২২ মে বিশ্বব্যাপী আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। জীববৈচিত্রের কথা শুনলেই, আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দরবনের চিত্র। তবে এই সময়ে সুন্দরবন আবারও প্রমাণ করল এটি বাংলাদেশের শুধু জীববৈচিত্রের সবচেয়ে বড় আধারই নয়, তা আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচও। প্রাকৃতিক দূর্যোগে বরাবরই সুন্দরবন মাতৃসুলভ আচরণ করে আসছে। এবারও ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বাংলাদেশের লোকালয়ে আঘাত হানার আগেই তার প্রবল শক্তি হ্রাস করে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ বনটি কতবার যে ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অত্যন্ত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ থেকে রক্ষায় এবারও বুক পেতে দিল সুন্দরবন।বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবসের ধারণটির সূচনা হয় ১৯৯২ সালে। রাষ্ট্র, সরকার ও পৃথিবীর বড় বড় সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে ব্রাজিলের রিও তে শীর্ষ ধরিত্রী সম্মেলনে জীববৈচিত্র্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মূলত ১৯৯২ সালের ২২ মে কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশনে দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।আর তখন থেকেই প্রতি বছর মে মাসের ২২ তারিখ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। বিশেষত বিশ শতকের ৭০-এর দশক থেকে খাদ্য-বস্ত্রসহ মানুষের নানান ধারার চাহিদার পরিসর বিস্তৃত হওয়ার কারণে লাখ লাখ প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ১৫ হাজার তথ্য সূত্র নিয়ে ৩ বছরের গবেষণা শেষে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ‘সামারি ফর দ্য পলিসিমেকার’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনের সারমর্ম। ৪০ পৃষ্ঠার সেই সংক্ষেপ হাজির করতে গিয়ে বলা হয়েছে, মানবজাতি কীভাবে নিজেদের ‘একমাত্র বাড়ি’-কে ধ্বংস করছে; এটাই তার সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, স্থল, জল কিংবা আকাশ; সবখানেই মানুষের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে বিভিন্ন প্রজাতি। জাতিসংঘের ইন্টার গভর্নমেন্টাল সায়েন্স পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসের ১৮০০ পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদনে বিশ্বের ১০ লাখ প্রাণী বিলুপ্তির হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছে। সেখানে বলা হয়, প্রাণী জগতের ২৫ ভাগ প্রজাতিই মানুষের কারণে বিপন্নতার মধ্যে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিজেদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রাণী জগতের ১০ লাখ প্রজাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে মানুষ। জীব বৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ২২ মে দিনটি বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে উদযাপন করে আসছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে ২৯ ডিসেম্বর বিশ্ব জীব বৈচিত্র্য দিবস হিসেবে পালন করা হলেও ২০০১ সাল থেকে এটি প্রতিবছর ২২ মে পালন করা হচ্ছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও টেকসই পরিবশে রক্ষার লক্ষ্যেই এ ধরনের একটি দিবস পালন করা জরুরি হয়ে পড়ে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণে দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রকৃতি যেভাবে আবার নিজেকে নিজের মতো করে সাজাচ্ছে, তার জন্যই এবারের প্রতিপাদ্যে এসেছে ভিন্নতা। এ বছর দিবসটির স্লোগান ঠিক করা হয়েছে ‘জীববৈচিত্র্য রক্ষার সমাধান প্রকৃতিতেই’৷
মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতি মিলিয়েই আমাদের পৃথিবী নামের সবুজ গ্রহটি। বিশ্ববাসীর ব্যবহারের জন্য একটি মাত্র এ জীবমন্ডলটি রয়েছে। আমাদের এই পৃথিবীতে বাস করে হাজারো প্রাণী। তাদের নাম, পরিচিতি আর স্বভাবের কথা তুলে ধরতে গেলে হাজার পৃষ্ঠায় কোটি শব্দ লিখলেও শেষ হবে না। আধুনিক পৃথিবীতে এখন সব জায়গাতেই মানুষের পদচারণা। মানুষ এটিকে এতোটাই নির্দয়ভাবে ও নির্বিচারে ব্যবহার করছে। বর্তমানে সমস্ত বিশ্ব ব্যবস্থাই হুমকির দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রধান অনুসঙ্গই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্যই পৃথিবীর সবুজ জীবের উপযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে জীববৈচিত্র্য চরমভাবে হুমকিতে পড়ে পৃথিবীর বৈচিত্র্যময়তাকেই ধ্বংস করছে। শিল্পের বহুমুখী বিকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে যে হারে জল, বায়ু, মাটি, সবুজ এবং প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ সমূহের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তা পরিবেশ দূষণের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বময়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই করুণ। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশে একশ’ আট প্রকারের উদ্ভিদ ও প্রাণী-প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। এছাড়া ৩৩ প্রজাতির পাখি, ৩৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২১ প্রজাতির সবুজ গাছ এবং ২১ প্রজাতির মাছ এখন বিপন্ন। এছাড়া, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ক্ষেত্রে নদীর মুমূর্ষতাও একটি বড় কারণ। এক সময় বাংলাদেশে দেড় হাজারের মতো নদী ছিলো। এর মধ্যে ১৭টি নদী ইতোমধ্যেই মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। আর একশ’ ৫৮টি নদী এখন রুগ্ন। আটটি নদী বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে দেশে মাত্র একশ’ নদী রয়েছে যেগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্যে নৌ চলাচল করতে পারে। জীববৈচিত্র্য আমাদের অস্তিত্বের সুরক্ষা।তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এটি অরক্ষিত করে আমরা সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারি না। এজন্য আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, এই মাটি, ভূমি, বাতাস, পানি সবকিছুরই অংশীদার শুধু মানুষই নয় অপরাপর সব প্রাণী ও প্রজাতি। মানুষই বিভিন্ন ভাবে পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করে পৃথিবীর পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। যার ফলে বিপন্ন হচ্ছে জীব বৈচিত্র্য। দূষণের পেছনে মানুষের চাহিদা আর অবস্থানের বিষয়টি দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত । বিশেষ করে শিল্পোন্নত ২০ দেশের উৎপাদিত ৮০ শতাংশ ক্লোরো-ফ্লোরো কার্বন ডাই অক্সাইড দিচ্ছে বিশ্বের তাপমাত্রা। ফলে প্রাণীকূলের বেঁচে থাকার স্ব স্ব নির্দিষ্ট পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। যানবাহনের জন্য ব্যাপক হারে জ্বালানী ব্যবহৃত হচ্ছে। উন্নত জীবন যাত্রার জন্য বন্য প্রাণীর আবাস্থল উজাড় হচেছ । যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণেও বেড়ে চলছে বিপর্যয়। পাহাড় কাটা,নদী ও মাটির গভীর থেকে বালু তোলার মতো অবিবেচক কাজও করে চলছে মহল একটি বিশেষ। দেশের প্রতিটি জেলায় রযেছে শত শত স’ মিল । এ গুলির চাহিদা মেটাতে কিংবা ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে ও আসবাবপত্র বানাতে অবাধে নিজদের গাছ কাটা হচ্ছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে।
ঐতিহ্যের অহংকার জাতিসত্তার গর্ব দেশাত্মবোধের চর্চা আর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার তাড়নাই আমাদের পরিবেশ ও সর্বপ্রকার বৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রেরণার উৎস হতে পারে। এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের বস্তুতাস্তিকতা ধারণ করতে হবে, আর সংরক্ষণ করতে হবে জীববৈচিত্র্য। এটি অরক্ষিত করে আমরা সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকতে পারি না। এজন্য আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এটা মনে রাখতে হবে যে, এই মাটি, ভূমি, বাতাস, পানি সবকিছুরই অংশীদার শুধু মানুষই নয় অপরাপর সব প্রাণী ও প্রজাতি। জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় একটি বৈশ্বিক। এটি কোনো নির্দিষ্ঠ দেশ বা কোনো ভৌগোলিক সীমা রেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়। প্রকৃতি,পরিবেশ ও জলবায়ূর সাথে জীব বৈচিত্র্যের সম্পর্ক বিদ্যমান। পৃথিবীকে সুন্দর,পরি”ছন্ন ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করতে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশকে জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে বাঁচতে হলে একযোগে কাজ করতে হবে। ঐতিহ্যের অহংকার জাতিসত্তার গর্ব দেশাত্মবোধের চর্চা আর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার তাড়নাই আমাদের পরিবেশ ও সর্বপ্রকার বৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রেরণার উৎস হতে পারে। এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের বস্তুতাস্তিকতা ধারণ করতে হবে, আর সংরক্ষণ করতে হবে জীববৈচিত্র্য।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:০৯