১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বোধীন জোটের টানা কর্মসূচি ও গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এরশাদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তার ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দিবসটি পালন করে ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে। বিএনপি পালন করে ‘স্বৈরাচার পতন ও গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’ হিসেবে। তবে দুঃখের বিষয় সামরিক স্বৈরাচারের কয়েক বছর না যেতেই ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসাবে পালনের জন্য ইনতেজাম শুরু হয়ে যায। শফিক রেহমান সম্পাদিত যায়যায়দিন পত্রিকার হাত ধরে প্রেম-ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক সম্পর্ককে অতিপ্রাকৃত বিষয়ে পরিণত করার সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে তার অফিসের সামনে একটি সড়কের নামকরণও করেন 'লাভ লেন'। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদদের লেখায় উঠে এসেছে, মূলত প্রাচীন দু’টি রোমান প্রথা থেকেই ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবস -এর সূত্রপাত। খ্রিস্টান এক চিকিৎসক ফাদার ও পাদ্রী সেন্ট ভ্যালেনটাইনের নামানুসারে এই দিনটি `ভ্যালেনটাইনস ডে` হিসেবে নামকরন করা হয়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেনটাইনকে মৃত্যুদন্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তাঁর আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে নিজের স্বাক্ষর হিসেবে লিখেছিলেন `ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন`। এরপর পরবর্তী বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনকে তাঁর মেয়ে এবং মেয়ের প্রেমিক মিলে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে উদযাপন করা শুরু করে। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত ভ্যালেন্টাইনকে ভালবেসে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে উদযাপনের রীতিটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।আর তা থেকেই শুরু হয় ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ বা ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ -এর রীতি। পরবর্তীতে চিত্রনায়িকা, ফ্যাশন শো, লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার, সিনেমা, নাটক, যাত্রা, অশ্লিল নৃত্যের সিডি, ইন্টারনেটে পর্ণগ্রাফির ছড়াছড়ি, এফএম রেডিও-র মধ্যরাতের অশ্লিল অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব মিলিয়ে বিকৃত যৌনতা-অশ্লীলতার চর্চা যেন বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে পরিণত হয়েছে। আর ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ উদযাপনের সংস্কৃতি ঠিক এ জোয়ারকেই জোরদার করছে। আমাদের দেশের ছাত্র-যুব সমাজকে দেশপ্রেমিক, জাতি ও জনগণের সেবক হিসাবে গড়ে না তুলে, নৈতিক অবক্ষয়ের চরমে ঠেলে দেয়ার সবরকম আয়োজন চলছে।
'বিশ্ব ভালোবাসা দিবস' নামে যে দিবস সারা পৃথিবীতে পরিচিত সে্টি এমন একটা দিন, যে দিনে কিছু যুবক-যুবতী এমন সব অনাচার-অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়, যার কারণে পুরো পৃথিবীটাই একটি অসভ্য ভুমিতে পরিণত হয়। আজ মুসলিম বিশ্বের বহু স্থানে ঠিক এটাই ঘটছে, মুসলিমরা তাদের চালচলন, রীতিনীতি এবং উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে ইহুদী ও খ্রীস্টানদের অনুসরণ করছে ৷ টিভি, পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, স্যাটেলাইট চ্যানেল, ইন্টারনেটের মত মিডিয়ার প্রচারে অবিশ্বাসীদের অনুসৃত সমস্ত বিজাতীয় রীতিনীতি আজ মুসলিমদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচেছ এবং এর অনুসরণ ও অনুকরণ সহজতর হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেইটাইন উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়। সম্প্রতি পাকিস্তানেও ২০১৭ সালে ইসলামবিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে সেদেশের আদালত। সম্প্রতি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশের তরুণদের অনেকেই এই জোয়ারে ভাসতে চান না। তারা জাফর, জয়নাল, দিপালী, কাঞ্চনসহ লাখো শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে এই লড়াই চালিয়ে যেতে চান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন বা জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে বাছাই করেছেন এবং তিনি অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা কখনও গ্রহণ করবেন না, তিনি বলেন "এবং যে কেউই ইসলাম ছাড়া অন্য কোন জীবন-ব্যবস্থা আকাঙ্খা করবে, তা কখনোই তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না, এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন ৷” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৮৫)এবং নবী(সা.) বলেছেন, এই উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক বিভিন্ন ইবাদতের প্রক্রিয়া ও সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রে আল্লাহর শত্রুদের অনুসরণ করবে ৷ আবু সাঈদ আল খুদরী(রা.) বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেনঃ "তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণে লিপ্ত হয়ে পড়বে, প্রতিটি বিঘৎ, প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্যে [তাদের তোমরা অনুসরণ করবে], এমনকি তারা সরীসৃপের গর্তে প্রবেশ করলে, তোমরা সেখানেও তাদেরকে অনুসরণ করবে ৷” আমরা বললাম, "হে রাসূলুল্লাহ ! তারা কি ইহুদী ও খ্রীস্টান?” তিনি বললেন: "এছাড়া আর কে?” (বুখারী, মুসলিম)
মুসলিম সমাজে প্রচলিত এরূপ বহু অপসংস্কৃতির সাথে একটি সাম্প্রতিক সংযোজন হচেছ "ভ্যালেন্টাইন’স ডে”, যা "ভালবাসা দিবস” নামে বাঙালী মুসলিম সমাজের যুবক-যুবতীদের মাঝে ঢুকে পড়েছে এবং ক্রমে জনপ্রিয়তা লাভ করছে, পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এ দিবসটি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে ৷Valentaine's Day পালন করা একজন মুমিন মুসলমানের জন্য সম্পূর্ণ হারাম এবং কুফরী | কেননা এটি ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের তৈরী করা একটি অপসংস্কৃতি | কোরান , সুন্নাহ , ইজমাহ ও কিয়াসের মধ্যের যার কোন শরীয়ত সম্মত বিধান বা অস্তিত্ব নেই | বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩৬৪ দিন মানুষকে ধোঁকায় ফেলে শয়তান যতটা না বিজয়ী হয়, তার চেয়ে শয়তান বেশি বিজয়ী হয় এই দিনে। ‘‘যারা মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি..।’’ (সূরা আন-নূর :১৯) ই দিবসের সঙ্গে কোনো মুসলিমের সম্পর্ক থাকতে পারে না। কারন মুসলিমদের প্রতিটি দিনই ভালোবাসার। তাই ১৪ ই ফেব্রুয়ারী: বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নয়, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করুন আর ভ্যালেন্টাইন’ সংস্কৃতিসহ অশ্লীলতা, যৌনতা ও নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধে গড়ে তুলুন! কারণ ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন ডে! যদিও সত্যিকারের ভালোবাসার কোন দিবস নেই বলেই আমরা মনে করি। ভালবাসা দিবস প্রতিদিন, প্রতিক্ষন। তরুণ-তরুণীদের মাঝেই ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ট্রেন্ডটা দেখা গেলেও দিনটি আসলে পৃথিবীর সকল ভালোবাসার জন্য। দিনটি হতে পারে মা-ছেলের ভালোবাসা উদযাপনের দিন কিংবা মানুষে-মানুষে ভালবাসার দিবস। ''আদ্দিনু ওয়ান্ নাসিহা'' ''দ্বীন মানেই হলো কল্যাণ কামনা (ভালোবাসা, উপকার...)'', সুবহানাল্লাহ। ক্বুরআনের প্রত্যেকটি পাতায় পাতায় কেবল ভালোবাসার কথা।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
nuru.etv.news@gmail.com
উৎসর্গঃ সহ-ব্লগার হাসুমামাকে
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:২১