প্রতিবছর ২৭ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব নাট্য দিবস World Theater Day) থিয়েটার বা নাটক আসলে আমাদের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি| শিল্প জগতে বিভিন্ন মাধ্যম বিভিন্নভাবে নিজেদের কথা বলে| থিয়েটার, জগতের কথা বলে, জীবনের কথা বলে নিজেদের মত করে সামগ্রিকভাবে| একবিংশ শতাব্দিতে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্বে দিনের পর দিন বাড়তে থাকা হিংসা, হানাহানি, অরাজকতা, বিশ্বাসঘাতকতা, সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতা আমাদের প্রতিনিয়ত ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছে তখন একমাত্র থিয়েটার-ই পারে এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের মননকে তৈরী করতে। অর্থাৎ যে কোনও অনৈতিক কাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো এবং তার থেকে উত্তরনের পথ খুঁজে বের করার মত বলিষ্ঠ মাধ্যম বোধহয় থিয়েটার বা নাটক ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা| যুদ্ধবিগ্রহ, পীড়ন আর দখলদারি, জাতিদাঙ্গা আর রাজনৈতিক হত্যা আর এ সবের সমান্তরালে ভাগ্যবানদের স্বাচ্ছন্দ্য, অফুরন্ত বিনোদন, ফুর্তি আর মজা লুণ্ঠনের অবিরাম সুখ আর সব ধরনের অনুকূল-প্রতিকূলকে ঘটমান সব ব্রেকিং নিউজকে এড়িয়ে ২৭ মার্চেই চেনা-অচেনা নাট্যকর্মীদের ঈদ আর বিজয়া, কোলাকুলি আর আড্ডা, এক সঙ্গে জড়ো হয়ে নাট্যাভিনয় আর বছর বছর বাণীপাঠ। ৫৮ বছর ধরে চলমান এই টুকুই নাটকের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিই) কর্তৃক ১৯৬১ সালে বিশ্ব থিয়েটার দিবসের প্রবর্তন হয়। প্রতিবছর ২৭ মার্চ আইটিই কেন্দ্রসমূহ এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটার কমিটি দিবসটি পালন করে। দিবসটি উদযাপন করতে বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চনাটক অনুষ্ঠান প্রদর্শিত হয়। এর মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে- এই দিবস উদযাপন লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউটে একজন তারকা মঞ্চনাটকের মাধ্যমে, আইটিইর শান্তির সংস্কৃতি বিষয়ক এক বিশেষ বাৰ্তা প্রেরণ করে। প্ৰথম বিশ্ব থিয়েটার দিবসের আন্তর্জাতিক বাৰ্তা ১৯৬২ সালে ফ্রান্সের জিন কোকটিয়াও লিখেছিলেন। প্ৰথমে হেলসিঙ্কি এবং তারপর ভিয়েনায় ১৯৬১ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত আইটিইর নবম আলোচনাসভায় আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউটের ফিনিশ কেন্দ্রের পক্ষে অধ্যক্ষ আর্ভি কিভিমায় বিশ্ব থিয়েটার দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কেন্দ্রসমূহে এটাকে সমৰ্থন দেয়ার পরই দিবসটির বিশ্বব্যাপি প্রচলন শুরু হয়। এই দিনে প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক একটি বার্তা দেওয়া হয় থিয়েটারের পক্ষে, যা বিশেষ করে শান্তির বার্তা বয়ে আনে। ১৯৬২ সালে ফ্রান্সের জীন ককটু দ্বারা প্রথম বিশ্ব থিয়েটার দিবসের আন্তর্জাতিক বার্তা লিখিত হয়েছিল।
১৯৬২-তে আমন্ত্রিত বিশিষ্ট নাট্যজন হিসেবে প্রথম বক্তৃতা করেছিলেন জাঁ ককতো। পরের বছর আর্থার মিলার। তার পর থেকে পাবলো নেরুদা, আয়োনেস্কো, ওলে সোয়িঙ্কা, পিটার ব্রুক, এডওয়ার্ড এলবি, ভাচলভ হাভেল, আগস্তো বোয়াল-সহ কত বিশিষ্ট জন যে বিশ্ব নাট্য দিবসের বক্তৃতা করেছেন! ২০১৫ সালে বছর বিশ্ব নাট্য দিবসের বক্তৃতা করেছেন পোল্যান্ডের নাট্যবিদ ক্রিস্তফ ওয়ারলিকাউস্কি, যিনি ওয়ার্শ-র Nowy Teatr (নিউ থিয়েটার)-এর শিল্পনির্দেশক এবং নতুন ধারার নাট্যপরিচালক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। যত বয়স বাড়ছে, ২৭ মার্চের ভূগোল তত প্রসারিত হচ্ছে। আজকের থিয়েটার কিন্তু আঙুল চেটেপুটে খাওয়া বহুভোগ্য বিনোদনী ফুড-প্লাজার বাইরে নিঃশব্দে প্রবল পরাক্রমে প্রভাবের আর চর্চার ভূগোল বাড়িয়ে চলেছে। তাই ইউনেসকোর তত্ত্বাবধানে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বা আইটিআই গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রায় একশো শাখা খুলে ফেলেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। সেই কেন্দ্রগুলি থেকে কুড়িটি ভাষায় ২৭ মার্চের বক্তৃতা ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের পাহাড়ি জনপদ কিংবা ক্রিকেটের সূত্রে সুপরিচিত আরবের মরুশহর অথবা জঙ্গলঘেরা আফ্রিকার উপজাতি-অধ্যুষিত গ্রামেও এখন বিশ্ব নাট্য দিবস পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশেষ মর্যাদায় এই দিনটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এই ধারাবাহিকতায় আজ শুক্রবার ন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (বাংলাদেশ কেন্দ্র), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ সম্মিলিতভাবে এ দিবসটি উদ্যাপন করবে। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এবারের বিশ্ব নাট্য দিবসের অনুষ্ঠান সীমিত থাকবে। সবাইকে বিশ্ব নাট্য দিবসের শুভেচ্ছা।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০২০ সকাল ১০:৩৮