মুক্তিবুদ্ধি সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজলের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
বাংলাদেশের প্রখ্যাত মুক্তিবুদ্ধি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজল। ১৯২৬ সালে ঢাকা সূচিত 'বুদ্ধির মুক্তি' আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। এ আন্দোলন চলেছিল ১৯৩১ সাল পর্যন্ত। আবুল ফজল এ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তই শুধু থাকেননি, তিনি নিজেও আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেনের স্নেহধন্য হয়ে বুদ্ধিবৃত্তির স্বাতন্ত্রিক প্রয়াস চালিয়ছিলেন। কর্ম জীবনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাষ্ট্রপতির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। আবুল ফজল সমাজসচেতন লেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তার লেখায় উঠে এসেছে স্বদেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, সত্যনিষ্ঠা এবং মানবতাবোধ। তিনি মূলত একজন চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার। তাঁর প্রবন্ধে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে গভীর ও স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতির প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ ও মমত্ববোধ। ১৯৬৭ সালে তত্কালীন পাকিস্তান সরকার যখন রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, তখন তিনি তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের এই সাহিত্য প্রতিভা ১৯৮৩ সালের আজকের দিনে চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। মুক্তিবুদ্ধি সাহিত্যিক আবুল ফজলের মৃত্যু দিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আবুল ফজল ১৯০৩ সালের ১লা জুলাই, চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় বত্রিশ মাইল দক্ষিণে এক অখ্যাত অজপাড়াগাঁ কেঁওচিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তাঁর নাম রেখেছিলেন মোহাম্মদ আবুল ফজল। কিন্তু আবুল ফজল নামেই তিনি লেখালেখি করেছেন। তার বাবার নাম মৌলবি ফজলর রহমান ও মা গুলশান আরা। পিতা মৌলভি ফজলুর রহমান ছিলেন চট্টগ্রাম জুমা মসজিদের ইমাম। আবুল ফজলের লেখাপড়ার শুরু গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিছুকাল পরে বাবার সঙ্গে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে এবং চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৯২৫ সালে। ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে বি.এ. এব ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন। বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী শিক্ষক হওয়ার সংকল্প করেন আবুল ফজল। আর এ জন্য ১৯২৯ সালে বি.টি. পড়ার জন্য ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩১ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি. পাস করার পর তিনি চট্টগ্রাম ফিরে আসেন। এর পর আবুল ফজল বিভিন্ন সময় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃঞ্চনগর কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজিয়েট কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন। দীর্ঘকাল পরে, ১৯৭৩ সালে তিনিচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবেযোগ দেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য হিসেবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন এবং ১৯৭৭ সালের ২৩শে জুন সে-পদ ত্যাগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ঢাকার 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' প্রতিষ্ঠার সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি এর সম্পাদকও হয়েছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক কুসংস্কার থেকে মানুষকে মুক্ত করা। তাদের সামাজিক আন্দোলনের মূলকথা ছিল: 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব'। ১৯২৬ সালে তারা প্রকাশ করেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র শিখা। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও শিখার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তারা ‘শিখাগোষ্ঠী’ নামে পরিচিত ছিলেন। এ গোষ্ঠী ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন শুরু করে। আবুল ফজল সমাজসচেতন লেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, আত্মকথা, ধর্ম, ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হচ্ছেঃ চৌচির, প্রদীপ ও পতঙ্গ, মাটির পৃথিবী, বিচিত্র কথা, রাঙ্গা প্রভাত, রেখাচিত্র, দুর্দিনের দিনলিপি, সফরনামা, আয়েশা, আবুল ফজলের শ্রেষ্ঠ গল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন, সমকালীন চিন্তা ইত্যাদি। ১৯৪৮-৪৯ সালে তিনি 'সাহিত্য চয়নিকা' নামে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর উপযোগী দুটি সাহিত্য বই সংকলন করেছিলেন। পাঠ্যবই হিসেবে ঐ দুটি বই টেক্সট্ বুক কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছিল। তাঁর এ দু'টা সংকলন পাঠ্য বই হিসেবে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ১৯৫৭ সালে তাঁর 'রাঙ্গা প্রভাত' প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বইটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পাঠ্য হয়। বইটি ছয় বছর ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ক্লাসে পড়ানো হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন আবুল ফজল। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্টের সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৬৬ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮০ সালে নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ১৯৮১ সালে মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮২ সালে আবদুল হাই সাহিত্য পদকে ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০১২ সালের মরনোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ১৯৮৩ সালের ৪ঠা মে ৮০ বছর বয়সে চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী। আবুল ফজলের অনেক রচনা সাময়িকতা-খচিত হলেও এবং তার ভাষাশৈলীর গদ্যবোধের মধ্যে নিপাট সংশ্লেষণশীল নান্দনিকতা না থাকলেও; তার সমাজবোধের মধ্যে যুক্তিবোধ, মনুষ্যত্ববোধ, উদার ধর্মচিত্ততা, প্রাজ্ঞতা ও মানবপ্রেম থাকার কারণে তাকে অবশ্যই বাঙালিদের চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, চিন্তাশীল ও সমাজমনস্ক প্রবন্ধকার আবুল ফজলের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন
দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?
দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন
শেখস্তান.....
শেখস্তান.....
বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সেকালের বিয়ের খাওয়া
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন