আজ নতুন বছরের প্রথম মাসের শেষ দিন। রাজনৈতিক ডামা ডোলে নানান চড়াই উৎরাই পার করে শেষ করলাম একটি মাস। এ দিনে আমার গতানুগতিক লেখার বাইরে একটু ভিন্ন ধারার লেখার ইচ্ছায় আমার অদ্যকার লেখা। মত, দ্বিমতের দোলায় দুলুক আজকের এই রম্য লেখাটি সেই প্রত্যাশায়ঃ
পৃথিবীর বড় বড় মনীষীরা বলে গেছেন পৃথিবীতে যত শিল্পমাধ্যম আছে তার মধ্যে কবিতাই শ্রেষ্ঠতম। সুকুমার বৃত্তি প্রকাশের এই শ্রেষ্ঠ মাধ্যমের প্রেমে পড়ে জলের বানের মতো এই দলে যোগ দিচ্ছে মহানসব কবিরা। বিশ্বের আর কোন দেশে আমাদের দেশের মতো এতো কাক আছে কিনা জানিনা, তবে কাকের সংখ্যা যে অগুনিত তা অনস্বীকার্য। দূর্মুখেরা বলেনঃ
কাব্য পঁচেছে কুষ্ঠ রোগেতে
কবিতা হয়েছে বাঁশি
আমার দেশে কাকের চাইতে
কবির সংখ্যা বেশি।
ঢাকা শহরে নাকি এখন কাক ও কবির সংখ্যা সমান। তার প্রমানও মিলছে। এর কারণ নাকি বাঙ্গালীর আবেগচিত্ত মন। আমার আজকের বিষয় কাক নিয়ে গবেষণা নয়। তবে বেশ কিছু দিন যাবৎ লক্ষ্য করছি বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ব্লগে কিছু ব্লগার বন্ধুরা ধুমছে কবিতা লিখছেন। মাঝে মাঝে আমি তাদের কবিতায় দুই/চার ছত্রের ছন্দ তিলেমন্তব্য করতে গিয়ে আমিও হয়ে গেছি তথাকথিত কবি! অথচ কবিতা লিখবার মতো সামান্যতম জ্ঞান আমার নাই। কবির দলে আমার অন্তর্ভূক্তি মনে করিয়ে দেয় কাকের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশে বেড়ে যাচ্ছে কবির সংখ্যা। তাই তথাকথিত এই সকল কবিদের নিয়ে নেতবিাচক মন্তব্য করতে শংকায় বোধ করছি। কারণ একটা কাকের কিছু হলে যেমন রাজ্যের কাক একসাথে হয়ে কা-কা করতে থাকে তেমনি একজন কবিকে কিছু বলা হলে রাজ্যের কবিরা মিলে তার কী হাল করতে পারে সে চিন্তায় পেরেশান আমি। তবে আমি বিনয়ের সাথে সকল কবিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেতে চাই এটা শুধুই আমার ব্যক্তিগত মতামত। যেহেতু কোন বিষয়ে মতামত প্রদান আমার নাগরিক অধিকার তাই কারো কাছে আমার মতামত গ্রহনীয় না হেলে আপনারা যুক্তি দিয়ে তা খণ্ডন করতে পারেন । আপনাদের মুক্ত মতামত আমার ভুল ভাঙ্গাতে সহায়তা করবে। কারণ কোন ভুলের উপর দাড়িয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করা বাতুলতা। আমি বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ব্লগের নব্য কবিদের নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ও ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করছি।
