রহস্য সাহিত্যের ক্যাপ্টেন- কাজী আনোয়ার হোসেন
আমাদের প্রিয় মাসুদ রানা এবং বাংলা রহস্যসাহিত্যের স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন একটি স্বপ্ন জাগানিয়া নাম। ছেলে-বুড়ো সবার কাছে পরিচিত কাজীদা নামে। সেই নামের সাথে মিশে আছে একটি সমৃদ্ধ গল্প। তার বহুমূখী প্রতিভা মিশে আছে একটি কেন্দ্রে। লেখালেখির পাশাপাশি একসময় আনোয়ার হোসেনের খ্যাতি ছিল গায়ক হিসেবে। রেডিও, টিভি, সিনেমা, এইচ-এম-ভি সবখানে গান গেয়েছেন বাংলার রহস্য-এডভ্যানচার-থ্রিলার জগতের এই ব্যক্তিত্ব।
কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই রবিবার খুব ভোরে ঢাকার সেগুনবাগিচায়। তার বাবা প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, দার্শিনক, সংস্কৃতিকসেবী ও দাবারু ড. কাজী মোতাহার হোসেন এবং মা সাজেদা খাতুন। তারা ছিলেন ৪ ভাই, ৭ বোন । কাজী মোতাহার হোসেন একজন মুক্তচিন্তা ও উদার মানষিকতার মানুষ ছিলেন। তিনি বুদ্ধির মুক্তি এবং বাংলার রেনেসা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুখের সমন্বয়ে কেটেছে তার শৈশবকাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পূর্ব সীমানায় উত্তর ও দক্ষিন কোণে যে দুটি দোতালা গেষ্ট হাউজ আজও দেখা যায়, সেখানেই উত্তরের দালানটিতে আনোয়ার হোসেনের ছেলেবেলা কেটেছে। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়ি বদল করে তারা দক্ষিন দিকের গেষ্ট হাউসে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কিছু অংশ দক্ষিন দিকে ছিল। ড. কাজী মোতাহার হোসেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। প্রায় বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সামনের মাঠে ভাই-বোনেরা সবাই মিলে গোল্লাছুট খেলতেন। কখনো কখনো তাদের সাথে যোগ দিতেন বাবা মোতাহার হোসেন। সেখানে একটি আমগাছ ছিল। সেখান থেকে শুরু হত দৌড় এবং প্রতিপরে স্পর্ষ এড়িয়ে যদি কেউ বাউন্ডারির দেয়াল ছুতে পারে, তবে সে-ই হবে বিজয়ী। সেই আমতলাটি বিখ্যাত হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় । আর বাউন্ডারির দেয়াল ঘেষে তৈরী হয়েছিল মধুর ক্যান্টিন। পরে অবশ্য তারা বাসা বদল করে সেগুনবাগিচায় নিজেদের বাসায় চলে আসেন।
ভীষন ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় তার সেজো বোন খোরশেদা খাতুন একটি খাতা দিয়েছিলেন ডায়েরি লিখার জন্য। কিন্তু শর্ত ছিল খাতাটি সেজোদিকে পড়তে দিতে হবে। যেমন কথা তেমনি কাজ। ডায়েরিটা তিনি বোনকে পড়তে দিতেন সত্যি, কিন্তু ডায়েরির পাতায় লিখাগুলো থাকতো সব বানোয়াট, রোমহর্ষক ঘটনা। যেগুলো পড়ে সেজোদি ভয় পেয়ে যেতেন। তবে তার লেখালেখির ব্যাপারে বোনের অনুপ্রেরণা ছিল প্রচুর।
কিশোর আনোয়ার হোসেনের একদমই ভালো লাগতো না স্কুলে যেতে। তার জন্য স্কুল ছিল একটা জেলখানা। আর নিজেকে তিনি মনে করতেন তার কয়েদি। প্রায়ই সকালে দু ভাই মিলে রওনা দিতেন স্কুলের উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথেই পল্টন ময়দানে শিমুল গাছের ছায়ায় বসে গল্পের বই পড়তেন। বিকেল হলে দু ভাই আবার একসঙ্গে বাসায় ফিরে আসতেন। মাঝে মধ্যে কোনো এক কাঠফাটা দুপুরে স্কুলের উচু পাচিলঘেরা প্রাঙ্গন দিয়ে উড়িয়ে দিতেন লাল-নীল-সবুজ রঙের কাটা ঘুড়ি। ঘুড়ির সাথে ভেসে যেত তার ছোট্ট উদাস বুকের চাপা দীর্ঘশ্বাস। নীল আকাশে মেঘের ভেলায় ঘুড়ির মত উড়তে না পারার দীর্ঘশ্বাস।
