আজ ছিল আমার ইচ্ছেবিকেলের দিন।ইদানিং কি জানি হয়েছে,খুব একটা কোন কিছু করতেই উৎসাহ পাইনা।ইচ্ছা করেনা অনেক কিছু করতে,চুপ মেরে বসে থাকতে ভাল লাগে।আর সেটা যদি নদীর কাছেধারে হয় তবে তো আরও শান্তি।
পানি জিনিসটা কেন জানি আমার প্রচন্ড রকম ভাল লাগে।আমি পানি দেখলে হৈ হৈ করে উঠি।আজ সে ইচ্ছাতেই চলে গিয়েছিলাম রুজভেল্ট আইল্যান্ড।খুঁজে পেতে একটা জায়গা পেলাম,যেখানে আশে পাশে মানুষজনের এত সোরগোল নেই।আমি চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম।ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস।আজ বেশ দূরে যেয়ে ফোন কার্ড কিনেছি,কিছু প্রিয় মানুষদের ফোন করব। কথা হয়না অনেকদিন। রিং হচ্ছে,রিং হচ্ছে-কেউ ফোন ধরলো না।সবাই ঘুম! দিনরাত্রির এই পার্থক্যটায় আমার ভারী কষ্ট হয়।কাউকেই তেমন সময়মত পাইনা।আবার ওরা যখন করতে পারে আমি তখন ঘুম কিংবা কাজ! বড্ড বিচ্ছিরি সময়ের জাল।কি আর করা।আরেকটু কাছে গেলাম পানির।রেলিং পেরিয়ে গেলেই আমি পানিতে।ভাল লাগছিল অনেক।একটা বসার জায়গা পেয়ে বসলাম,তাকিয়ে দেখছিলাম ছোট ছোট ব্যাপারগুলো, পানিতে ঢেউ, একটা হাঁসের গা ঝাড়া, দুরে একটা বয়স্ক লোকের সিগারেট খাওয়ার সময় মুখটা কুচকে যাওয়া,একটা যুগলের গল্প করতে করতে হেসে দেয়া।একটা ফুল পড়ে ছিল-সেটা মুখে চিবোতে থাকা চুইংগামটায় বসিয়ে দিলাম।টবের মত লাগছিল।গোলাপি চুইংগামের মাটিতে থাকা ফুলটা দেখতে খুব মজা লাগছিল।দমকা দমকা বাতাস হচ্ছিল।আরাম!!
কিছুক্ষণ পরে দৃষ্টি সরলো একটা পরীর উড়ে যাওয়ায়।একটা ছোটপরী দৌড় দিল আমার চোখের সামনে।উপরে সাদা আর নিচের দিকে হালকা গোলাপী রংএর পরীটাইপ ফুলানো একটা জামা পড়া সোনালী চুলের একটা মেয়ে। এত ছোট,এত সুন্দর!! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। ছোট বাচ্চাকাচ্চা দেখলে আমার মন ভাল হয়ে যায়,যত খারাপ ই থাকুক, আমি ওদের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দেই, ওরাও এত সুন্দর ভাবে সেটা ফিরিয়ে দেয়।এই বাচ্চাগুলোর কাছথেকে আমাদের বড়দের অনেক কিছু শেখার আছে।হয়ত ওদের এত মনে থাকেনা। কিন্তু যাকে ভালবাসে, বা যার কাছ থেকে কোন অনুভব পায়-সেটা এত চমৎকার ভাবে গ্রহণ করে।ওদের অত চিন্তা হয়না, অতকিছু ভাবেনা ওরা।যতটা না নেয়,তার চেয়ে অনেক বেশি ফেরত দেয়।বড়দের মত ওদের ভালবাসাটা এত ভেবে চিন্তে হয়না। ওরা যেন শুধু দেয়ার জন্য ভালবাসে,ভালবাসার জন্য বাসে।এত পবিত্র!!
আরেকটা ছোট বেবিসাইকেলে চড়া নীল রং এর গেন্জি প্যান্ট পরা আমেরিকান ছেলে আসল।এমন ভাবে চালাচ্ছিল যে মনে হচ্ছে দুনিয়ার সেরা বাইকটা ওর কাছে।বিকেল বেলায় বাবা হাঁটতে বের হয়েছে, সাথে তার ছোটভাই বুকের মাঝে ঐ বাচ্চাদের কোলে নেয়ার জিনিসটায় আটকানো।বাচ্চাটাকে দেখে খুব মজা লাগছিল, আমি যে দেখছি সেটা বুঝে একটু লুকায়,আবার লুকিয়ে দেখে আমি দেখছি নাকি।আবার তখন আমিও তাকিয়ে হেসে দেই। বেচারা লজ্জা পেয়ে যায়।তার বাবা তাকে একটা পাউরুটি দিল, সে সেটা খেতে বাইক থেকে নেমে একটা ইটের উচু জায়গায় উঠে গান গেতে গেতে খাচ্ছিল-
লা লা লা.