পৃথিবীতে এমন একটি বাঙ্গালী খুঁজে পাওয়া যাবে না যে জীবনে একবারের জন্যও দুলাইন কবিতা লেখেননি। জরিপ করলে হয়তো দেখা যাবে দেশের প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে ৬ জনই কবি। অর্থাৎ কোন না কোন সময় তারা কবিতা লিখেছেন বা রচনা করেছেন। ছন্দ হলো কবিতার প্রাণ। সুলিখিত ও উপযুক্ত শব্দ-বাক্যে গঠিত ছড়া-কবিতা-গানকে আবৃত্তি বা পাঠের সময় যে রিদম ও দ্যোতনার ঢেউ সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের হৃদয়-মনকে উদ্বেলিত-আন্দোলিত করে, তাইতো ছন্দ। ছন্দের আকর্ষণেই ছড়া-কবিতা পড়তে মজা পাওয়া যায়। অথচ অন্তমিলবিহীন মুক্তছন্দের নামে অনেকেই আজকাল রাতারাতি কবি বনে যাচ্ছেন দেখে আমার মাঝে মাঝে হাসিও পায়। আবার যারা শুধু অন্তমিলকেই ছন্দ মনে করে--কবি মধুসুদনের ভাষায় ''শব্দে শব্দে বিয়ে দিলেই কবিতা হয়না'' তারাও বোকামী করেএদের উচিৎ আধুনিক বা গদ্যকবিতা মুক্তছন্দের কবিতা কী বা কাকে বলে তা মধু কবির লেখা থেকে শিখে নেয়া। তবে আধুনিক কবিদের সেই চিন্তা করতে হয়না। এটার নাম গদ্য কবিতা। আধুনিক কবিরা গদ্য লিখে যান ইচ্ছামত, নাম দেন কবিতা। আমাদের এই সম্ভাবনাময় কবি আর কবিনীর অনেকেরই নেই বানান সম্পর্কে কোন জ্ঞান, নেই ছন্দ আন্ত মিল সম্পর্কে কোন ধারণা। কেউ কেউ আবার উল্টা পাল্টা লাইন একটার পর আরেকটা লিখে সেটাকেই কবিতা বলে চালিয়ে দেন ও তাদের কবিতাকে গদ্যমূলক কবিতা বলে দাবি করেন।এদের কবিতার ১ম অন্তরায় ৪ লাইন থাকলেও পরবর্তীতে পাঁচ/ছয়, আট কিংবা নয় ছত্রেও শেষ করেন অবলিলায়। ভাবখানা এমন যেন কোন অত্যাধুনিক কাব্যধারা সৃষ্টি করে কবিতাঙ্গনকে ধন্য করলেন। আসলে এই সব তথাকথিত “আধুনিক গদ্য কবিতা” আদৌ কবিতা কিনা সেটা নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। ছন্দ মিলিয়ে একটা কবিতা লিখলে তা সব সময় সুন্দর হোক বা না হোক সেই কবিতাটি নিয়ে সাধারণত প্রশ্ন আসে না যে এটি কি কবিতা হয়েছে নাকি হয়নি। আমার ধারণা যারা ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখতে পারে না, তারাই ছন্দ ছাড়া কবিতা লিখে। পুরোনো দিনের সব কবিই ছন্দ দিয়ে কবিতা লিখতেন। মাইকেল মধূসুদনের কবিতাতেও "সনেট" এর ছন্দ ছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সকলেরই ছন্দ মেলানো কবিতা রয়েছে। আর সত্যন্দ্রনাথ দত্তকে বলা হয় ছন্দের যাদুকর। আমার মতে সকলেরই উচিত ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখা। আর ছন্দ মেলাতে না পারলে তাদের গল্প লেখা উচিত।
কবিতার সমালোচক দের কথা কি বলব, বাংলাদেশে এত কাব্য-সমালোচক আছে এটা আমার চিন্তার ও অতীত ছিল। অনেকে ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমন প্রসংশা যে কবিতার লেখক ও হয়তো লজ্জাবোধ করেন তাদের প্রশংসা বাক্যে। পঞ্চমুখ বলে একটা কথা শুনেছিলাম। তবে কাদের পঞ্চমুখ আছে তা আজও দর্শনের সুযোগ হয় নাই। পাঁচ মুখের সমাহারে পঞ্চমুখ হয় বলে