২৯ শে এপ্রিল, ২০২০, বুধবারঃ আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ২৯তম বার্ষিকী। এদিন ‘ম্যারি এন‘ নামক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় পূরো উপকূল। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। রাতের নিস্তব্ধতা এবং অন্ধকার ভেদ করে মুহূর্তের মধ্যে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, বাশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সীতাকুণ্ড পতেঙ্গাসহ উপকূলীয় এলাকা। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাত।পরদিন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলীলা দেখে। কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল রাতে বাংলাদেশে-র দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচচ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘন্টা)। প্রলয়ঙ্কারী এই ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলবর্তী জেলাগুলোতে প্রথম ধাক্কায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। মারা যায় ২০লাখ গবাদি পশু। গৃহহারা হয়েছিল ৫০ লক্ষ মানুষ।চট্টগ্রামের বাঁশখালীরই প্রায় ১২ হাজার মানুষ মারা যায়। এই ঘূর্ণিঝড়ে কেউ বাবা, মা, ভাই বোন এবং আত্মীয়স্বজন সবাইকে হারিয়েছিল। কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় এমন বহু পরিবার আছে যাদের কোন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তখন। দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকের।
(১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়, Visible satellite image from 06:23 UTC on April 29, 1991)
ঘূর্ণিঝড় বা ঘুর্নিবাত্যা হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্র ও প্রচন্ড ঘূর্ণি বাতাস সম্বলিত আবহাওয়ার একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া (low pressure system) যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে।সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা অনেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করেছেন। ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ১৯৭০ সালের পর প্রায় এক ডিগ্রী ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই এক ডিগ্রী ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী এবং বেশী সংখ্যায় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘুর্নিঝড়। ঘুর্নিঝড়ের ঘুর্নন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দুর্যোগের সৃষ্টি হয়, কিন্ত্ত এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপের ভারসাম্য রক্ষা করে। গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ টি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়, কিন্ত্ত যে অল্প সংখ্যক ঘূর্ণিঝর উপকূলে আঘাত হানে ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে তার একটি ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝর ম্যারি এন। বাংলাদেশ তথা উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় না। তার পরিবর্তে, আরব সাগর এলাকায় উৎপন্ন ঝড়গুলোকে A এবং বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন ঝড়গুলোকে B অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ শে এপ্রিল যে ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল তার পরিচয় TC-02B হিসেবে, তার মানে এটি ছিল ১৯৯১ সালে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়।
১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল ভয়ংকর এই ঘূর্ণিঝড়ে আ্নুমানিক প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ‘ম্যারি এন’ নামক এই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আর এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় পূরো উপকূল। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, আনোয়ারার উপকূলবাসীসহ সারা বাংলাদেশের মানুষকে সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্বজন হারানোর বেদনা আজও অশ্রু ভারাক্রান্ত করে তুলে। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬৬ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। মারা যায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গৃহহারা হয় দেড় কোটি পরিবার। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি। শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রলয়ঙ্করি এই ধ্বংসযজ্ঞের ২৩ বছর পার হতে চলেছে। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি। ঘরবাড়ি হারা অনেকে মানুষ এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। এই ঘুর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। এখনো বাঁশখালীর ১৮ কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধ নেই। তাই আতঙ্কে আছেন লক্ষাধিক মানুষ। এ উপজেলার বড়ঘোনা, সরল, ছনুয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা, ইলশা, প্রেমাশিয়া এলাকার মানুষ এখনো প্রতি বর্ষায় নির্ঘুম রাত কাটান। এই ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকের। স্বজন হারানোর বেদনায় এখনো কাঁদে হাতিয়ার বাসিন্দারা।
(১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পর নিহত মানুষের লাশ পড়েছিল উপকূলজুড়ে। ফাইল ছবি)
ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২৪ বছর অতিবাহিত হলেও উপকূলীয় মানুষের সুরক্ষায় নেয়া হয়নি কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। দ্বীপের চারপাশে নির্মাণ করা হয়নি মজবুত কোনো বেড়িবাঁধ। তাই প্রতি বছর জোয়ার ও বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় দ্বীপের শতশত একর জমির ফসল। সাগরে কোনো লঘুচাপ, নিম্নচাপ কিংবা মেঘ দেখলেই আতঙ্কে চমকে ওঠেন উপকূলবাসী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীদের রক্ষায় কুতুবদিয়া দ্বীপে এখনো স্থায়ী কোনো বেড়িবাঁধ হয়নি। বরং মাঝে মধ্যে কিছু অংশ সংস্কার বা নির্মাণ হলেও যথাযথভাবে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অথচ ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে এ দ্বীপের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। বর্তমানে ওই দ্বীপের সোয়া লাখ মানুষের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে মত্র ৯১টি। আর এসব আশ্রয় কেন্দ্রের অধিকাংশই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্রের পিলার ও ছাদের রড নিয়ে গেছে চোরের দল। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বাঁধসমূহ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলায় দেড় কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ১ কোটি লোক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এখনো অরক্ষিত। বর্তমানে দেশের উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার এলাকায় নির্মিত ১ হাজার ৮৪১টি সাইক্লোন শেল্টারের মধ্যে বেশিরভাগই অকেজো হয়ে পড়েছে। আর যে ক’টি সাইক্লোন শেল্টার চালু রয়েছে তাতে আশ্রয় নিতে পারবে মাত্র ১০ লাখ লোক। নিজস্ব ব্যবস্থায় আরো ৪০ লাখ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারলেও বাকি ১ কোটি মানুষেরই প্রাকৃতীক দুর্যোগে কোনো আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেই। এমনকি চট্টগ্রাম শহর রক্ষাবাঁধের বিরাট অংশ এখন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে নেয়া পরিকল্পনার মধ্যে স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার কিছু বাস্তবায়ন হলেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাসমূহের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। উপকূলীয় এলাকা ও দ্বীপাঞ্চলে যে পরিমাণ সাইক্লোন শেল্টার সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তাও করা হয়নি। তার ওপর বিদ্যমান সাইক্লোন শেল্টারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহার অনুপযোগী। কোথাও কোথাও সাইক্লোন শেল্টার সাগর ও নদী ভাঙনের কারণে অস্তিত্ব হারিয়েছে। সরকার উপকূলীয় এলাকায় মানুষকে প্রাকৃতীক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় নতুন করে সাড়ে ৩ হাজার আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া উপকূল রক্ষায় সবুজ বেষ্টনীর নামে গৃহীত বনায়ন প্রকল্পও উজার হয়ে গেছে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠের নামে।
১৯৯১ এর ভয়াল ২৯ এপ্রিলের মানবিক বিপর্যয়ের পরেও উপকুল আজও নিরাপদ নয়। ঘন ঘন এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানলেও ওসব এলাকার জননিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। তাদের সুরক্ষার জন্য কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছে না। দূর্যোগের ২৮ বছর পরেও নেই দূর্য়োগ মোকাবেলার প্রস্তুতি। বেড়িবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা এখনো সম্পন্ন হয়নি। ভয়াল সেই দুঃসহ স্মৃতির ২৮বছর পেরিয়েও এসব ভাগ্যহত মানুষ কান্নায় বুক ভারী করেন আর একটি স্থায়ী বসতভিটার আশায় দিন গোনেন। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াল সেই ঘূর্ণিঝড়ের স্বজন হারা মানুষদের জন্য আমাদের গভীর সমবেদনা।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২০ সকাল ১০:২২