বিবাহিত জীবনের সাথে মানুষের যৌন জীবন অতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেই জীবনের নানা প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি জড়িয়ে আছে আপনার জানা না-জানার উপর। পরিকল্পিত পরিবার গড়ে তোলার ভিত্তিটা তাই মজবুত হওয়া চাই। পরিবার পরিকল্পনার সাথে যে বিষয়ের সম্পর্ক রয়েছে তার নাম ‘নিয়ন্ত্রণ’। আরেকটু সহজ করে বললে, “জন্ম নিয়ন্ত্রণ”। এর জন্য রয়েছে “ক্যাফেটেরিয়া অফ চয়েস”। মানে নিয়ন্ত্রণের একগুচ্ছ পদ্ধতি। সেখান থেকে জেনে বুঝে নিজেদের পছন্দ মত পদ্ধতি বেছে নেয়া। তো যেসব পদ্ধতি রয়েছে সেগুলো হল- ১) পিল, ২) ফোম ট্যবলেট, ৩)নরপ্লান্ট, ৪) ইনজেকশন, ৫) লাইগেশন (টিউবেকটমি), ৬) কপারটি, ৭) ভ্যাসেকটমি (for male), ৮) কনডম (for male), ৯) আইইউডি, ১০) ল্যাম (LAM)।
এদেশের ভাবীদের সুখী করতে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পৌঁছে গেছে ‘মায়া বড়ি’। এদেশে ভাইদের সুখেই ভাবীরা সুখি হন। যেমন ভাইদের জন্য কনডোম বাজারে থাকলেও, তারা তা ব্যবহারে নারাজ। কেননা বিখ্যাত লেখক (নাম টা ইচ্ছে করেই উহ্য রাখা হল) তো পুরুষ কে ভাষা খুঁজে দিয়েছেন। লিখেছেন, পুরুষের জন্য যৌন জীবনে কনডমের ব্যবহার অনেক টা জুতা পড়ে পুকুরে সাতার কাটার অনুভূতি। তাহলে নিতান্ত সাধারনের একটা উক্তি বলি, সাত সন্তানের জনক এক রিকশা চালকের মতে, “মিষ্টি খাইলে হাতে নিয়েই খাইতে হইবো। পলিথিনে মুড়াইয়া মিষ্টি খাওনে কূনো মজা নাই”। আর তাই তিনি রাবার(কনডম) ব্যবহার করেন না।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শতকরা ২৬ ভাগ দম্পতি জন্ম নিরোধের জন্য খাবার বড়ি ব্যবহার করেন। শুদ্ধ ভাষায় জন্মনিয়ন্ত্রণকারী পিল। এই পিলের বিজ্ঞাপনে বলা হয় “স্বল্প মাত্রার” জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী পিল যা সম্পূর্ন “পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন”।এই যে বলা হয়ে থাকে স্বল্প মাত্রার জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী পিল। এবার আমার জানার জায়গা টা হলো, সাধারণ মাত্রাটা কত? আর “পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন” হলে কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে?