আমার ধারণা। বিভিন্ন ব্লগের এই সকল নব্য কবিদের কবিতা পাঠ করে (!) (পাঠ না করেও হতে পারে) অনেক বন্ধুরা উচচ্ছাসিত প্রশংসা করে। এক কথায় প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশেষ করে সেই কবি যদি বিপরীত লিঙ্গের হন। পাঠকদের যদি ক্ষমতা থাকতো তা হলে হয়তো নোবেল পুরস্কার দিয়ে দিতেন জাতীয় বাক্য প্রয়োগ করেন তারা তাদের মন্তব্যে। আমি বিব্রত বোধ করি। যারা সত্যি কবিতার সমঝদার বা যারা কবিতার বিজ্ঞ পাঠক তারও নিশ্চয়ই এই সকল নব্য কবিদের লেখার মন্তব্যকারীদের মন্তব্য দেখে মুচঁকি হাসেন। নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানাযায় মন্তর্বকারীদের অনেকেই আছেন যারা কবিতাতে comments করেন কবিতাটা না পরেই। …হয়তো অন্য কারো comments দেখেই তাঁরা তাঁদের জ্ঞানগর্ভ comments লিখে সেই সব কবি-কবিনী দের উতসাহ দেন। নব্য কবি আর তাদের চাটুকারী পাঠকদের প্রশংসাসূচক মন্তব্য দেখে শুধু বলতে ইচ্ছা হয় "হায় সেলুকাস ! কি বিচিত্র আমাদের ব্লগের নব্য কবি ও তার পাঠক"।
কবিতা লেখা বা লেখবার চেষ্টা অবশ্যই দোষের কিছু নয়। প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন সব কিছুই ভালো লাগে। নিজেকে কবি কবি ভাবতে ইচ্ছা করে। আপনারও হয়তো সেই সময় এসেছে বা আসবে। হয়তো আমার মতো সে সময় পেরিয়ে গেছে। আমিও একসময় কবি হবার ইচ্ছা হতো। ইচ্ছার সময়টাতে বেশ কিছু কবিতা লিখে খাতার পাতা পূর্ণ করে ফেলেছি। তারপর তা পত্রিকার পাতায় প্রকাশের খায়েস জাগলো। দ্বারস্থ হলাম আমার পরিচিত এক প্রকাশকের । তিনি মনোযোগসহকারে কবিতাগুলো পাঠ করে মন্তব্য করলেন. "কবিতাসমূহে আমার আবেগ ও যত্নের ছাপ থাকলেও কবিতার অন্তরা ও ছন্দের পতন হয়েছে।" তিনি প্রথিতযশা কবিদের লেখা বেশী বেশী করে পড়ার এবং আরও লিখবার পরামর্শ দিলেন। তিনি আরও পরামর্শ দিলেন ” গদ্য কবিতা লেখার চেষ্টা করতে পার ”। আমি গদ্য কবিতা লেখার নিয়ম কানুন জানতে চাইলে তিনি যা বললেন তাতে আমার আক্কেল গুড়–ম। তার পরামর্শ - ”প্রথমে যেকোন একটা বিষয়ে রচনা লিখবে। গরুর রচনা হলেও ক্ষতি নাই। তার পার রচনাটির দুই পার্শ্ব থেকে এক ইঞ্চি করে ছেটে ফেলবে দেখবে চমৎকার একটি গদ্য কবিতা রচনা করে ফেলছ।” আমি সেদিন তার সেই কথার মানে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি বিভিন্ন ব্লগরে কিছু নব্য কবিদের কবিতা পঠ করে। আমার বিজ্ঞ সম্পাদক সাহেবের উপদেশবানী ও তার মন্তব্যে হতাশ হয়ে কবি হবার বাসনাকে নির্বাসন দিয়ে গুণীজনের সাত কাহন, গদ্য ও কলাম লেখায় মনোযোগী হয়েছি।
