কাজী আনোয়ার হোসেন: আমরা সাত বোন চার ভাই একই পরিবারে জন্মেছি বটে কিন্তু আব্বু আমাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে মানুষ করেছেন, প্রত্যেকের প্রতি আলাদা যতœ নিয়েছেন। যার যেমন অন্তরের তাগিদ ও চাহিদা, তাকে ঠিক তা-ই যুগিয়েছেন। যার যতোটা প্রয়োজন তাকে ততোটাই স্বাধীনতা দিয়েছেন, দিয়েছেন সুযোগ-সুবিধা। আমরা যে যার মতো নিজ নিজ পছন্দের লাইনে বেড়ে উঠেছি। প্রয়োজন হলেই তিনি এগিয়ে এসে বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। খোলা মনের মানুষ ছিলেন, কখনোই অঙ্ক ছাড়া আর কোনো বিষয়ে জোর-জুলুম করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির সোপান হলো অঙ্ক। এটা না জানলে কিছুই ঠিকমতো জানা হবে না, বিকাশ হবে না বুদ্ধির। সেই সঙ্গে ইংরেজিটা ভালো করে শিখে নিলে দুনিয়াটা খোলা থাকবে, কেউ আর আটকে যাবে না কোথাও।
প্রশ্ন: বাবা বা মায়ের কোনো বিশেষ গুণ কি আপনাকে আকৃষ্ট করতো?
কাজী আনোয়ার হোসেন: আমার মায়ের প্রধান আকর্ষণ ছিল মস্ত বড় হৃদয়, অফুরন্ত স্নেহ আর বিশাল প্রবাদ-বচনের ঝুড়ি। আর ছিল দুর্বলের প্রতি দুর্বলতা। একবার আমাদের ১২ বছর বয়সী দুষ্ট কাজের ছেলেটা ঢিল মেরে বস্তিবাসী এক মেয়েকে জখম করায় বস্তির সব লোক লাঠি নিয়ে ছুটে এসেছিল ওকে মারবে বলে। সে ছোকড়া তো আম্মু আম্মু বলে চিতকার করতে করতে ছুটছে বাড়ির দিকে। কিন্তু বড়দের সঙ্গে পারবে কেন? গেট দিয়ে ঢোকার মুখেই ধরা পড়ে গেল তাদের হাতে। এদিকে ডাক শুনে আমার আম্মুও বেরিয়ে এসেছেন বাইরে। ছেলেটাকে ভয়ে ঠক ঠক করতে দেখে প্রথমেই ওকে লোকগুলোর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজের পেছনে আড়াল করলেন, তারপর শুনলেন তাদের নালিশ। সব শুনে মেয়ের বাপকে ১০টা (সে কালের তুলনায় অনেক) টাকা দিয়ে বললেন, যাও, ডাক্তারখানা থেকে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনো। পরমুহূর্তে ফিরলেন ছোকরার দিকে, তোকে আজ আমি খুনই করে ফেলবো। ওকে নিয়ে ঘরে চলে যাচ্ছেন দেখে হই-হই করে উঠলো লোকজন, অরে আমাগো হাতে ছাইরা দ্যান, আম্মা। আমরাই ছেইচ্চা ফালামু হালারে! আমার মা শুধু বিরক্ত চেহারায় পেছনে চাইলেন একবার, তারপর সাফ জানিয়ে দিলেন, না!
সন্ধ্যার সময় আমাদের পারিবারিক আড্ডায় হাসতে হাসতে এ ঘটনা বর্ণনা করে শোনালেন আম্মু। হাসির কারণ ওই ছেলের কম্পন ও ভেজা হাফপ্যান্ট। দেখলাম দরজার পাশে মেঝেতে বসে মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে ব্যাটা। আমাদের রোজকার আড্ডায় সে-ও হাজির থাকতো সব সময়। পাচ বছরের বোনঝি কেয়া থেকে নিয়ে আমাদের ৮০ বছরের নানিও ছিলেন নিয়মিত সদস্য। সবার জন্য খোলা ছিল আম্মুর আসর।
আর বাবার যেসব গুণ আমাকে আকর্ষণ করেছে সেগুলো হচ্ছে অসীম ধৈর্য, কষ্টসহিষ্ণুতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, অধ্যবসায়, অকান্ত পরিশ্রম আর প্রতিটা বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ। এসব নিয়ে অনেকে অনেক কিছুই বলেছেন, তাই বিস্তারিত আর বলছি না।
প্রশ্ন: একান্নবর্তী পরিবারে আপনি বেড়ে উঠেছেন। প্রতিভা বিকাশে এ পারিবারিক পটভূমি আপনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে?
কাজী আনোয়ার হোসেন: আমাদের পরিবারটা বেশ বড় ছিল। কিন্তু এটাকে ঠিক একান্নবর্তী পরিবার বলা যাবে না। দুঃসময়ে মাঝে মধ্যে আত্মীয়-স্বজন দীর্ঘদিন আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। কিন্তু মা-বাবা আর আমরা ১১ ভাইবোনই ছিলাম এ পরিবারের সদস্য। চাচারা যার যার পরিবার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শহরে বা গ্রামে বাস করতেন। তবে বড় পরিবারে মানুষ হওয়ার বিশেষ সুবিধা তো আমরা পেয়েছিই। একজন আরেকজনকে দেখে শিখেছি, সবাই লম্বা টেবিলে লাইন দিয়ে বসে যা জুটেছে তা-ই খেয়েছি। অতি আদরে বখে যাওয়ার সুযোগ পাইনি।
প্রশ্ন: এক সময় কলমের জাদু দেখিয়ে এ দেশের বিনোদন পিয়াসী পাঠকদের চমকে দিয়েছিলেন আপনি। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে সাহায্য করেছিলেন। এ অনুপ্রেরণা আপনি কোথায় পেয়েছিলেন?
কাজী আনোয়ার হোসেন: চমক সৃষ্টি হয়েছিল কি না জানি না, তবে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছি। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে দুর্বোধ্য বা অলঙ্কৃত বাংলা না লেখার পণ ছিল আমার। যা বলার, বাহুল্যবর্জিত সহজ ভাষায় সহজ করে বলবো। বিষয়বস্তু যদি আকর্ষণীয় হয়, পড়বে পাঠক, এ-ই ছিল আশা।
মাসুদ রানার প্রথম বই ধ্বংস-পাহাড় আট-দশবার চেষ্টা করেও শুরু করতে পারিনি। কিছুটা লেখার পর ফেলে দিতে হয়েছে, বুঝেছি পান্ডিত্য অ্যাকশন-থ্রিলারের জন্য নয়। ঠিক যা ঘটছে সহজ ভাষায় তা-ই বলতে হবে।
মানুষ যখন দেখলো, মাসুদ রানা বইয়ের সব কথা সহজে বোঝা যায়, বর্ণনা পড়ে মনে হয় দেখছি চোখের সামনে তা ছাড়া বিষয়বস্তু বাংলাভাষায় একেবারে আনকোরা তখন পাঠকপ্রিয়তা আসতে দেরি হয়নি। একজনকে মজা পেতে দেখে হাতে তুলে নিয়েছে আরেকজন, এভাবে গড়ে উঠেছে পাঠক ও পাঠাভ্যাস। আর অনুপ্রেরণার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে শ্রী হেমেন্দ্র কুমার রায়ের নাম উচ্চারণ করতেই হবে। ছোটবেলায় তার লেখা যখের ধন ও আবার যখের ধন, আর কার লেখা মনে নেই রবিন হুড আমাকে হাসিয়ে-কাদিয়ে পাগল করে দিয়েছিল একেবারে। রহস্য-রোমাঞ্চের প্রতি কৈশোরের সেই অমোঘ টান, বড় হয়েও যায়নি আমার। শুধু নিজে মজা পেয়েই সাধ মেটেনি, আমি যে মজা পাচ্ছি, পাঠককে তার ভাগ দেয়ার প্রবল ইচ্ছাও সম্ভবত তারাই জন্মে দিয়েছিলেন আমার মধ্যে।
প্রশ্ন: তরুণ পাঠকদের যদি নিজের পছন্দের পাচটি বই পড়তে বলেন, কোন বইগুলোর নাম বলবেন?
কাজী আনোয়ার হোসেন: পাচটি কি বই? সেবা প্রকাশনীর? আমি তো বলবো পাচটি কেন, সেবার সব বই পড়ুক সবাই (আসলে ঠাট্টা করলাম)। এ দেশি বাংলা বইয়ের মধ্যে প্রথমেই পড়তে বলবো হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে, মুহম্মদ জাফর ইকবালের দিপু নাম্বার টু, পশ্চিম বাংলার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়, ইংরেজি বইয়ের মধ্যে উইলবার স্মিথের আই অফ দি টাইগার আর অ্যালিস্টেয়ার ম্যাকলিনের হোয়েন এইট বেলস টোল।
প্রশ্ন: মাসুদ রানার কোন চরিত্রগুলো আপনার মনে দাগ কেটেছে?
কাজী আনোয়ার হোসেন: আই লাভ ইউ, ম্যানের ‘রডরিক’, অগ্নিপুরুষের লুবনা আর সাগর সঙ্গমের গিলটি মিয়া। এছাড়া আরো অনেকে আছে, এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না বলে আমি তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনি একজন সৌখিন ফটোগ্রাফার। অতীতে বেশকিছু বিখ্যাত ছবি তুলেছেন। তুলতে গিয়ে কখনো এমন কিছু ঘটনা কি ঘটেছে যা আপনাকে আজো কষ্ট দেয়, অথবা হাসায়? এ ধরনের স্মরণীয় একটা ঘটনার কথা বলবেন কি?
