চীন থেকে গোটা বিশ্বে দ্রুত ছড়াচ্ছে নোভেল করোনা ভাইরাস। ইউহান প্রদেশের মাছের বাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের বাহক যে মানবদেহ, সেটাও নিশ্চিত করেছে চীন। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে সৃষ্ট করোনাভাইরাস এরই মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপ-আমেরিকার ১২টি দেশে পৌঁছে গেছে। এমনকি আমাদের পাশের দেশ নেপালেও এনসিওভি ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩০০ ছাড়িয়েছে। চীনের বাইরে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়ও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। উহান থেকে ১৯ জানুয়ারি আসা এক চীনা নাগরিকের শরীরে করোনাভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে অস্ট্রেলিয়া। মেলবোর্নের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৫০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলেও জানিয়েছে তারা। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নিবিড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ দুই দেশে যাতায়াত করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশেও এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (হেলথ ইমার্জেন্সি ও অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম) ডা. আয়েশা আক্তার জানান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সব প্রবেশ দ্বারে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এখনও এ ধরনের কোনো রোগীর তথ্য পাওয়া যায়নি। ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। খবর দ্য ডেইলি মেইল, রয়টার্স, বিবিসি।
চীনজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার অন্তত তিন মাস আগেই এ ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা ভবিষ্যদ্বাণী করে জানিয়েছিলেন, নতুন এক ধরনের করোনাভাইরাসে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে। তাদের ভবিষ্যদ্বাণীতে আরও বলা হয়েছিল, ছড়িয়ে পড়ার পর পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ উজাড় হয়ে যাবে। গত বছরের অক্টোবর মাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার অংশ হিসেবে এমনটাই ধারণা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিখ্যাত গবেষণা কেন্দ্র জন হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটি। করোনাভাইরাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের মধ্যে শনিবার এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে ডেইলি মেইল। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের সতর্কতার মাত্র তিন মাস পরই (এখন থেকে মাসখানেক আগে) গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের তিন হাজার বয়সী শহর উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়। সেখানে বন্যপ্রাণী কেনাবেচার একটি অবৈধ বাজার থেকে রোগ ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এরপরই নিউমোনিয়া সদৃশ এ প্রাণঘাতী ভাইরাস দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে চীনের বাইরেও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার নেপালেও ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মিলেছে। মহামারী ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তুমুল লড়াইয়ের মধ্যে চীনসহ ১২ দেশে নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। চীনা কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত অতি সংক্রামক ভাইরাসটি চীনের ৪১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। নতুন আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার দুইশ’র বেশি। তবে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞদের মতে, আক্রান্তের সংখ্যা হাজার হাজার। জন হপকিন্স সেন্টারের সিনিয়র গবেষক ড. এরিক টোনার বিজনেস ইনসাইডারকে বলেছেন, ডিসেম্বরের শেষে ভাইরাসটি চীনে ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়ার পরও তিনি মোটেই অবাক হননি। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই মনে হয়েছে, নতুন একটা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর সেটা হবে একটা করোনাভাইরাস।’ তিনি আরও বলেন, ‘তবে এখনও জানি না কতটা সংক্রামক এ ভাইরাসটি। আমরা জানি, এটা একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায়। তবে তার বিস্তার কতটুকু তা জানি না।’ এরিক টোনার আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটা সার্স ভাইরাসের চেয়ে কিছুটা নমনীয়। সেটাই ভরসার জায়গা। অন্যদিকে এটা সার্সের চেয়েও বেশি সংক্রামক হতে পারে। অন্তত স্থানীয় জনপরিসরে।