ছোটবেলা থেকেই কাজী আনোয়ার হোসেনকে রহস্য, রোমাঞ্চেকর কাহিনীগুলো আর্কষন করত। যখন যে গল্পের বই সামনে পেতেন, তা পড়তে ছাড়তেন না। তবে হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্তর বইগুলো ছিল তার ভীষন পছন্দের। বছর ষাট আগের কথা কলাকাতা থেকে প্রকাশিত রবিনহুড নামের একটি বই তাকে ভীষনভাবে নাড়া দিয়েছিল। বইটির কাহিনীতে মহানায়কের মৃত্যু হয়। এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি । সেই মহানায়কের শোকে সেদিন গড়াগড়ি করে কেদেছিলেন। একবার একটি পয়েন্ট টু টু রাইফেল কেনার জন্য টাকার দরকার হল। টাকা যোগাড় করার আশায় শুরু করলেন উপন্যাস লেখা। কিন্তু উপন্যাসের বদলে মন থেকে বের হয়ে এল রহস্যোপন্যাস কুয়াশা।
১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে কাজী আনোয়ার হোসেন এসএসসি পাশ করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ শেষ করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাশ করেন।
পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়মমাফিক কোনো ট্রেনিং না নিলেও বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিল। তার তিন বোন সানজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। ছোটবেলা থেকে আনোয়ার হোসেনের রক্তে ছিল গান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একবার বাংলাবিভাগ থেকে বনভোজনে গিয়েছিলেন জয়দেবপুরে। সেখানে চর্যাপদের হাজার বছরের পুরোনো একটি গান গেয়ে সবাইকে রিতীমত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ গানটি ছিল- মবংকার দিঢ় বাখোড় মোড়িউ/বিবিহ বিয়াপক বন্ধন তোড়িই। দূর্বোধ্য এই বাংলা গান শুনে সেদিন ছাত্র-শিক্ষক সবাই খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি প্রথম রেডিওতে গান করেন। সেখানে পরিচয় কন্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনের সাথে। পরিচয় থেকে প্রনয়। এবং ১৯৬২ সালে তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লে-ব্যাক কাজী আনোয়ার হোসেন ছেড়ে দেন ১৯৬৭ সালে। তবে এখনও মনের গভীরে কোনো সুর উকি দিলে সারাদিন তা গুন গুন করতে ছাড়েন না।
বাধা ধরা নিয়মের কখনোই তোয়াক্কা করেন নি কাজী আনোয়ার হোসেন। তাই মার্স্টাস পাশ করার পর তিনি নিজেই কিছুটা নিশ্চিত ছিলেন যে চাকরি করা তার পে সম্ভব না। বাবার কাছে টাকা চাইলেন ব্যবসা শুরু করার জন্য। প্রথমে তার সব প্ল্যান, উদ্দেশ্যের কথা শুনে বাবা কিছুটা আশ্চর্য হলেন, কিন্তু অমত করলেন না। ১৯৬৩ সালে মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করলেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কিনলেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকিটাকা দিয়ে টাইপপত্র। শুরু হল তার কর্মজীবন। সকাল ৯ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত প্রেসেই পরে থাকতে হতো তাকে। আর তার আগে ও পরে দু ঘন্টা করে চার ঘন্টা ব্যয় করতেন বই লেখায়। ব্যাপারটি যতটা সহজ মনে হচ্ছে আসলে ততটা সহজ কিন্তু না। প্রেসটি দাড় করাতে তাকে রিতীমত যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এরজন্য তাকে ভয়ানক খাটুনি খাটতে হয়েছে। প্রথমে তিনি অ-পাঠ্য একটি বই লিখতেন। তারপর হাতে কিছু টাকা জমলে