লা লা লালালা..লালললাললা...লাইলাইলাইলালা
লালা লালা লা লা লা...।
আমি বলতে পারছিনা ওর মত করে।এত চমৎকার লাগছিল।পরী-রাজপুত্র!
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি আসতে লাগল।হালকা হালকা! আমেরিকার বৃষ্টিটা কেমন যেন-মন খারাপ করা।সেই রকম ভাবে উচ্ছ্বাস নেই যেন তার।যেন তাকে কেউ নিয়ম করে বলেছে- এখন তোমাকে পড়তে হবে!! ব্যাস! সেও পড়ে!!
আমার মনে হয়-ঝরবেই যখন, সব ছেড়ে দিয়ে ঝরো! নিজেকে উজাড় করে ঝরে পড়ো!! এমন ভাবে ঝড়ো যেন তোমার স্পর্শে হয় কান্না পাবে,নয় হাসি! এভাবে কেন? ঘুম ঘুম বৃষ্টি আমার একদম ভাল লাগেনা। একদম না!!!
ছাতা খুললাম।আমার বেগুনি রং এর ছাতাটা ধরে হাঁটতে লাগলাম।বৃষ্টি যেন আমার ধমকটা আমার অভিমানটা বুঝে গিয়েছে। হঠাৎ করে সে দমকে উঠল। আমার ছাতাটা যেন প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে।আমি অনেকক্ষণ জোরাজুরি করে শেষমেষ ভাবলাম-কি দরকার! ছেড়ে দিলাম তাকে তার মত। ঠিক ছেড়ে দেয়া না, আমি উল্টে যাওয়া বেগুনি রংএর ছাতাটা ধরে সে যেদিকে যায় যেতে লাগলাম।
আমার তো এমনিতেও কোন গন্তব্য নাই। যায় না সে যেদিক যায়!
হঠাৎ করে আমার মন ভাল হয়ে গেল। আমি গান গাচ্ছিলাম....
ভালবাসি...ভালবাসি
এই সুরে কাছে দূরে জলে স্হলে বাজায়
বাজায় বাঁশি...
ভালবাসি!!
আমাকে আমার মত থাকতে দাও...
আমি নিজেকে নিজের মত গুটিয়ে নিয়েছি
যেটা ছিলনা ছিলনা সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন.....।
ঠিক সন্ধ্যা নামার মুখে
তোর নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে..
তোর গল্প বলিস কাকে.....
যদি ডেকে বলি..এসো হাত ধরো..চল ভিজি আজ বৃষ্টিতে
এসো গান গাই এই মেঘমল্লারে.....করুণাভরা দৃষ্টিতে
আমি চাইনে. আমি চাইনে তপন, চাইনে তারা..
আমার নিশিথ রাতের বাদলধারা........
এভাবে একগান থেকে এক গানে ভ্রমণ করে চলতে লাগল আমার আজকের ইচ্ছেবিকেল। আমি গাই, আমিই শ্রোতা......নিজেকে নিয়ে আজ বেশ ভালভাবে কাটালাম বিকেলটা। নিজেকে সময় দেয়া আসলেই খুব দরকার।মাঝেমধ্যে নিজের জন্য করা উচিত অনেক কিছু। শুধুই নিজের জন্য। কারণ এই আমিটা সবসময়ই এই আমার সাথে থাকব, সব কিছুর পরও এই আমি-টা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজেকে ছেড়ে যাই না। তাই অন্তত এই বিশ্বস্ততার জন্য কিছুটা ভালবাসা আর গুরত্ব পাওয়াটা বোধকরি তার একরকম অধিকার। নিজের জন্য বাঁচা ব্যাপারটা আজ খুব মনে হচ্ছিল আমার।ধন্যবাদ ইচ্ছেবিকেল, আর ধন্যবাদ সেই চোখ রাঙানোয় শুধরে যাওয়া মেঘ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৯:১৬