ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সংঘটিত ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ। ইতিহাসে যে সকল মনীষী তাদের কর্মতৎপরতা আর সাধনার জন্য পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছেন তাদের মধ্যে হাজী শরীয়াতুল্লাহ অন্যতম। তিনি শুধু একজন ধর্মীয় সংস্কারকই নন, তিনি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠারও দিশারী। তিনি ছিলেন একাধারে ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী এবং ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা। আরব দেশের অন্তর্গত নেজদের অধিবাসী মুহম্মদ ইবন আবদুল ওহাব এক সংস্কার আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি পরিত্যাগ করে পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীসের নির্দেশিত সরল-সঠিক পথে মুসলিম মিল্লাতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করারই এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল। তার মৃত্যুর পর নেজদের শেখ মুহম্মদ ইবন সউদ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মক্কা ও মদিনায় এর প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এবং হজ্জের সময় মুসলমানদের নিকট এই সংস্কার বাণীর প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে দুইটি সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠে। উত্তর ভারতে সৈয়দ আহমদ শহীদ তরীকায়ে মুহম্মদিয়া নামক আন্দোলন শুরু করেন। বাংলাদেশে হাজী শরীয়াতুল্লাহ ফরায়েজী আন্দোলন শুরু করেন।কৃষক, তাঁতি তথা শ্রমজীবী মানুষকে যুগ যুগের শোষণ-বঞ্চনা এবং বিদেশী শাসন-শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য পরিচালিত তার এই আন্দোলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর শরীয়তুল্লাহর নামানুসারে বাংলাদেশের শরিয়তপুর নামকরণ করা হয় এবং ১৯৮৪ সালে শরীয়তপুর জেলায় উন্নীত হয়। এছাড়া তার নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল খাঁ নদের উপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে হাজী শরীয়তউল্লাহ সেতু। আজ ফরায়েজি আন্দোলনের মহানায়ক হাজী শরীয়তুল্লাহর ১৮০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৪০ সালের আজকের দিনে তিনি ঢাকা জেলায় মৃত্যুবরণ করেন। নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী এবং ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
হাজী শরীয়াতুল্লাহ ১৭৮১ সালে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত শামাইল নামক গ্রামে এক মধ্যবিত্ত মুসলিম তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল তালুকদার। তিনি ছিলেন একজন ভদ্র, দয়ালু ও একজন প্রজাবৎসল জমিদার। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতা আবদুল জলিল ইহলোক ত্যাগ করে পরজগতে চলে যান। শরীয়তুল্লাহ'র মা (নাম জানা যায়নি) তাঁর বাবার আগে মারা যান। শরীয়াতুল্লাহ তখন তাঁর চাচা মুহাম্মদ আজিম ও তাঁর স্ত্রীর আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। শরীয়তুল্লাহর পড়াশুনার হাতেখড়ি তাঁর পরিবারে। বিশেষ করে বাবার কাছে। তারপর গ্রামের মক্তবে। ১৭৯৩ সালে ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে রাগ করে তিনি কলকাতা চলে যান। কলকাতায় যান মাওলানা বশারত আলীর নিকট কুরআন শরীফ শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি ফুরফুরাতে আরবী ও ফার্সি ভাষায় অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৭৯৯ সালে তারই প্রিয় ওস্তাদ মাওলানা বশারত আলীর সাথে পবিত্র হজ্জব্রত পালন করতে মক্কা শরীফ গমন করেন। সেখানে গিয়ে মুরাদ নামক এক বাঙালি শিক্ষকের নিকট ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এরপর তাহের সম্বল নামক এক হানাফী শাস্ত্রবিদের অধীনে শিক্ষালাভ করতে থাকেন এবং তারই নিকট কাদেরিয়া তরীকার সুফী মতবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেন। দুই বছর কায়রোর জামিয়া আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। আরব দেশে অবস্থানকালে শরীয়াতুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের নিকট সাক্ষাৎ করে সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন এবং এর আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হন। ১৮১৮ সালে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি মুসলমান সমাজের মধ্যে নানাবিধ কুসংস্কার ও অনৈসলামিক রীতিনীতি লক্ষ্য করলেন। চারদিকে শিরক আর বিদআতের সয়লাভ। মুসলমানরা দলে দলে তাদের ঈমানকে বিকিয়ে দিচ্ছে। আর সে সময় মুসলমানরা তাদের অধিকার সম্পর্কে মোটেও সচেতন ছিল না। উদাসীন একটা ভাব তাদেরকে সার্বক্ষণিক তাড়া করে ফিরতো। জমিদার নীরকরদের অত্যাচারে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। তা দেখে শরীয়াতুল্লাহ মর্মাহত হলেন এবং দুঃখ অনুভব করলেন। তার হৃদয়-মন মুসলমানদের এহেন অনৈসলামিক ও নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত জীবন থেকে উদ্ধার করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো এবং মুসলমানদের উন্নতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলেন। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুসলমানদের ধর্মীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদেরকে আত্মপ্রতিষ্ঠার বাণী শিক্ষা দেয়াই ছিল এই সংস্কার আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। তিনি হিন্দু-জমিদারদের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, পৈতানুষ্ঠান, রথযাত্রা ও দুর্গাপূজার জন্য কর প্রদান না করতেও শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আদেশ মতে তার অনুসারীরা এসব কথিত কর দেয়া বন্ধ করলে হিন্দু জমিদার ও তাদের মিত্র অত্যাচারী নীলকুঠিয়ালদের কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হন। হিন্দু জমিদারেরা ক্রুদ্ধ হয়ে দাড়ির ওপর কর আরোপ করেন। এমনকি তাদের জমিদারিতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে দেন। ফলে জমিদারদের সাথে ফরায়েজিদের তীব্র দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত দেখা দেয়। ইংরেজদের প্রশাসনযন্ত্র জমিদারদের পক্ষাবলম্বন করায় হাজী শরীয়তুল্লাহ অনেকবার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হন।
১৮২০ সালে দ্বিতীয়বার মক্কা শরীফ গমন করেন এবং কিছুদিন সেখানে অবস্থান নেন। দেশে ফিরে এসে সমাজ সংস্কার কাজে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠিত ফরায়েজী আন্দোলন ফরিদপুর, ঢাকা, রাখরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক প্রসারতা জনপ্রিয় ও জনসমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়। প্রথমে তিনি ইসলাম ধর্মের অনুশাসনের মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করতেন। একপর্যায়ে তা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। শরীয়তুল্লাহ মুসলমানদের মধ্যে বিরাজমান নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। সচেষ্ট ছিলেন মুসলমানদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলের বিরুদ্ধেও। ব্রিটিশদের দ্বারা নির্যাতিত নানা শ্রেণির মানুষ যোগ দেয় এ আন্দোলনে। বিশেষ করে কৃষক, তাঁতি ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। তিনি তােদের দুর্দিনে উপদেশ ও দুঃখে সান্ত্বনা দিতেন।তিনি একটি শক্তিশালী মুসলিম বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন। যাতে মুসলমানরা তাদের শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে। তাই তিনি একটি সুদক্ষ লাঠিয়াল বাহিনী গঠনের মনস্থির করলেন। সেই কাজের জন্য তিনি জালাল উদ্দিন মোল্লাকে নিয়োগ করেন। ১৮৩৯ সালে হাজী শরীয়াতুল্লাহর উপর পুলিশী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
১৮৪০ সালের ২৮ জানুয়ারি এই মহান সংগঠক, মুসলিম হিতৈষী, ফরায়েজী আন্দোলনের উদ্যোক্তা পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো ৫৯ বছর। শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মহসিন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা মনোনীত হন। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা ও ফরায়েজি আন্দোলন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তার পিতার মতোই ১২ বছর বয়সে মক্কা শরীফ গমন করেন। সেখানে ৫ বছর শিক্ষা লাভের পর দেশে ফিরে আসেন। মহসিন উদ্দিন তার পিতার মতো এতটা খ্যাতনামা আলেম ছিলেন না। তবে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। হাজী শরীয়াতুল্লাহ প্রবর্তিত ফরায়েজী আন্দোলন মুসলমানদের তাহজিব তামাদ্দুন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার রক্ষাকবচ হিসেবে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে চিরজাগরুক থাকবে আজীবন অন্ততকাল পর্যন্ত। আজ ফরায়েজি আন্দোলনের মহানায়ক হাজী শরীয়তুল্লাহর ১৮০তম মৃত্যুবার্ষিকী। নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী এবং ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:১০