ড. এরিক তার কম্পিউটারে করোনাভাইরাস ছড়ানোর যে মডেল এঁকেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে, ভাইরাসটি ছড়ানোর পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে বিশ্বের প্রত্যেকটা দেশই আক্রান্ত হবে। এভাবে পরবর্তী আরও এক বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে সাড়ে ছয় কোটি মানুষ মারা যাবে। উহান শহর ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল হলে এখনও এটাকে মহামারী বিবেচনা করা হচ্ছে না। তবে চীনের বাইরে ইতিমধ্যে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নেপাল, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায়ও আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। উহান থেকে ১৯ জানুয়ারি আসা এক চীনা নাগরিকের শরীরে করোনাভাইরাসটির উপস্থিতি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে অস্ট্রেলিয়া। মেলবোর্নের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বয়স ৫০ এর ঘরে থাকা ওই ব্যক্তির পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলেও জানিয়েছে তারা। এএফপি জানিয়েছে, শনিবার থেকে চীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘ইঁদুর নববর্ষ’ শুরু হলেও ভাইরাসের মহামারীতে তা নিরানন্দ ও বিষন্ন হয়ে উঠেছে। যখন তাদের উৎসব-আনন্দে মেতে থাকার কথা, ঠিক সে সময় দেশের নাগরিকরা হাসপাতালে হাসপাতালে স্ক্রিনিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। ওষুধপথ্য কেনার জন্য ফার্মেসিতে দৌড়াচ্ছে। সুরক্ষামূলক পোশাক আর মাস্ক কেনার জন্য দোকানে দোকানে লাইন ধরছে। মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশসহ অন্তত ১৮টি শহরে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষ একপ্রকার নিজ বাড়িতে আটকে পড়েছে।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়ঃ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বার্তা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস জুনোটিক। অর্থাৎ এ ভাইরাস পশুর দেহ থেকে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এখন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকেও অন্য ব্যক্তির শরীরে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সংস্পর্শে এলে বা তার সঙ্গে হাত মেলালেও করোনাভাইরাস শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ হলো জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি। অসুখ আরও বাড়লে কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। করোনাভাইরাস মরণব্যাধি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। নিজেকে সাবধান রাখাই শ্রেষ্ঠ উপায়। এছাড়া
১। যতটা সম্ভব ঘরেই থাকার চেষ্টা করুন। সময় কাটানোর জন্য ভালো কোনো সিনেমা দেখুন বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন। তবে বাইরে প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়াই ভালো।
২। বাইরে বের হওয়ার আগে সঙ্গে মাস্ক নিতে ভুলবেন না।
৩। বাস, ট্রেন বা এজাতীয় গণপরিবহনগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
৪। বাইরে থেকে ফিরে হ্যান্ডওয়াশ বা লিকুইড সোপ দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন।
৫। বাইরে যাওয়ার আগে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে যান। সকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য জানালা খোলা রাখুন। তাতে পর্যাপ্ত সতেজ বাতাস এবং সূর্যের আলো ঘরে প্রবেশ করবে।
৬। সুস্থ এবং শক্তিশালী থাকতে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। প্রচুর ফলমূল এবং পর্যাপ্ত পানি খাবেন। কোনো কিছু খাওয়া কিংবা রান্না করার আগে ভালো করে ধুয়ে নেবেন।
৭। ডিম কিংবা মাংস রান্নার সময় চেষ্টা করুন পর্যাপ্ত সময় ধরে রান্না করতে। খেয়াল রাখবেন, এগুলো যেন অবশ্যই সেদ্ধ হয়।
৮। ময়লা কাপড় দ্রুত ধুয়ে রাখার চেষ্টা করুন, দিন বা সপ্তাহ ধরে ফেলে রাখবেন না।
৯। ঘর পরিষ্কার রাখুন। নিয়মিত আপনার থাকার ঘর এবং কাজের জায়গা পরিষ্কার করুন। এক্ষেত্রে ইথাইল অ্যালকোহল ব্যবহার করুন। এটি আপনি যেকোনো ওষুধের দোকানেই পাবেন।
১০। সুরক্ষিত থাকতে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। অসুস্থ বোধ করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার পরিচিত কেউ আক্রান্ত মনে হলেও দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। সৃষ্টিকর্তা বিশ্বের সকলকে এই দূর্যোগ মোকাবেলার তৌফিক দান করুন। আমিন
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:২৩