বৃষ্টি হচ্ছে? তাতে কী!
বলেই সে ঝুমবৃষ্টির মধ্যে নেমে গেলো। হন হন করে হেঁটে গেলো শ্মশানের দিকে। আমি তাকিয়ে আছি। আমি কি তাকে অনুসরণ করবো?
রাত সবে গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে। হয়তো দূরে কোথাও পেঁচা ডাকছে। বৃষ্টির শব্দে সে ডাক চাপা পড়ে গেছে। আমিও নামলাম বৃষ্টির মধ্যে। সে আমার বেশ খানিকটা সামনে হাঁটছে। পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না একবারও।
কই যাস?
আমি কেঁপে উঠলাম অচেনা শঙ্কায়। পেছন ফিরে দেখি এক পাগল। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ। নিঃশব্দে হাসছে। যেনো আমার চোখের ভিতর তাকিয়ে আছে।
আয় বাজান, আগুনডা নিভাইয়া দে।
কোথায় আগুন?
দেহচ না মোর সারা অঙ্গে আগুন জ্বলে। দ্যাখ, বুকের মইধ্যে দ্যাখ।
পাগলটা আমাকে জড়িয়ে ধরতে আসে; দুহাত বাড়িয়ে বলে, বিষ্টি হইলো কেরাসিন, যতো নামে-- আগুন বাড়ে। সে হাসে, হা হা হা...
বৃষ্টি আরো বাড়ে। আমি পাগলটার কাছ থেকে সরে আসি। কিন্তু সে কোথায়? তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আমি হাঁটতে থাকি, আমি হাঁটতে থাকি। তার জন্যে আমার বুকের ভিতর কেমন এক হাহাকার ঘনীভূত হয়। এতোক্ষণে মনে হচ্ছে পাগলটার কথাই ঠিক, বৃষ্টি হলো কেরোসিন। আমি হাঁটছি, আমি হাঁটছি...
তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো একটা আর্ট-গ্যালারিতে। একটা প্রদর্শনী হচ্ছিলো। আমারও একটা পেইন্টিং ছিলো প্রদর্শনীতে। শিরোনাম, ডান্স উইথ ডেথ। ছবিটার সামনে সে টানা কুড়িমিনিট দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কাছে গিয়ে বললাম, এনি থিং রঙ?
নাথিং এল্স। আপনিই আর্টিস্ট?
হ্যাঁ?
ছবিটা আমি কিনবো।
সরি। ওটা বিক্রির জন্যে নয়।
কিন্তু আমি ওটা চাই। এনি হাও।
কেনো? ওটা তো দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখার মতো নয়; যে কেউ ভয় পাবে দেখলে। এতাক্ষণে বুঝতে পারেন নি!
সে জন্যেই।
মানে!
আমি ওটা নষ্ট করবো। তার চোখে মুখে কেমন এক অস্থিরতা।
আমি অবাক হলাম, হোয়াট্স রঙ?
বললাম তো, নাথিং। বলুন, কতো দিতে হবে।
আমি তো বলেছি...
ওকে। সি য়্যু। বলেই সে বেরিয়ে গেলো। মিনিট দশেক পর যখন ফিরে এলোÑ তার হাতে একটা ক্ষুর। মুহূর্তেই আমার ক্যানভাসটা ফালি ফালি হয়ে গেলো। ডান্স উইথ ডেথ এর পরিণতিতে কেনো জানি আমার কোনো কষ্ট হলো না। আমার অবচেতন মন কি চাইছিলো ওটার এমন পরিণতি হোক?
ঠিক আটদিন পর। রাত নটা ষোলো মিনিটে সে আমার দরজায় এসে দাঁড়ালো।
আমি আপনার মডেল হবো।
আমিতো এখন আর সামনে মডেল নিয়ে ছবি আঁকি না।
তাতে কী! আঁকেন না তো, আঁকবেন।
ধৈর্যের দরকার।
সে হাসলো। এবার অন্যরকম হাসি। বুঝতে পারলাম না আমি। বললো, আপনার কী ধারণা, আমাকে দিয়ে হবে না?
না, তা নয়। তবে প্রতিদিন আসা-যাওয়া আপনার সমস্যা হতে পারে।
আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। এসেছি, কাজ শেষ করেই যাবো।
আমি আশ্চর্য হলাম না। সে ক্ষমতা বোধহয় অনেক আগেই হারিয়েছি। বললাম, কতোদিনের ব্যাপার ভেবেছেন?
একমাস সময় আছে আমার হাতে। একমাস মানে তিরিশদিন। জানেন তো?