সেটা প্রকাশ করতেন। এরকম করে ১৯৬৪ সালে জুন মাসে প্রকাশিত হল কুয়াশা-১ যার মাধ্যমে সেগুনবাগান প্রকাশনীর আত্মপ্রকাশ। তারপর ধীরে ধীরে কয়েকবছরের মধ্যে সেগুনের- সে, আর বাগানের- বা, মিলে হয়ে গেল সেবা প্রকাশনী। কুয়াশা প্রকাশিত হওয়ার পর মাহবুব নামের এক বন্ধু তার হাতে তুলে দিলেন ইয়ান ফেমিংয়ের ডক্টর নো বইটি। বইটি হাতে নিয়ে সেদিন তিনি বুঝতে পারলেন রহস্য-রোমাঞ্চ এডভ্যানচার কাহিনীতে বাঙালীরা অনেক পিছিয়ে আছে। ঠিক করলেন বাংলাতে ওই মানের থ্রিলার বই লিখবেন। বিদেশী বই পড়ার পাশাপাশি শুরু হল মোটরসাইকেল ভ্রমণ। তিনি চট্টগ্রাম, কাপ্তাই ও রাঙামাটি মোটরসাইকেলে করে ভ্রমন করলেন। এরপর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হল বাংলায় প্রথম মৌলিক স্পাই থ্রিলার মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ধ্বংস পাহাড়। বইটি প্রশংসিত ও সমলোচিত- দুটোই হয়েছে।তবে সিরিজের দ্বিতীয় বই ভারত নাট্যম প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই যেন একটু নড়ে চড়ে বসলেন। কারও যেন আর তড় সইছিল না। বই বের হতে একটু দেরি হলেই চিঠির পর চিঠি আসতে লাগলো প্রকাশনীতে। এরপর স্বর্নমৃগ, দুঃসাহসিক, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ছেলেবুড়ো সবাই পড়তে শুরু করে এই রহস্য-রোমাঞ্চকর কাহিনীগুলো। নিয়মিত প্রকাশনা নিশ্চিত করতে তিনি মাসুদ রানা সিরিজে বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে লিখতে শুরু করেন। এক পযার্য়ে সিন্ডিকেট করে বই লেখার কাজটি গড়ে উঠে সেবা প্রকাশনীতে। বিভিন্নজন মাসুদ রানা ও কুয়াশা লিখতে থাকেন। তবে প্রতিটি পান্ডুলিপি প্রেসে যাওয়ার আগে কাজী আনোয়ার হোসেন নিজ হাতে সম্পাদিত করে দেন।
মাঝে ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় রহস্য পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এবং পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে নভেম্বরে। চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থগিত রাখা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর ১৯৮৪ সালে রহস্য পত্রিকা আবার প্রকাশিত হয়। আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে।
কাজী আনোয়ার হোসেন এক মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা। তার মেয়ে শাহরীন সোনিয়া একজন কন্ঠশিল্পী। বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং ছোট ছেলে মায়মুর হোসেন লেখালেখির এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িত। তিনি শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে ১৯৭৪ সালে বাচসাস, সিনেমা পত্রিকা ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরুস্কার পেয়েছেন।
রহস্য-এডভ্যানচার-রোমান্স-থ্রিলার সাহিত্যের অন্যতম একটি স্বতন্ত্র ধারা। আর কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলা রহস্য সাহিত্যের একজন প্রবাদ পুরুষ। তিনি এদেশের শিশু-কিশোরদের হাতে রহস্যভিত্তিক কল্পকাহিনীগুলো তুলে দিয়েছেন। আজ তা বাংলাসাহিত্যে জনপ্রিয় অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। আর এই ধারাটি জনপ্রিয় করার জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কাজী আনোয়ার হোসেনের।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন