অপারেশন জ্যাকপট হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌসেক্টর পরিচালিত সফলতম একটি গেরিলা অপারেশন। সেটি ছিল একটি আত্মঘাতী অপারেশন। সেই অপারেশন ১৯৭১সালের ১৫ই আগস্ট রাত ১২টার পর অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম এবং মংলা সমুদ্র বন্দর ও দেশের অভ্যন্তরে চাঁদপুর এবং নারায়নগঞ্জ নদী বন্দরে একই সময়ে পরিচালিত হয়। ১০নং সেক্টরের অধীনে ট্রেনিং প্রাপ্ত নৌ কমান্ডো যোদ্ধাদের অসীম সাহসিকতার নিদর্শন হল সেই অপারেশন জ্যাকপট। সেই গেরিলা অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকগুলো অস্ত্র এবং রসদবাহী জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বড় রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজগুলোর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্যকারী অনেকগুলো বিদেশি জাহাজও থাকায় সেই অপারেশন বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং যোদ্ধাদেরকে সারা বিশ্বে পরিচিতি পাইয়ে দেয়।সারা বিশ্ব বুঝতে পারে বাংলাদেশও পাকিস্তানের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই লড়ছে।
অপারেশন জ্যাকপটের আংশিক নকশা। সঠিক তথ্যের অভাবে কিছু স্থান আনুমানিকভাবে চিহ্নিত।
নৌকমান্ডো সেক্টর
বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল তার মধ্য দেশের অভ্যন্তরীন সকল নৌ চলাচল ও বন্দর এবং উপকূলীয় এলাকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ১০নং সেক্টর বা নৌসেক্টর। এ সেক্টরের কোন নির্দিষ্ট সেক্টর কমান্ডার ছিল না। যখন যে সেক্টরে অপারেশন চলত তখন সেই সেক্টরের কমান্ডারদের সহযোগীতায় নৌগেরিলাদের কাজ করতে হত। তারা সরাসরি মুজিবনগর হেডকোয়ার্টারের অধীনে কাজ করতেন।
আগের কথাঃ
মার্চের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সাবমেরিন পি এন এস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায় পাকিস্তানি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য। সেই একচল্লিশ জন সাবমেরিনারদের মধ্যে তেরজন ছিলেন বাঙালি অফিসার। তারা আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ২৫শে মার্চের গণহত্যার কথা শুনে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাদের মধ্যে ৮ জন ৩০শে মার্চ বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১৯৭১সালের ৯ই এপ্রিল তারা দিল্লিতে এসে পৌছান।এখানে তাদের নাম উল্লেখ করা হলোঃ
(১)মোঃ রহমতউল্লাহ।
(২)মোঃ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন।
(৩)মোঃ শেখ আমানউল্লাহ।
(৪)মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
(৫)মোঃ আহসানউল্লাহ।
(৬)মোঃ আবদুর রকিব মিয়া।
(৭)মোঃ আবদুর রহমান আবেদ।
(৮)মোঃ বদিউল আলম।
এরপর উক্ত ৮জনের সাথে আরো কয়েকজনকে একসাথ করে ২০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করে তাদেরকে ভারতে বিশেষ ট্রেনিং দেওয়া হয়। এরপর তারা দেশে আসলে তাদের সাথে কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করানো হয়। তখন ওসমানী নৌকমান্ডো বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
গেরিলা ট্রেনিং পর্ব
ওসমানীর সিদ্ধান্তে নৌকমান্ডো সেক্টর খোলার পর বাছাইকৃত গেরিলাদের ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে ১৯৭১সালে ২৩শে মে তারিখে একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়। সেই ট্রেনিং ক্যাম্পের সংকেতিক নাম দেওয়া হয় সি২ পি (C-2 P)। সেখানে ট্রেনিং দেওয়ার উদ্দেশ্যে অন্যান্য সেক্টরসমূহের বিভিন্ন শিবির থেকে মে মাসের শুরুর দিকে প্রায় ৩০০ জন বাছাইকৃত যোদ্ধা সংগ্রহ করা হয়। ট্রেনিং ক্যাম্পে তাদের কি ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যেও শুধুমাত্র যার এলাকায় অপারেশন চালানো হবে তিনি ব্যতীত আর কেউ সেই সম্পর্কে জানতেন না।
ট্রেনিং শুরু হবার আগেই বাছাইকৃত যোদ্ধাদের বলে দেওয়া হয় যে এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন বা আত্মঘাতী যুদ্ধ হবে। তাই অপারেশনের সময় যেকোন মূল্যে অপারেশন সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীদের ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফর্মে স্বাক্ষর নেওয়া হতো।ফর্মে লেখা থাকতো যে আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।
নৌকমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার কমানডার এম এন সামানত এবং ট্রেনিং দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন লেঃ কমান্ডার জি এম মার্টিস এবং আরো ভারতীয় বিশ জন প্রশিক্ষক তারা হলেনন লেঃ দাস, লেঃ ভিপি কফিল। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা আট জন সাবমেরিনার ছাড়াও আরো ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর লিডিং সি,মান কে.সিং, লিডিং সি,মান গুপ্ত, এল সিং, মারাঠি নানা বুজ এবং সমীর কুমার দাশসহ আরো কয়েকজন।
ট্রেনিং এর দুটো অংশ ছিল। সবাইকে প্রয়োজনীয় স্থলযুদ্ধ যেমনঃ গ্রেনেড নিক্ষেপ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালানো, আন আর্মড কমব্যাট খালি হাতে যুদ্ধ, ইত্যাদি শিখতে হতো। আর জলযুদ্ধের ট্রেনিঙের মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের সাতার যেমনঃ বুকে ৫থেকে৬কেজি ওজনের পাথর বেধে সাতার, চিৎ সাতার কোন মতে পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেক্ষন সাতার পানিতে সাতরিয়ে এবং ডুব সাতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে। শীত বর্ষায় একটানা আটচল্লিশ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হয় সব যোদ্ধাকে। প্রায় টানা তিনমাস ট্রেনিং এর পর আগস্টের প্রথম সাপ্তাহে তাদের ট্রেনিং শেষ হয়।
অপারেশনের বর্ণনা
যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের শেষদিকে এসে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সাথে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর এবং দুই নদী বন্দরে আক্রমণ চালানোর জন্য চার সেক্টরের পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচকে চার স্থানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মোট চারটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। ষাট জনের দুইটি দল এবং বিশ জনের আরো দুইটি দল। চারটি দলের চারজন লিডার ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। টিম লিডারদের অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ গোপনীয় পদ্ধতি যা টিমের অন্যান্য সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। টিম কমান্ডারদের বলা হয়েছিল যে দুটি বাংলা গানকে সতর্ক সঙ্কেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। গান দুটি প্রচার করা হবে কলকাতা আকাশবানীর পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে সকাল ৬টা থেকে ৬:৩০ মিনিট অথবা রাত ১০:৩০ মিনিট থেকে রাত ১১টায়। এই ফ্রিকোয়েন্সির নাম এবং গান দুইটি শুধু টিমের কমান্ডারই জানতো। গান দুটি অথবা তাদের সঙ্কেত হলোঃ
প্রথম সংকেত ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া "আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান "এর অর্থ হল ২৪ ঘন্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর গাওয়া গান "আমার পুতুল যাবে শ্বশুরবাড়ি "গানটি ছিলো দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর। অর্থাৎ সুস্পষ্ট আক্রমণ করতেই হবে।
দলগুলোর বর্ণনা
দল ১ সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ৬০ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ।
দল ২ নৌ-কমান্ডো আমিনুর রহমান খসরু ২৬০ (৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন সি আন্ড সি কমান্ডো) মংলা সমুদ্র বন্দর ।
দল ৩ সাবমেরিনার বদিউল আলম ২০ চাঁদপুর নদী বন্দর ।
দল ৪ সাবমেরিনার আবদুর রহমান ২০ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর ।
যাত্রা শুরু হয়েছিল পলাশির হরিনা ক্যাম্প থেকে। পরিকল্পনা অণুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তারা একযোগে পৌছে যাবেন স্ব স্ব এলাকা চট্টগ্রাম,মংলা, চাঁদপুর এবং নারায়ণগঞ্জ।তারা যাত্রা করার সময় তাদেরকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র দিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেক নৌকমান্ডোকে একটি করে লিমপেট মাইন,ছুরি,একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার দেওয়া হয়। প্রতি তিন জনের জন্য একটি করে স্টেনগান এবং কমানডারদের দেওয়া হয় একটি করে ট্রানজিস্টার। অপারেশনের দিন ধার্য করা হয়েছিল ১৯৭১সালের ১৫ই আগস্ট।
নিচে অপারেশন গুলোর কিছু বর্ননা দেওয়া হলঃ
১। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অপারেশন
চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট প্রথম প্রহরে। হরিনা ক্যাম্প থেকে আগত ষাট জনের দলকে বিশ জন করে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১ এবং ২ নং দল তাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট বেইজ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে এবং ১৪ই আগস্ট তারা প্রথম গানের সংকেত পান। সেই সংকেত পাবার পর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কর্ণফুলী নদীর পূর্বতীরে চরলক্ষ্যায় তাদের বেইজ ক্যাম্পে পৌছায়। ৩য় দলটির তখনো কোন খবর পাওয়া যায় নি। তারপর ১৫ই আগস্ট তারা ট্রানজিস্টারে চূড়ান্ত সংকেত পান এবং অপারেশনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। সে অপারেশনে একত্রিশ জন কমান্ডো যোদ্ধা অংশ নেন। ১৬ই আগস্ট প্রথম প্রহরে রাত ১টায় নৌকমান্ডোরা তাদের অপারেশনের জন্য যাত্রা করেন। রাত ১টা ১৫মিনিট তে তারা পানিতে নেমে জাহাজের উদ্দেশ্যে সাঁতরানো শুরু করেন এবং বেশ দ্রুততার সাথে নিজ নিজ বাছাইকৃত টার্গেট জাহাজসমূহের গায়ে মাইন লাগিয়ে সাঁতার কেটে সরে পরেন। রাত ১টা ৪০ মিনিটে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর একে একে সব গুলো মাইন বিস্ফোরিত হয়।সে সফল অপারেশনে তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ এবং বড় জাহাজ গুলো হলোঃ
এম ভি হরমুজ, এটি ১৪ই আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ৯৯১০ টন অস্ত্রসম্ভারবাহী এই জাহাজটি ১৩ নং জেটিতে নোঙর করা ছিল।
এম ভি আল আব্বাস এটি ১০৪১৮ টন সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ৯ই আগস্ট ১২ নং জেটিতে অবস্থান নেয়।
ওরিয়েন্ট বার্জ নং ৬ এটি ৬২৭৬ টন অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে ফিস হারবার জেটির সামনে অবস্থান করছিল।
মংলা সমুদ্র বন্দর অপারেশন
১৯৭১সালের ২৭শে জুলাই ষাট জন নৌকমান্ডো এবং দুইশত জন বাংলাদেশী সি আন্ড সি বিশেষ কমান্ডো দল আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ভারতের কানিং মাতলার বন্দর থেকে মংলা অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সুন্দর বনের গভীর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কমান্ডো দলটি ১৯৭১ সালের ১৩ ই আগস্ট সন্ধা ৬ টায় মংলা বন্দর পৌঁছান। ২৬০ জনের কমান্ডো দলটি মংলা বন্দর এবং ডাংমারি বিলের পিছনে পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে অবস্থান নেন। সেখান থেকে মংলার দূরত্ব ডাংমারি বিলের মাঝ দিয়ে ছয় মাইল আর নৌকায় পৌঁছোতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা। ১৯৭১সালের ১৫ই আগস্ট রেডিও মারফত একশন গান বাজার পর তারা পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল অপারেশনের সাফল্যের জন্য বিশেষ দোয়া করেন। ঠিক রাত ১২টায় কমান্ডোরা ১৫টি নৌকায় মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। মংলায় পৌঁছানোর শেষ সময় নির্ধারিত ছিল রাত ২ টা কিন্তু পথ পরিদর্শকের ভুল পরিচালনায় কমান্ডোরা নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে মংলা বন্দরে পৌঁছায়। ইতোমধ্যে অপারেশনের নকশা মাফিক বাংলাদেশের সব নদী এবং সমুদ্র বন্দরে অপারেশন শেষ। এ অপারেশন শুধু মাত্র জীবনের ঝুঁকিই নয় বরং মংলায় ১৯৭১সালের ১৬ই আগস্ট ভোরের এ অপারেশন ছিল সরাসরি একটি সুইসাইড একশান। সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ভোর ৪:৩০ মিনিটে মংলা অপারেশন শুরু হয়,অপারেশন চলা কালে ২০০ জন সি আন্ড সি বিশেষ কমান্ডো দল, হেভি মেশিন গান, মেশিনগান, এনরগা সহকারে ৩ জনের ছোট ছোট দল করে, ৬৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে , নৌকমান্ডোদের ছাউনি দিতে (কভারিং দিতে) মংলা বাঁধের পিছনে অবস্থান নেন। অপারেশন চলাকালে, সি আন্ড সি কমান্ডো দলের উপকমান্ডার রাজা এবং খিজির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকমান্ডোদের সহযোগিতায় মেশিনগান নিয়ে পশুর নদীর হাঁটু পানিতে নেমে আসেন। সময়ের অভাবে শুধুমাত্র ২৪ জন নৌকমান্ডো এই অভিযানে অংশ নিতে পেরেছিলেন। ৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ২৪ জন নৌকমান্ডো ৬টি বিদেশী জাহাজে মাইন লাগণ, ভোর ৬.৩০ মিনিট থেকে নৌকমান্ডোদের লাগানো মাইন বিকট শব্দ করে ফাটতে শুরু করে। ৩০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ৪টি বিমান মংলা বন্দরের উপরে ঘুরতে দেখা যায়। আক্রান্ত জাহজগুলির মধ্য একটি সোমালীয়, একটি মার্কিন, ২টি চীনা, ১টি জাপানি এবং ১টি পাকিস্তানী জাহাজ। এই অপারেশনে আক্রান্ত মোট ৬টি বিদেশী জাহাজই ধ্বংস হয় এবং ৩০,০০০ হাজার টন গোলা বারুদ এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম সহকার ধীরে ধীরে পশুর নদীতে নিমজ্জিত হয়। মংলা অপারেশন কমান্ডার আমিনুর রহমান,খসরু এবং আরো ২ জন নৌকমান্ডো এই অপারেশনে মংলা বন্দর এর অতিরিক্ত বাধা পার হয়ে অসীম সাহসিকতার সাথে সোমালীয় ৭,০০০ হাজার টনের অস্ত্রসম্ভারবাহী জাহাজ এস,এস,লাইটং মাইন লাগান এবং এস.এস. লাইটং কে ধ্বংস করেন। এই অপারেশনে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন, ধারণা করা হয় তারা স্রোতের টানে ভেসে গেছেন অথবা মারা গেছেন।
চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশন
এ অপারেশনটিও ১৯৭১সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত বা ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে হয়েছিল। এই অপারেশনে ১৮ জন নৌকমান্ডো অংশ নিয়েছিলেন। এ গ্রুপের ১৮ জনকে তিনজন করে মোট ৬টি ছোট দলে ভাগ করা হয়।এই অভিযানে মাইন বিস্ফোরণে ২টি স্টিমার, গমবাহী একটি জাহাজ সহ ছোট বড় আরো অনেকগুলো নৌযান ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অপারেশন
এই অপারেশনটিও ১৯৭১সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাত বা ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে হয়েছিল। এ অপারেশনে মোট ৪টি জাহাজ ও বেশ কয়েকটি নৌযান নৌ কমান্ডোরা ধংস করেন। শহরের মাঝে এই অপারেশনে কমান্ডোরা বিশেষ সাহসকতার পরিচয় দেন। এই অপারেশনে মোট ২০ জন কমান্ডো অংশ নেন।
অপারেশনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ
১৫ই আগস্টের সেই অপারেশনগুলোতেই প্রায় ২৬টি জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং আরো অনেক নৌযান ক্ষতিগ্রস্থ হয়।আগস্ট মাসের সেসব অপারেশন ছাড়াও আগস্ট,নভেম্বর মাসব্যাপী আরো অনেকগুলো নৌকমান্ডো অপারেশন পরিচালনা করা হয়। সেসব অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হলঃ
প্রায় সর্বমোট ৫০৮০০ টন জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও নিমজ্জিত।
৬৬০৪০ টন জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত।এবং বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি নৌযান বাংলাদেশী নৌকমান্ডোদের হস্তগত।
তথ্যসূত্র; ও উৎর্স;
বাংলা উইকি পিডিয়া
সাখাওয়াত হোসেন মজনু। রণাঙ্গণে সূর্য সৈনিক। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র,চট্টগ্রাম।
শামসুল হুদা চৌধুরী। একাত্তরের রণাঙ্গণ। আহমদ পাবলিশিং।
রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে। অনন্যা প্রকাশনী। আইএসবিএন 984-412-033-0।
লে কর্নেল(অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। নাজমহল। পৃ: পৃষ্ঠা ২৩১–২৩৭।
ডাঃ মাহফুজুর রহমান। বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র,চট্টগ্রাম। আইএসবিএন 984-8105-01-8।
খলিলুর রহমান (২০০৭)। মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান। সাহিত্য প্রকাশ। আইএসবিএন 984-465-449-1।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৬