ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বাঙালি নেতা বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপধ্যায়। যিনি বাঘা যতীন নামেই সকলের কাছে সমধিক পরিচিত। ১৯০০ সালে ২০/২১ বছর বয়সে শুধুমাত্র একটি ছোরা দিয়ে ১০ মিনিট লড়াই করে যতীন্দ্রনাথ একটি বাঘ হত্যা করেন। বাঘরে আঘাতে তার শরীরের প্রায় ৩০০ স্থানে ক্ষত হয়। তার অবস্থা আশংকাজনক হলে কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তার, সর্বশ্রেষ্ট সার্জন সুরেশপ্রসাদের চিকিৎসার ভার নেন। ডাক্তার সুরেশ প্রসাদ তাঁকে দেখে, তাঁর বীরত্বের কথা শুনে রীতিমতো অবাক হলেন এবং যতীন্দ্রনাথের এই কীর্তিকে সম্মান জানিয়ে তিনি তাঁকে 'বাঘা যতীন' নাম উপাধি দিলেন। বাঘ মারার পর গ্র্রামের সাধারণ মানুষও তাঁকে ভালোবেসে 'বাঘা যতীন' নামে ডাকতে শুরু করেন। পরবর্তীতে এই বাঘা যতীন সমগ্র ভারতবর্ষে 'বিপ্লবী বাঘা যতীন' নমে পরিচিতি লাভ করেন। আজ এই মহান বিপ্লবী নেতার ১৪০তম জন্মদিন। বিপ্লবী এই নেতার জন্মদিনে আমাদের আন্তুরিক শুভেচ্ছা।
বাঘা যতীনের জন্ম ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া মহাকুমার কয়া গ্রামে, মাতুলালয়ে। জন্মের পর পারিবারিকভাবে তাঁর নাম রাখা হয় যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বাবা উমেশচন্দ মুখোপাধ্যায়। মা শরৎশশী দেবী। তাঁদের আদিনিবাস ছিল যশোর জেলার ঝিনাইদাহ মহকুমার রিশখালী গ্রামে। বাঘা যতীনের ৫ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। এরপর মা ও বড়বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়া গ্রামে চলে আসেন। মায়ের আদর-স্নেহে মাতুলালয়েই তিনি বড় হতে থাকেন। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। মা শরৎশশী দেবী ছিলেন স্বভাবকবি বাঘিনী। গ্রামের পাশেই গভীর নদী। তিনি বালক যতীন্দ্রনাথকে স্নান করাতে যেয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নিজেই সাঁতরে গিয়ে নিয়ে আসতেন। এভাবে সাঁতার শিখে যতীন্দ্রনাথ একদিন বর্ষার ভরা নদী সাঁতরে পার হবার সাহস ও শক্তি অর্জন করেছিলেন। বাঘিনী মায়ের শিক্ষাতেই গড়ে উঠেছিলেন দেশপ্রেমিক যতীন্দ্রনাথ, বিপ্লবী বাঘা যতীন। যতীনের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক লেখাপড়া শেষে বড় মামা বসন্ত কুমার যতীনকে কৃষ্ণনগরের অ্যাংলো ভার্ণাকুলার হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। ছোটবেলা থেকে যতীন ছিলেন দুরন্ত স্বভাবের। মা শরৎশশী দেবী ছেলেকে চোখে চোখে রাখতেন। ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে আদর্শবান ও স্পষ্টভাষী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। স্কুলের পড়াশুনা আর খেলাধূলার পাশাপাশি ঘোড়ায় চড়া, শিকার করা, মাছ ধরা, গাছে চড়া, দৌড়-ঝাঁপসহ নানা দুরন্তপনায় মেতে থাকতেন যতীন। পড়াশুনায় ভাল, দুষ্টমিতে সেরা ও স্পষ্টভাষী, এসব গুণের কারণে যতীন তাঁর সহপাঠী ও শিক্ষক মহলে প্রিয় হয়ে উঠেন। পাড়া-মহল্লা ও স্কুলে নাটকে অভিনয়ও করতেন তিনি। ১৮৯৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করে তিনি কলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে (বর্তমানের ক্ষুদিরাম বোস সেন্ট্রাল কলেজ) ভর্তি হন। কলেজের পাশেই স্বামী বিবেকানন্দ বাস করতেন। বিবেকানন্দের সংস্পর্শে এসে যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য আধ্যাত্মিক বিকাশের কথা ভাবতে শুরু করেন। এসময়ে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিবেকানন্দের আহবানে যতীন তাঁর বন্ধুদের দল নিয়ে এই রোগে আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত হন।
এরই ফাকে যতীন টাইপরাইটিং শেখা শেষে কলকাতার আমহুটি এন্ড কোম্পানী নামক একটি ইউরোপীয় সওদাগরী অফিসে মাসে ৫০ টাকা বেতনে চাকুরী নেন। এখানে বেশ কিছুদিন চাকুরী করার পর তিনি ১৮৯৯ সালে মোজফফরপুরে ব্যারিষ্টার মি. কেনেডির স্টনোগ্রাফার হিসেবে ৫০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। চাকুরী করার কারণে তাঁর আর এফ.এ. ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ১৯০০ সালে যতীন বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অধীনে ১২০ টাকা বেতনের একটি চাকুরী পেয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯০৩ সালে অরবিন্দের সাথে পরিচিত হয়ে যতীন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তিনি সরকারি চাকরিরত অবস্থায় অত্যন্ত সুকৌশলে ও গোপনে বিপ্লবী সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। ১৯০৮ সালে হঠাৎ একদিন কলকাতার মানিকতলায় বিপ্লবীদের গোপন বোমার কারখানার বিপ্লবীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পুলিশ জানতে পারে, এই বিপ্লবীদের মধ্যে একজন সরকারি লোক রয়েছেন। তাঁর নাম বাঘা যতীন। তিনি ওই দলের নেতা। অথচ তিনি তখন বাংলায় গভর্নরের পার্সোনাল সেক্রেটারি। তাঁর 'বিপ্লবী' পরিচয় পেয়ে সরকারি মহল ও পুলিশ প্রশাসন স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। তাঁর উপর কঠোর নজরদারি রাখা হলো।এই সময় থেকে যতীন সতর্ক হয়ে যান। এরপর তাঁর নেতৃত্বে ১৯০৯-১০ সাল পর্যন্ত যত বিপ্লবী কর্মকান্ড সংগঠিত হয়েছে, তা খুব সর্তকতার সাথে সম্পাদন করেছেন তিনি। সারাভারতে বিপ্লবী কর্মকান্ড ছড়িয়ে দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী।
১৯০৯ সালের ৩০ নভেম্বর ব্রিটিশ সরকার ম্যাজিস্ট্রেট সামসুল আলমকে স্পেশাল ক্ষমতা দেন, সে ক্ষমতাবলে তিনি যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবেন। ব্রিটিশ সরকারের দেয়া এই ক্ষমতাবলে ম্যাজিস্ট্রেট সামসুল আলম বিপ্লবীদের উপর চড়াও হয়ে একের পর এক বিপ্লবীকে গ্রেফতার করতে শুরু করেন। বিপ্লবী যতীন তখন সামসুল আলমকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। ২৪ জানুয়ারী সামসুল আলম যখন কলকাতা হাইকোর্ট থেকে সিড়ি বেঁয়ে নামছিলেন, তখন ১৮ বছরের বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ দপ্তগুপ্ত যতীনের নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করেন। যতীনের নির্দেশে সামসুল আলম হত্যাকান্ডের পর ব্রিটিশ সরকার যতীনের উপর গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করে। টেগার্টকে পাঠানো হলো যতীনকে গ্রেফতার করার জন্য। যতীন তখন কয়েকজন সহযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কলকাতার ২৭৫ নং আপার চিৎপুর রোড়ের বাড়িতে তাঁর এক অসুস্থ মামার সেবাযত্ন করছিলেন। সেই বাড়ি থেকে যতীনকে টেগার্ট গ্রেফতার করে। এরপর যতীনকে আটক রেখে চালানো হয় অত্যাচারের স্টিম রোলার। কিন্তু একটি তথ্যও বের করতে পারেনি। তাঁকে বিভিন্ন ধরনের লোভ ও প্রলোভন দেখানো হয়। এতেও কোনো কাজ হয়নি। হতাশ হয়ে সরকারি মহল তাঁকে প্রথমে প্রেসিডেন্সি জেলে, পরে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠায়। তাঁর নামে দেয়া হয় বিখ্যাত 'হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা'। এ মামলা চলে এক বছরেরও বেশী সময় ধরে। এই মামলায় যতীনসহ কয়েকজন বিপ্লবীকে জড়ানো হয়। এ সময় 'অনুশীলন সমিতি'কে বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচারের ফলে কয়েকজন বিপ্লবী মারা যান এবং কয়েকজন পাগল হয়ে যান। যথাযথ প্রমাণের অভাবে যতীনকে দোষী প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার। ১৯১১ সালের একুশ ফেব্রুয়ারী যতীন এ মামলা থেকে মুক্তি পান।
জেল থেকে মুক্তি লাভের পর যতীন তাঁর দিদি বিনোদবালা, স্ত্রী ইন্দুবালা, কন্যা আশালতা আর দু'বছরের ছেলে তেজেন্দ্রনাথকে নিয়ে যশোরের ঝিনাইদাতে বসবাস শুরু করেন। এসময় তিনি ঠিকাদারী ব্যবসা শুরু করে ব্রিটিশ সরকারকে পুরোপুরী সংসারী হওয়ার চিত্র দেখান। যশোর শহরে আর মাগুরাতে দুটি শাখা অফিস করেন। ব্যবসার আড়ালে গোপনে গোপনে বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি নরেন সন্ন্যাসী নামে পুরো ভারত চষে বেড়ান এবং বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবীদের একত্র করার কাজ চালিয়ে যান। ১৯১৩ সালের ভীষণ বন্যা ও মহামারীর সময় যতীন তাঁর দলবল নিয়ে বর্ধমান ও কাশীতে বন্যার্তদের সেবা-যত্ন শুরু করেন। এসময় তিনি সমস্ত জেলার বিপ্লবী নেতা-কর্মীদের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবার জন্য সেখানে চলে আসতে বলেন। সকল জেলার নেতৃবৃন্দ সেখানে চলে আসেন। বন্যার্তদের মাঝে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে যতীন গোপন বৈঠকে বিপ্লবের মাধ্যমে ইংরেজকে হঠানোর পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নিলেন। এসময় নিষিদ্ধ সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলো যতীনকেই তাঁদের সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করেন। এরপর থেকে তাঁর কমান্ডেই সকল বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। ওই বছর শেষের দিকে উত্তর ভারত থেকে রাসবিহারী বসু এসে সর্বাধিনায়ক যতীনকে সংগঠনের কাজ সম্পর্কে বললেন। শচীন স্যানালও যুক্ত হলেন এই বিপ্লবী পরিকল্পনার সাথে।
১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট ইংরেজ-জার্মান যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধ বাধার ২২ দিন পর সর্বাধিনায়ক যতীনের নেতৃত্বে সারা কলকাতায় বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড ব্যাপক আকারে সংগঠিত হতে থাকে। নভেম্বর মাসে আমেরিকা থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারতে এসে যতীনকে জানালেন, গদার পার্টির চার হাজার সদস্য আমেরিকা থেকে বিদ্রোহের জন্য ভারতে এসেছেন। বিদ্রোহ শুরু হলে আরো ২০ হাজার সদস্য ভারতে আসবেন। তারপর সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও বিষ্ণুগনেশ পিঙ্গলু যতীনের কাছে পরিচয় পত্র নিয়ে কাশীতে রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত ঘটনা বলেন এবং বিপ্লবী সংগঠনের কাজে যুক্ত হন। ১৯১৪ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করেন সর্বাধিনায়ক যতীন। গোপনে গোপনে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালে সর্বাধিনায়ক যতীন সমগ্র্র ভারত নিয়ে একটি বিপ্লবের চিন্তা করেন। তিনি রাসবিহারী বসু ও শচীন্দ্রনাথ স্যানালের সহযোগিতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লি, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের 'জাতীয় অভ্যূত্থানের' জন্য অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন। ১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত। কিন্তু পরে ২১ ফেব্রুয়ারির পরিবর্তন করে ১৯ ফেব্রুয়ারি করা হয়। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করে অধীরভাবে। রাসবিহারী বসু, শচীন স্যানাল ও হেরাম্বলালগুপ্ত এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন করেন লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে।
অবাঙালী বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ প্রদানের সময়টুকুর প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিদ্রোহের ঠিক ৪ দিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় রামশরণ দাস। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে যেখানে যেখানে সম্ভব দেশীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪ প্রধান দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। দ্রুত সমস্ত লাহোরব্যাপী এই ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হয়। এটাই ঐতিহাসিক 'লাহোর ষড়যন্ত্র' নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর যতীন বিপ্লবীদের নিয়ে একটা বৈঠক করেন এবং এক এক জনকে তাঁর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। সকলে ভারতের স্বাধীনতার জন্য নতুন আঙ্গিকে কাজ শুরু করেন। নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সবাই বিপ্লব করার জন্য লড়ে যান। এসময় বিপ্লবীদেরকে সুরেশ নামক এক পুলিশ অফিসার প্রায়ই জ্বালাতন করতেন এবং বিনা কারণে ধরে নিয়ে যেতেন। বিপ্লবীরা একদিন সুরেশকে সুযোগ বুঝে মেরে ফেলেন। মৃত্যুর আগে লিখিত বক্তব্যে সুরেশ বলেন, যতীনের সঙ্গীরা তাকে মেরেছে । তাই ব্রিটিশ সরকার যতীনের উপর আবার গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে এবং তাঁকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা ঘোষণা করে।