সাধারণত বড়ির প্রতিটি পাতায় ২১ টি সাদা বড়ি এবং ৭টি খয়েরি বা লাল রঙ এর বড়ি থাকে। এই বড়ি গুলোতে যে উপাদান থাকে তা ডিম্বানুকে পরিপক্ক হতে দেয় না, তাই গর্ভধারনও হয় না। জন্মনিয়ন্ত্রণকারী বড়ি খাবার আগে জেনে নেয়া প্রয়োজন- জন্ডিস আছে কিনা, উচ্চ রক্তচাপ আছে কিনা, ডায়াবেটিস আছে কিনা, খুব বেশি মাথা যন্ত্রণায় ভুগছেন কিনা, ঋতুস্রাব নিয়মিত হচ্ছে কিনা, তলপেটে বা স্তনে চাকা আছে কি না।
আসুন জেনে নেয়া যাক আশেপাশের ঔষুদের দোকানে পাওয়া যায় এমন কিছু কন্ট্রাসেপটিভ পিল এর নাম, দাম এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারা –
Pill Name - Price - Company Name
1.Noret-28 - 23TK SMC
2.Rosen-28 - 25TK INCEPTA
3.Femicon - 35TK SMC
4.Minicon - 35TK SMC
5.Femipil - 15TK SMC
6.Mervelon - 105TK NOVESTA
7.Desolon - 85TK RENATA
8.Orastat Gold - 65TK NOVESTA
কন্ট্রাসেপটিভ পিল বা জন্ম বিরতিকরণ পিল তৈরি হয় এসট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরোন নামক দুই ধরনের হরমোন দ্বারা। এসস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন সমন্বিত পিল ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। এসস্ট্রোজেন সব সময়ই রক্তে লিপিডের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। তাই যাদের অনেক আগে থেকেই রক্তে লিপিডের পরিমান বেশি, জন্ম বিরতিকরণ পিল খাওয়ার আগে তাদের জন্য বাড়তি সচেতনতা জরুরি। বিশেষত যাদের শরীরে জন্মগতভাবেই লিপিডের মাত্রা উচ্চ- তাদের জন্য এইসব পিল একেবারেই নিষিদ্ধ। এসস্ট্রোজেন মায়ের দুধের পরিমান কমিয়ে দেয়, ফলে শিশু খেতে পায় না।
পিলের সুবিধা গুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেযোগ্য হল, অনাকাংক্ষিত গর্ভধারন রোধ করে। আর ব্যবহারে সুবিধা হয় 'ওরাল' বলে।
আর অসুবিধা?????
- বমি বমি ভাব
- বমি হওয়া
- মাথা ঘোরা, মাথা ব্যাথা
- স্তনে ব্যাথা
- বিষণ্ণতা
- চুল পড়ে যাওয়া
- কাম শক্তি কমে যাওয়া
- রজঃস্রাবের সময় পেট ব্যাথা হওয়া, পেট কামড়ানো
- পায়ের মাংশ পেশিতে যন্ত্রণাদায়ক খিল
- অনিওয়মিত রজঃস্রাব
- সাদা স্রাব
- যোনি ও যোনি মুখে ক্যানডিরার আক্রমণ
- ওজন বেড়ে যাওয়া
- চর্বি বেড়ে যাওয়া
- প্যানক্রিয়াটাইটিস
- গলব্লাডার স্টোন
- গ্লাইকোসুরিয়া
- উচ্চ রক্ত চাপ
- রক্তনালি তে রক্তের জমাট বেঁধে যাওয়া
- জরায়ুতে ফাইব্রয়েড নামক টিউমার হওয়া
- স্তনের ক্যান্সার
শরীরের যাবতীয় অনাচার সহ্য করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বেছে নিতে হয় নারীদেরকে। কেননা জরায়ু যেহেতু তার, তাই জগতের যাবতীয় গরল তো তাকেই গলধকরন করতে হবে। এখানে ক্ষমতার চর্চাকে অগুরুত্বপূর্ন ভাবলে চলবে না। ফুকোর ক্ষমতার চর্চা কিংবা বডি পলিটিকস এর কথাই যদি বলি। তবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা পুরুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ঠেলে দিয়েছেন নারীর দিকে। তাদের জন্য সহজ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ পদ্ধতি থাকলেও তারা সেগুলো ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার নামই তো রাজনীতি। পুরুষেরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে প্রায়শ ঝামেলা বা বাড়তি দায়িত্ব বলে মনে করেন। তাই চিকিৎসকরা পর্যন্ত নারীকেই উৎসাহীত করেন জন্ম বিরতিকরণ বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহনে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ বলতে সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং প্রত্যাশিত সময়ে গর্ভধারন কে বোঝানো হয়। ১৯৫৩ সালে বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠান প্রথম পরিবার পরিকল্পনার কাজ শুরু করে। তার প্রায় একযুগ পর সরকারী প্রতিষ্ঠান এই উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জনসংখ্যা সমস্যা কে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে জনসংখ্যা নীতির রুপরেখায় “পরিবার পরিকল্পনা নীতি” প্রনীত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৫৬ ভাগ।
জন্ম নিয়ন্ত্রণ কারী পিলের আগে প্রজনন রোধ করতে খ্রিষ্টপূর্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতে মিশরের মেয়েরা অ্যাকাসিয়া পাতার সঙ্গে মধু যোগ করে অথবা জীবজন্তুর মল থেকে সাপোজিটরি তৈরি করে জরায়ুতে স্থাপন করত। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রীসে অলিভ অয়েলের সঙ্গে সিডার তেল মিশিয়ে মলম তৈরি করে তা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জরায়ুর ভেতর ব্যবহার করতো মেয়েরা। মার্গারেট সাঙ্গার নামের এক নারী যিনি পেশায় ছিলেন নার্স। চিরকুমারী এই নারী প্রথম জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল বানাবার স্বপ্ন দেখেন।অধিক সন্তান জন্মদানের কারনে মায়ের তিলে তিলে নিঃশেষিত হয়ে মৃত্যু তাকে বেশ নাড়া দেয়। তিনি যেহেতু বিজ্ঞানী ছিলেন না তাই বড়ি বানাবার জ্ঞান বা পদ্ধতি তার জানা ছিলো না। আর্থিক সাহায্য দেয়ার জন্য এগিয়ে আসেন ক্যাথরিন ম্যাককরমিক নাম্মী এক সম্পদশালী নারী। তারা দুজনে মিলে খুঁজে বের করেন তরুন মেধাবী বিজ্ঞানী গ্রেগরী পিনকাস এবং প্রগতিশীল চিকিৎসক জন রক কে। যাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও যৌথ গবেষণার ফলে ১৯৬০ এর দশকে আবিস্কৃত হয় জন্ম নিয়ন্ত্রণকারী পিল।১৯৯৪ সালে কায়রোতে জাতিসংঘ আয়োজিত নারী, প্রজনন ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওপর ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় (ICPD)।
পিল খাওয়ার প্রভাব :
১) মেদ বাড়িয়ে শরীর ভারি ও অসাড় করে দেয় ।
২) বেশি দিন ধরে খেতে থাকলে একটা পর্যায়ে শরীরে সারাক্ষণ ক্লান্ত অনুভূত হতে পারে ।
৩) প্রতিনিয়ত খাওয়ার প্রভাবে মেয়েদের জরায়ুর আকার ছোট হয়ে যেতে পারে ।
৪) মেয়েদের মাথা ঝিমঝিমানির বড় কারণ নিয়মিত এসব পিল সেবন ।
৫) নিয়মিত ৫ বছরের বেশি সময় খেতে থাকলে পরবর্তীতে মেয়েদের সন্তান ধারণে অক্ষমতা দেখা দিতে পারে।
৬) এসব পিল বেশি বেশি খাওয়ায় মাঝে মাঝে ঘুম থেকে ওঠার পর মেয়েরা শরীরে চলাফেরার মতো শক্তিও হারিয়ে ফেলে।
৭) নিয়মিত ও দীর্ঘদিন জন্ম বিরতিকরন পিল খেলে সার্ভাইকাল ক্যান্সার সহ স্তন ক্যান্সার, ওভারিয়ান ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৮) এই জন্ম বিরতিকরণ পদ্ধতি বন্ধ করে দেয়ার পর গর্ভধারণে দেরি হতে পারে।
৯) এইচআইভি/এইডস সহ যৌন সংক্রামক অসুখ প্রতিরোধে কোনো কার্যকরী ভূমিকা রাখে না।
একটু সচেতনতা যদি জীবনটাকে আরো সুন্দর করে তবে সচেতন হতে ক্ষতি কী? দীর্ঘস্থায়ী নিরাপদ জীবন হোক আমাদের সবার কাম্য। যৌথ জীবন হোক আস্থা, নির্ভরতা আর নির্ভাবনার জীবন।
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৬:০৬