ওসামা বিন মুহাম্মদ বিন আওয়াদ বিন লাদেন। যিনি সাধারনত ওসামা বিন লাদেন বা উসামা বিন লাদেন নামে পরিচিত। অনেক দিন ধরেই লাদেনের নাম যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী তালিকায় ছিল৷ কিন্তু টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনার পর তার নাম একেবারে শীর্ষে চলে আসে৷ শুধু অ্যামেরিকায় নয়, সারা বিশ্বেই সন্ত্রাসবাদের বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন বিন লাদেন৷অন্য কয়েকজন ইসলামী জঙ্গীর সাথে মিলে ওসামা বিন লাদেন দুইটি ফতোয়া জারি করেন; একটি ১৯৯৬ সালে, অন্যটি ১৯৯৯ সালে । তার ফতোয়াটি ছিল, ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের উচিত মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক জনগণকে হত্যা করা যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি সব সহায়তা বন্ধ করে এবং সব মুসলিম দেশ থেকে সামরিক শক্তি অপসারণ করে। আল-কায়েদার উৎপত্তি হয় ১৯৭৯ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেন এবং আরব মোজাহিদীনদের সংগঠিত করে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। আয়মান আল-জাওয়াহিরির নির্দেশনায় বিন লাদেন আরও তৎপর হয়ে ওঠেন। ১৯৯৬ সালে বিন লাদেন তার প্রথম ফতোয়া জারি করেন এবং মার্কিন সেনাদের সৌদি আরব ত্যাগ করতে বলেন। ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আল কায়েদার একইসাথে চারটি সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয় যা নাইন/ইলেভেন নামেও পরিচিত। এই আক্রমনের ২,৯৯৭ জন নিহত এবং ৬,০০০ এর অধিক মানুষ আহত হয়, এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক অবকাঠামো ও সম্পদ যার মধ্যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নামে খ্যাত টুইন টাওয়ার অন্যতম। টুইন টাওয়ার হামলার প্রায় দশ বছর পর টুইন টাওয়ার হামলার প্রায় দশ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে নিহত হন আল কায়েদার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেন। ২০১১ সালের আজকের দিনে তিনি পাকিস্তানের আ্যবোটাবাদ শহরে মার্কিন কমান্ডোদের হামলায় ওসামা বিন লাদেন মারা যান। আজ তার নবম মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে শ্রদ্ধা বা নিন্দা জানানের ভার পাঠকের নিজের।
(Osama Childhood Picture)
ওসামা বিন মুহাম্মাদ বিন আওয়াদ বিন লাদেন ১৯৫৭ সালের ১০ই মার্চ সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বিন লাদেন এক ধর্মপ্রাণ সুন্নী মুসলিম পরিবারে লালিতপালিত হন। তার পিতা ইয়েমেন বংশোদ্ভূত মুহাম্মাদ বিন আওয়াদ বিন লাদেন যার সৌদি রাজ পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সৌদি আরবের প্রায় ৮০ ভাগ সড়কের নির্মাণকাজ করেছেন৷ ফলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধনী একজন ব্যক্তি৷ ওসামা বিন লাদেন ছিলেন তার ৫২ সন্তানের মধ্যে ১৭তম। বিন লাদেনের পিতা মুহাম্মাদ ১৯৬৭ সালে সৌদি আরবে একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। পিতা মুহাম্মাদ বিন লাদেনের পর ওসামা বিন লাদেনের সবচেয়ে বড় সৎভাই সালেম বিন লাদেন ছিলেন বিন লাদেন পরিবারের প্রধান। বিন লাদেন পরিবার কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রিতে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে। যা থেকে ওসামা উত্তরাধিকারসূত্রে ২৫-৩০ মিলিয়ন ডলার প্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি অভিজাত ধর্মনিরপেক্ষ আল ছাগের মডেল স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি বাদশাহ আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি এবং ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেন। কারো দাবি, তিনি ১৯৭৯ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন।আবার কারো দাবি, তিনি ১৯৮১ সালে লোক প্রশাসনে ডিগ্রি অর্জন করেন। কেউ কেউ দাবি করেন যে তিনি"কঠোর পরিশ্রমী" ছিলেন। অন্য একটি পক্ষের দাবি, তিনি কোন ডিগ্রি অর্জন ছাড়াই তৃতীয় বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে বিন লাদেনের প্রধান আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম। সেখানে তিনি কুরআন এবং জিহাদের ব্যাখ্যা এবং দাতব্য কাজ উভয়ের মধ্যে জড়িত হন। কবিতা লেখার প্রতিও তার ঝোঁক ছিল। অধ্যয়নকালে ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মন্টোগোমারী এবং শার্ল ডে গোল তার প্রিয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল। কালো ফাহল ঘোড়া তার পছন্দের তালিকায় ছিল। এছাড়া ফুটবল খেলাও তার প্রিয় ছিল। তিনি আক্রমণ ভাগের খেলা বেশি উপভোগ করতেন। তিনি ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের ভক্ত ছিলেন।ওসামা বিন লাদেনের দেহরক্ষী (১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত) নাসের আল বাহরি বিন লাদেনের ব্যাপারে নিজের স্মৃতিকথায় বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি বিন লাদেনকে একজন ভীষণ নম্র ও মিশুক মানুষ এবং সচেতন পিতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রায়ই তার সন্তানদের নিয়ে মরুভূমিতে আনন্দ অনুষ্ঠান করতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ওসামা বিন লাদেন ১৯৭৪ সালে ১৭ বছর বয়সে বিন লাদেন সিরিয়ার লাতাকিয়াতে নাজওয়া গানেমকে বিবাহ করেন।টুইনটাওয়ারে আক্রমণের ঘটনার আগেই তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। বিন লাদেনের অন্য স্ত্রীরা হলেন, খাদীজা শরীফ (বিয়ে: ১৯৮৩, বিচ্ছেদ: ১৯৯০) খাইরিয়াহ সাবের (বিয়ে: ১৯৮৫) সিহাম সাবের (বিয়ে: ১৯৮৭) এবং আমাল আস সাদাহ (বিয়ে: ২০০০)। কিছু সূত্র নাম না জানা ষষ্ঠ স্ত্রী থাকার কথা দাবী করে। যার সাথে বিয়ের কিছুদিনের মাঝেই বিচ্ছেদ ঘটে যায়। বিন লাদেন তার স্ত্রীদের গর্ভজাত বিশ থেকে ছাব্বিশজন সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার পর তারা পালিয়ে যান পাকিস্তানে। তবে বিন লাদেনের কিছু সন্তান ইরানে পালিয়ে যায়। লাদেন কয়েক মাস কোহাতের সালমান তালাব এলাকাতে কাটায়। এরপর লাদেন দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের কয়েকটি জায়গায় পালিয়ে বেড়ান। ২০০৪ সালে তিনি চলে যান সোয়াত উপত্যকার শাংলাতে। আর তার কিছুদিন পরই ইসলামাবাদের অদূরে হরিপুরে আশ্রয় নেন তারা। শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের গ্রীষ্মে তারা চলে আসেন অ্যাবোটাবাদের সেই বাড়িটিতে যেখানে তি্নি মার্কিন বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। বিন লাদেন ২০০৫ সালে পাকিস্তানের আ্যবোটাবাদ শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির মাত্র ১০০০ ফুট দূরে লাদেনের এই গোপন আস্তানাটি নির্মাণ করেন। তিন তলা সেই বাড়িতে থাকতো মোট ২৮ জন। যাদের মধ্যে ছিলেন লাদেন ছাড়াও তার তিন স্ত্রী ও আট ছেলেমেয়ে। ২০১১ সালের ২ মে সেখানেই মার্কিন বাহিনীর অভিযানে লাদেনসহ পাঁচ জন নিহত হয়। বাকিরাও গ্রেফতার হন। লাদেনের মরদেহ মার্কিন কমান্ডোরা হেলিকপ্টারযোগে প্রথমে আফগানিস্থানে এবং পরে মার্কিন রণতরীতে নিয়ে যায়। লাদেনের দেহ ডিএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে শনাক্ত করা হয়। শনাক্তকরণের শেষে ইসলামী প্রথানুসারে মরদেহ আরব সাগরে দাফন করা হয়।আজ আল কায়েদা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের নবম মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে শ্রদ্ধা বা নিন্দা জানানের ভার পাঠকের নিজস্ব এখতিয়ার। আমি শুধু ইতিহাস তুলে ধরলাম।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২০ বিকাল ৪:২৯