আমি ঘরটা একটু গোছালাম। সে হাসলো, গোছাতে গিয়ে তো দেখি আরো অগোছালো করে ফেললেন।
আমি তার খোঁচাটা গায়ে মাখলাম না।
কেমন মডেল হতে চান?
সে তো আর্টিস্টের স্বাধীনতা...
না, আপনি যেমন চান।
তবে বতিচেল্লির যেমন মডেল... আপনি আঁকবেন ভেনাসের জন্ম।
জানলা দিয়ে হাওয়া আসছে। বেরিয়ে যাচ্ছে দরোজা দিয়ে। সে মেঝে থেকে যে সিডিটা তুলে নিলোÑ তা প্লেয়ারে চাপালে ঘরময় উস্তাদ আল্লারাখা তবলায় তুলবেন ঝাঁপতাল।
আমি ইজেলে ক্যানভাস সাঁটালামÑ পাঁচফিট বাই আট। এতোক্ষণে ঘরময় বেজে যাচ্ছে ঝাঁপতাল। বাতাস আর হাওয়া নাচছে পরস্পর।
সে বললো, এবার নাচবে ভেনাস।
ধীরে ধীরে আমার ভিতরকার কুয়াশাগুলি কেটে যাচ্ছে, আর মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা ফিরে আসছেÑ আমি নির্বাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, তাকিয়ে আছি...
তার নাচ যখন শেষ হলোÑ আমার চোখ মাছের চোখ। এই প্রথম আমি তাকে আবিস্কার করলাম নিরাভরণ এবং নিরাবরণ। আর সুন্দর।
আমি ক্যানভাসে প্রথম তুলির যে আঁচড়টা দিলাম তার রঙ...
প্রথমে আমি তার চোখ এঁকেছি। তারপর চুল... ওষ্ঠাধর, চিবুক, গ্রীবা, বুক...
কুড়িদিনের মাথায় শেষ আঁচড়টা দিয়েছি তুলির।
শিরোনাম, দ্য ডান্সিং ফায়ার।
সে শাদাশাড়িটা মেঝে থেকে তুলে দেহে জড়ালো। বললো, যাই।
এই রাতে!
রাতেই তো যেতে হয়। কথাটা কেমন জানি শোনালো।
বললাম, বৃষ্টি হচ্ছে।
সে আমার কথা শুনলো না।
সেই থেকে হাঁটছি আর হাঁটছি। তার দেখা নেই। শ্মশানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গোঙ্গানির শব্দ শুনলাম। দেখি, জনাকয়েক ডোম একজনের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। একটা শাদাশাড়ি লুটাচ্ছে কাদাজলে। আমি চমকে উঠলাম। এই তো সে! দেখলাম একজনের হাতে ঝলসে উঠছে ছুরি। আমার মুখ থেকে চিৎকার বের হলো নিজের অজান্তে। দুইজন বল্লম হাতে আমার দিকে তেড়ে এলো। ভয়ে আমি কেঁপে উঠলাম।
তাড়া খেয়ে আমি ছুটছি তো ছুটছি। কতোক্ষণ মনে নেই। ঘুরপথে ছুটছি। আমার পথ ফুরোচ্ছে না। আমার ঘর আর কতোদূর?
বৃষ্টি থেমে গেছে। রাত্রি নিভে গেছে। আমি ছুটছি। পেছনে কি এখনো পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি? পেছন ফিরে তাকালাম। না, কেউ নেই। মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালাম। একটা দীর্ঘশ্বাস শেষ হলে দেখলাম, আমার সমুখে ভোর। ভোরের আলোয় বুঝতে পারলাম আমার পথ শেষ। আর কয়েক পা এগোলেই আমার ঘর।
আমার ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ঘরের বাঁপাশে গাছগাছালির ভিড়ে বকুলের গাছ। বকুলতলায় কেউ।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। আর পুনর্বার চমকে উঠলাম। সে। তার পরনে শাদাশাড়ি। শাড়িতে কাদা কিংবা রক্ত কোনোটাই লেগে নেই। আমাকে দেখে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার আঁচলে জড়ানো বকুল। আমার চোখের ভিতর তাকালো সেÑ মুঠোভর্তি বকুল আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। নির্বাক আমি হাত বাড়ালাম। সে বললো, এর ঘ্রাণ নিতে হয় চোখ বুজে।
আমি চোখ বুজলাম।
চোখ খুললাম যখনÑ আমার সমুখে, আমার দশদিগন্তে কেউ নেই। মুঠো খুলে দেখি একটাও ফুল নেই।
মুঠোর ভিতর কেবল ঘ্রাণটা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১১ দুপুর ১২:৩১