঞ্চাশ বছরের কর্মময় জীবনকে সম্মান জানাতে প্যারিসে এক বিরাট সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। তখন তার বয়স সত্তর বছর। ১৯৫৯ সালে হেলেন জাতিসংঘ কর্তৃক বিশেষ সম্মানে ভূষিত হন।
(হেলেন কেলার এবং অ্যানি সুলিভ্যানের মর্মর মূর্তি)
১৯৬৮ সালের পহেলা জুন ৮৮ বছর বয়সে অদম্য এই নারী পরলোকগমন করেন। তবে তিনি পৃথিবীর মানুষের কাছে আজও বিস্ময়কর প্রতিভা। হেলেন কেলার এমনই এক নাম যা অন্ধ, বিকলাঙ্গ, প্রতিবন্ধী মানুষের কাছে এক আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য তিনি যা করে গেছেন, সেটা তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রেখেছে। যুগে যুগে এই মহীয়সী নারীর রেখে যাওয়া দৃষ্টান্তই হোক সকলের পথচলার মন্ত্র। প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তি মানুষকে যে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তার এক জ্বলন্ত উদারহণ হেলেন কেলার। তিনি কোটি কোটি মানুষের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ভরে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য এবং তার অসামান্য কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৭ সালে ‘আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর দি ওভারসীজ ব্লাইন্ড’ যার বর্তমান নাম হেলেন কিলার ইন্টারন্যাশনাল গঠন করা হয়েছে। আজ মানবতার পূজারিণী মহীয়সী নারী হেলেন কেলারের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৮ সালের আজকের দিনে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় মৃত্যুরণ করেন। চিরস্মরণীয়, বিস্ময়কর সাহিত্য প্রতিভা হেলেন কেলারের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সূত্রঃ American Author & Educator Helen Keller
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২০ দুপুর ২:০০