১৯১৫ সালের মার্চ মাসে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারত রক্ষা আইন চালু করে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের একের পর এক গ্রেফতার করে বিনা বিচারে বন্দী রাখার ব্যবস্থা করে। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে গুপ্ত সমিতির পররাষ্ট্র বিভাগের দপ্তর-এ পুলিশ হানা দিয়ে ওই দপ্তরে নিয়োজিত বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে। এরপর থেকে বিপ্লবীদের আস্তানাগুলোতে পুলিশ একের পর এক হানা দিতে থাকে। ইতিমধ্যে সর্বাধিনায়ক যতীন জার্মান সরকারের সহায়তায় ভারত থেকে ইংরেজকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করেন। জার্মানির সাহায্য কামনা করলে জার্মান সরকার সম্মত হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, জার্মান জাহাজ মাভেরিক থেকে অস্ত্র নিয়ে বালেশ্বর রেললাইন অধিকার করে ইংরেজ সৈন্যদের মাদ্রাজ থেকে কলকাতা যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী চারজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে বুড়িবালাম নদীর তীরে অপেক্ষা করতে থাকেন যতীন্দ্রনাথ। কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দারা লোভী গ্রামবাসীর মাধ্যমে তাঁদের আত্মগোপন করার কথা জানতে পারে। ওই গ্রামবাসীরা এই বিপ্লবী দলকে পালানোর সুযোগ দেয়নি। তারা বিপ্লবীদের পিছু নিয়ে পুলিশকে খবর দেয়। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এই বিপ্লবী দলকে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলে। তবে যতীন তাঁর চার সহযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে ইংরেজ পুলিশের বিরুদ্ধে লড়ে যান। লড়াইয়ের একপর্যয়ে যতীন গুরুতর আহত হন এবং পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর বালেশ্বর হাসপাতালে মারা যান। তাঁর লাশ কোথায় কি করা হলো জানা গেল না। মানুষের মুখে মুখে অমর হয়ে গেলেন স্বদেশী আন্দোলনের মহান সৈনিক বিপ্লবী বাঘা যতীন আর তাঁর বিপ্লবী সাথী। কবির কবিতায় বিধৃত হলো কাহিনী।
“বৃটিশের সাথে যুদ্ধ করেছে
তোমরা পঞ্চবীর
বুবের রক্তে রাঙায়ে দিয়েছে
বুড়ী বালামের তীর।
বিপ্লবী বাঘা যতীন বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩৬ বছর। এই ছোট জীবনে তিনি তাঁর জীবন-সংগ্রাম দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখে গেছেন। বিপ্লবী বাঘা যতীনের হলদিঘাট বুড়ি বালামের তীরের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেনঃ
“বাঙালির রণ দেখে যা তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট।”
যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছিলেন "I have met the brevest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty."
মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও শোষণমুক্তির আন্দোলন যতদিন চলবে ততদিন বাঘা যতীন বেঁচে থাকবেন মানুষের মাঝে। বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগান্তরের ইতিহাসে। মানুষের চেতনায় ও কর্মে। আজ এই মহান বিপ্লবী নেতার ১৪০তম জন্মবার্ষিকী। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বাঙালি নেতা বিপ্লবী বাঘা যতীনের জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।
নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:২৮