উপসংহারে বলবো, কবিতা লিখতে হলে যা প্রয়োজন তা হলো বেশী বেশী করে প্রতিষ্টিত কবিদের কবিতা পাঠ করা ও লেখার চর্চা করা। এর কোন বিকল্প নাই। কবির হাত পাকানোর জন্য অবশ্যই অন্তমিলযুক্ত ছন্দবদ্ধ কবিতা দিয়ে শুরু করা উচিত। কারণ যদি কবিতায় ছন্দ না থাকতো তাহলে পত্রিকার কলামকেও কবিতা বলা হতো। ছন্দ ছাড়া যদি কবিতা হয় তাহলে মীর মোশাররফ হোসেনের 'বিষাদ সিন্দু' এবং বিভূতীভূষণ বন্দোপাদ্যায়ের 'পথের পাঁচালী' উত্তম কবিতার বই। কারণ গাড়িতে ঘুমালেও গাড়ির ছন্দহীনতায় সে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আপনি রেগে যাবেন অবশ্যই। ছন্দহীন কবিতাপাঠেও পাঠকের তেমন বিরক্তি আসবে। তা ছাড়া কবিতাটি কোন ব্লগে পোস্ট করার পূর্বে কোন একজন বিজ্ঞজনকে দিয়ে তার ভুল ত্রুটি সংশোধন করে নেওয়া। আর যারা সত্যিই কবিতা বোঝেন তাদের উচিৎ যথার্থ সমালোচনা করা। শুধু কবিকে সন্তষ্ট করার জন্য বা তার কাছে আসবার চেষ্টা পরিহার করে তার গঠনমূলক পরামর্শ দিন যেন সে আরো ভালো লেখায় উদ্বুদ্ধ হন; ভালো লেখা উপহার দিতে সক্ষম হন। মুক্তছন্দের নামে যারা পত্রিকার কলামের মত করে ছন্দহীন কিছু লাইন সাজিয়ে কবিতা লেখে, তারা কোনোদিনই ভাল কবি হবেন না। আর তা পত্রিকায় ছাপা হলেই খুশি হবারও কারণ নেই। তাই লিখতে হলে ছন্দ শিখতেই হবে। নতুবা কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব, থেকেই যাবে। তাই তথাকথিত কোন কবিতার স্রষ্টা হয়ে কারো বিরক্তির উদ্রেগ করতে চাইনা। আমার লেখার সাথে যারা একমত তাদের মন্তব্য আশা করি । আর যারা দ্বিমত পোষণ করেন তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা । আমার লেখা কারো মনোপীড়ার কারন হলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন এই প্রত্যাশায়।
বিঃদ্রঃ আমার বিশ্বাস কবিতা লেখা বা বুঝার ক্ষমতা সবার থাকে না। আমি সেই দলের। মোটা মাথার কবিতা পাঠক বলা যায়। ছন্দের মিল না থাকলে আমার কাছে সেটা কবিতা বলে মনে হয়না। ছন্দের মিল না থাকলে বা ছন্দপতন কবিতার অংগহানী করে বলে আমার মোটা মাথার উদ্ভট থিউরি। তাছাড়া আমি সম্মানের সাথে সেই সকল প্রতিথযশা ও গুণী গদ্য কবিদের আমার এ লেখার আওতামূক্ত রেখেছি যারা সত্যিই অনেক গদ্য কবিতা লিখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমার লেখা তাঁদের জন্য নয়, আমি ইদানিং বিভিন্ন ব্লগের নব্য কবিদের লেখা নিয়ে আমার স্বাধীন মত প্রকাশ করছি মাত্র। আমি কোন কবিকে আক্রমন করে অদ্যকার লেখাটি লেখিনি। আমার গতানুগতিক লেখার বাইরে অদ্যকার পোস্ট। তবে সব দ্বায়ভার নিয়ে বলছি যারা কবিতা না বুঝে বা না পড়ে ভাল বলে কমেন্ট করেন তাদের কটাক্ষ করে আমার এই লেখা। কারণ আমি আশা ও বিশ্বাস করি আমার এ লেখা কবি ও পাঠক তাদের কবিতা ও মন্তব্য সম্পর্কে সচেতন হবেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১২:১৬