রমযান মাস অত্যন্ত বরকতপূর্ণ একটি মাস। এ মাসে আল্লাহ তাআলা রোযা ফরজ করেছেন। রোযা এমন একটি আমল, অন্য কোন আমলের সঙ্গে যার তুলনাই হয় না। বান্দা এ আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার গুণে গুণান্বিত হওয়ার সুযোগ পায়। তাই এর প্রতিদানও অন্য আমল থেকে ভিন্ন। হাদীস শরীফে এসেছে যরত আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, الصوم لي وأنا أجزي به রোযা আমার জন্য। আর এর প্রতিদান আমি নিজেই দেব। বুখারী ও মুসলিম। রমজানের দান খয়রাত করা আল্লাহর কাছে খুব প্রিয়। বঞ্চিতদের দিকে হাত বাড়ালে আল্লাহ তায়ালাও আপনার দিকে রহমতের হাত বাড়িয়ে দেবেন; এটা আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, "আর তাদের (ধনীদের) অর্থ-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে"। (সূরা আল-জারিআত, আয়াত ১৯) গরিবদের দান-খয়রাত করা কোনো করুণার ব্যাপার নয়; বরং দান হলো নিজের আমলনামাকে সমৃদ্ধ করার সর্বোত্তম উপায়। মনে রাখতে হবে গরিবদের সম্পদহীন করে আল্লাহ যেমন তাদের পরীক্ষা করেন, তেমনি ধনীদেরও ধন-সম্পদ দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করেন। দান-ছাদকা গুনাহ মিটিয়ে ফেলে যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে। (সহীহুল জামে/৫১৩৬) পূত-পবিত্র নিয়তে, দায়িত্ব মনে করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যদি দান করা হয়, তাহলে তার ব্যাপক ফজিলত রয়েছে। এসব ফজিলতের কিছুটা পার্থিব এই পৃথিবীতেও লক্ষ্য করা যায়, তবে বেশিরভাগ ফজিলতই পরবর্তী জীবনের পাথেয় হিসেবে জমা থাকে। এছাড়া এ জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও পাবেন দানকারীরা। এ কারণেই দয়াময় আল্লাহ কোরানে কারিমে দান-খয়রাতের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দানের ব্যাপারে নিয়তের স্বচ্ছতার কথা বলেছেন। দান করার কিছু নীতিমালা আল্লাহ তায়ালা কোরানে কারিমে ঘোষণা করেছেন। যেমন, দান করতে হবে শুধু আল্লাহ তায়ালার জন্য। কাউকে দেখানোর জন্য নয়। দান-খয়রাত করে ভবিষ্যতে কোনো স্বার্থ হাসিলের নিয়ত করা যাবে না। আত্মপ্রদর্শনের উদ্দেশ্য কৃত দানকে নিকৃষ্টতম দান বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে ইসলামে। এছাড়া যাকে দান করা হলো তার কাছ থেকে এর বিনিময়ে কোনো সুযোগ-সুবিধাও গ্রহণ করা যাবে না। কোনো প্রকার অপচয় না করে রোজার মাসে মানুষের সেবায় দান-সাদকা করলে অভাবক্লিষ্ট মানুষের কল্যাণ হয় এবং মানবতা উপকৃত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সমগ্র মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক উদার ও দানশীল ছিলেন। রমজান মাসে যখন হজরত জিব্রাইল (আ.) নিয়মিত আসতে শুরু করতেন, তখন তাঁর দানশীলতা বহুগুণ বেড়ে যেত। (বুখারি) হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, আমি নবী করিম (সা.)-এর চেয়ে কাউকে অধিকতর দয়ালু দেখিনি। (মুসলিম) সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদারের অন্তরে দানশীলতা ও বদান্যতার গুণাবলি সৃষ্টি হতে পারে। রাসুল (সঃ) বলেছেন দান হচ্ছে দলীল। দলীল দ্বারা যেমন জমি দখল করা যায় তেমনি দান দিয়ে জান্নাত দখল করা যায়। আর ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকেই দাওয়াতী কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইসলামের হেফাজতের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন দেখা দিয়ে আসছে। এই জন্য স্বয়ং রাসুল (সঃ) তাবুকের যুদ্ধের জন্য সাহাবীদের কাছ থেকে দান নিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় রাসুল (সঃ) সাহাবিদেরকে দান করতে উৎসাহিত করেছেন। এমনকি খেজুরের এক টুকরা দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাতে বলেছেন। ধন-সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলা। তিনি যাকে ইচ্ছা উহা প্রদান করে থাকেন। এজন্য এ সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাঁর বিধি-নিষেধ মেনে চলা আবশ্যক। সৎ পন্থায় সম্পদ উপার্জন ও সৎ পথে উহা ব্যয় করা হলেই তার হিসাব প্রদান করা সহজ হবে। কিয়ামতের দিন যে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোন মানুষ সামনে যেতে পারবে না, তম্মধ্যে দুটি প্রশ্নই ধন-সম্পদ বিষয়ক। প্রশ্ন করা হবে, কোন পথে সম্পদ উপার্জন করেছ এবং কোন পথে উহা ব্যয় করেছ। অধিকাংশ মানুষ দান-খয়রাত করতে চায় না। মনে করে এতে সম্পদ কমে যাবে। তাই সম্পদ সঞ্চিত করে রাখতেই সর্বদা সচেষ্ট থাকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও খরচ করতে কৃপণতা করে। প্রকৃত পক্ষে দান-ছাদকা করলে সম্পদ কমে না। আবু কাবশা আল আনমারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি শুনেছেন রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ مَا نَقَصَ مَالُ عَبْدٍ مِنْ صَدَقَةٍ ছাদকা করলে কোন মানুষের সম্পদ কমে না।(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) বরং দান সম্পদকে বৃদ্ধি করেঃ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেনمَثَلُ الَّذِينَ يُنفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِي كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌযারা আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে তার উদাহরণ হচ্ছে সেই বীজের মত যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। আর প্রতিটি শীষে একশতটি করে দানা থাকে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অতিরিক্ত দান করেন। আল্লাহ সুপ্রশস্ত সুবিজ্ঞ। (সূরা বাকারা-২৬১)সন্দেহ নেই ধন-সম্পদ নিজের আরাম-আয়েশ এবং পরিবারের ভরণ-পোষণের ক্ষেত্রে ব্যয় করার অনুমতি ইসলামে আছে এবং অনাগত সন্তানদের জন্য সঞ্চিত করে রাখাও পাপের কিছু নয়। কিন্তু পাপ ও অন্যায় হচ্ছে, সম্পদে গরীব-দুঃখীর হক আদায় না করা। অভাবী মানুষের দুঃখ দূর করার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা। অথচ আল্লাহ বলেনঃوَالَّذِينَ فِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَعْلُومٌ، لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِএবং তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে। ভিক্ষুক এবং বঞ্চিত (অভাবী অথচ লজ্জায় কারো কাছে হাত পাতে না) সকলের হক রয়েছে। (মাআরেজ- ২৪-২৫)রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃমানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ অথচ তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সম্পদই শুধু তার। যা খেয়ে শেষ করেছে, যা পরিধান করে নষ্ট করেছে এবং যা দান করে জমা করেছে- তাই শুধু তার। আর অবশিষ্ট সম্পদ সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা নিয়ে যাবে। (মুসলিম) সামর্থ থাকতেও দান না করাটা মুনাফেকি। মহান আল্লাহ বলেন, তাদের মধ্যে এমনও কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর কাছে অংগীকার করেছিল, যদি তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদের ধন্য করেন তাহলে আমরা দান করবো এবং সৎ হয়ে যাবো৷ কিন্তু যখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে বিত্তশালী করে দিলেন তখন তারা কার্পণ্য করতে লাগলো এবং নিজেদের অংগীকার থেকে এমনভাবে পিছটান দিল যে, তার কোন পরোয়াই তাদের রইল না ৷ ফলে তারা আল্লাহর সাথে এই যে অংগীকার ভংগ করলো এবং এই যে, মিথ্যা বলতে থাকলো, এ কারণে আল্লাহ তাদের অন্তরে মুনাফিকী বদ্ধমূল করে দিলেন, তার দরাবারে তাদের উপস্থিতির দিন পর্যন্ত তা তাদের পিছু ছাড়বে না ৷ [সুরা তাওবার ৭৫ -৭৭] রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللَّهِ كَانَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍযে ব্যক্তি আল্লাহর পথে কোন কিছু ব্যয় করবে তাকে সাতশত গুণ ছওয়াব প্রদান করা হবে।(আহমাদ, সনদ ছহীহ) রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেনঃ যে ব্যক্তি নিজের হালাল কামাই থেকে- আল্লাহ হালাল কামাই ছাড়া দান কবুল করেন না- একটি খেজুর ছাদকা করে, আল্লাহ উহা ডান হাতে কবুল করেন অতঃপর তা বৃদ্ধি করতে থাকেন- যেমন তোমরা ঘোড়ার বাচ্চাকে প্রতিপালন করে থাক- এমনকি উহা একটি পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।” (বুখারী ও মুসলিম)
মাহে রমজানে দানের ফজিলত অনেক বেশি। অন্য ১১ মাসের তুলনায় এ মাসে অধিক দান-সাদকা করা উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতদের বাস্তব শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে রমজান মাসে দান-দক্ষিণা ও বদান্যতার হাত বেশি করে প্রসারিত করতেন। মাহে রমজানে তাঁর দানশীলতা অন্যান্য মাসের তুলনায় বৃদ্ধি পেত। এ মাসটিকে তিনি দানশীলতার ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাই রমজানের এখনো যে কটা দিন সময় আছে, সুযোগ আছে দায়িত্ব পালন করার, দান-খয়রাত করার, গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানোর, এতিম-মিসকিনদের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয়ার, তাদের তা করার সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। মহান আল্লাহ এই রমজান মাসে আমাদের সাধ্যমতো দান খয়রাত করে তার পূর্ণ ফজিলত লাভের তৌফিক দান করে । আমিন
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০২০ বিকাল ৪:৫৯