কাজী আনোয়ার হোসেন: ফটোগ্রাফির শখ ছিল ঠিকই কিন্তু আমাকে সৌখিন ফটোগ্রাফার বললে বাড়িয়ে বলা হবে। আমি আর্ট ফটোগ্রাফির ধারে-কাছেও যাইনি কখনো। ক্যামেরা ব্যবহার করেছি শুধু মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখার জন্য।
একটি ছেলের করুণ মৃত্যুর ছবি তুলেছিলাম বহু বছর আগে। ওর নাম ফারুক। আজো কষ্ট দেয় আমাকে ওই ছেলেটির স্মৃতি। খুব সম্ভব সেটা ছিল ১৯৭৩ সাল। দোতলায় আমার পড়ার ঘরে বসে টাইপরাইটারে কি যেন লিখছিলাম। দুপুরের দিকে কাছাকাছি কোথাও থেকে দুটো গুলির শব্দ হলো, সেই সঙ্গে কানে এলোÑ ডাকাত ডাকাত চিতকার।
ক্যামেরা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখলাম ৪০ গজ দূরে রাস্তার তেমাথায় দুটি অল্প বয়সী ছেলেকে বেদম পেটাচ্ছে মানুষ। কি হয়েছে, কেন মারছে, কিচ্ছু জানি না। জিজ্ঞাসা করেও কারো কাছে সদুত্তর পেলাম না। যারা মারছে, তারাও জানে না কি ওদের অপরাধ। শুধু জানে, ধরা পড়েছে ডাকাত। মার, মার! বলে গলা ফাটিয়ে চেচাচ্ছে সবাই। মানুষের মাথায় যেন খুন চেপে গেছেÑ কারো হাতে লাঠি, কেউ নিয়েছে ১০ ইঞ্চি ইট, কেউ সমানে কিল-ঘুসি চালাচ্ছে দুই হাতে। সুদর্শন একটি ছেলেকে দেখলাম, মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওকে রাস্তার পাশে একটা বাড়ির আঙিনায়।
আমার হাতে ক্যামেরা দেখে ছেলেটি হয়তো ভাবলো আমি সাংবাদিক, ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বাচান! প্লিজ, আমাকে বাচান! আমার গেঞ্জি ভিজে গেল ওর রক্তে। আমার বুক থেকে টেনে হিচড়ে ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওকে উন্মত্ত জনতা। বুঝতে পারলাম, ভদ্রলোকের ছেলে, মার খাচ্ছে বেঘোরে। হতবুদ্ধি হয়ে ভাবছি, এ মারপিট কি করে বন্ধ করা যায়, ঠিক তখনই কানে এলো, পুলিশ এসে গেছে। আশ্বস্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা অপর তরুণের কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে ফিরে গেলাম নিজের কাজে। ১০ মিনিটও যায়নি, শুনলাম, নিচের রাস্তায় কে যেন বলছে, মাইরা ফালাইছে, গলায় পাও দিয়া মাইরা ফালাইছে ছ্যারাটারে!
আবার ছুটলাম। সত্যিই, জাঙ্গিয়া পরা অবস্থায় চিত হয়ে পড়ে আছে ফারুক, জামা-কাপড় ছিড়ে নিয়ে গেছে মানুষ। পুলিশ যথারীতি নীরব ভূমিকা পালন করেছে, উন্মত্ত জনতার সামনে পড়ে গেলে যেটা স্বাভাবিক।
ছবিগুলো নিজেই ডেভেলপ ও প্রিন্ট করেছিলাম রাত জেগে, ঘটনার বর্ণনা ও আমার অসহায় উপলব্ধির কথা লিখেছিলাম। ছাপা হয়েছিল সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও হলিডে পত্রিকায়।
ওই ছেলেটিকে বাচাতে পারিনি বলে আজো আমার বুকের ভেতরটা ব্যথায় টন টন করে।
প্রশ্ন: শিকার করতে বা মাছ ধরতে যান এখনো?
কাজী আনোয়ার হোসনে: না। শিকার সরকার নিষিদ্ধ করেছে আজ বহু বছর হলো, আর ধানমন্ডি লেকে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছে সিটি কর্পরেশন। দুটোই বন্ধ।
প্রশ্ন: নতুন লেখকদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
কাজী আনোয়ার হোসেন: নেই। লেখক জন্মায়, পরামর্শ দিয়ে কাউকে লেখক বানানো যায় না। যে লিখবে সে নিজের ভেতরের তাগিদেই লিখবে। ভুল-ত্রুটি যা হয় শুধরে নেবে নিজের গরজেই। তাকে ঠেকানো যাবে না। নিন্দা করেও না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০০৭ সকাল ৯:২৫