আমি যখন বেশ ছোট ছিলাম, তখনকার কথা বলছি। আমাকে প্রায় তিন বছরের দিকেই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল! আমি তো তখনও স্কুলের তেমন কিছু বুঝতামনা! ম্যাচের কাঠি দিয়ে আম্মুর কাছে গুণতে শিখতাম ! বাসায় আলমারীতে এ বি সি ডি-র একটা চার্ট টানানো ছিল। স্কুলটা ছিল বাসার কাছাকাছিই। তাই আমাকে ঐ স্কুলেই ভর্তি করায়ে দেয়া হল। মজাই লাগত স্কুলে যেতে! ক্লাসের সবচেয়ে ছোট পিচ্চি হওয়ার কারণে এক্সট্রা একটু আদর পেতাম ! আমাকে একদিন চাচী জিজ্ঞেস করল-কোথায় বসো তুমি?ক্লাসের কোন ব্যাঞ্চে?
আমি উত্তর করেছিলাম- আরে!আমি তো ব্যাঞ্চে বসিনা,আমি তো টিচারের কোলে বসি!!
ঐ সময়ের খুব বেশি কিছু মনে নাই, কিন্তু একটা দৃশ্য প্রায়ই মনে পড়ে।
ক্লাসে কোন একটা ছড়া পড়ানো হচ্ছিল, আর আমি দৌড়ে যেয়ে দরজার কাছে, মাঠের দিকে মুখ করে, হাত মুখ নাড়িয়ে নাড়িয়ে
আয় বৃষ্টি ঝেপে,
ধান দিব মেপে...........করে যাচ্ছিলাম!!
আর স্কুলে যাওয়ার সময় যে আমার কত ঢং! খালি চুল খুলতাম -"না হয়নাই-এভাবে না, ঐভাবে!" আমার সাতটা বারের ক্লিপ ছিল। রবিবার দিন পরে যেতাম-সানডে ক্লিপ, সোমবার মানডে-এরকম!
এখনও মাঝে মধ্যে যখন মনে পড়ে, বাচ্চাটাকে আদর করতে ইচ্ছা হয়! সমস্যা হল, নিজের ছোটবেলাটা বড়বেলায় দেখতে পারা যায়না যে কেন!!
আর কিছু হলেই আমি দরজার পিছন ফিরে বারি দিতাম!!আর আয়নার সামনে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদা!!আমার প্রথম বলা ইংরেজি-ওয়েলকাম-শুনে আব্বুর বাড়ি মাথায় করা-কত যে হাস্যকর কাজকারবার করতাম,ভাবলে এখন নিজের ই হাসি আসে।
আর ছোটবেলার পুতুল খেলা??
সেটা তো আরও এক বিরাট কাহিনী ! ছোটবেলায় আমার পুতুলগুলোকে একটা ট্রাংকে রাখতাম, রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ওদেরকে ঘুম ভাঙাতাম! পুতুলটার জন্মদিন মাসে তিন-চার বার করে হত।ছোট কেক-বারো টাকায় পাওয়া যেত, সেগুলো আনানো হত, সব বাচ্চা বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে মাসে বেশ কয়েকবার ঘটা করেই করা হত জন্মদিন! নিজেকে বেশ গার্জিয়ান লাগত!!এভাবে আস্তে আস্তে আমার মাথায় আসল, পুতুল বিয়ে দেয়া দরকার।পুতুলটা আমার বড় হয়ে গেছেনা?? বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে তো!
যেই কথা সেই কাজ। পাশের বাসার বন্ধু শানিলার একটা হোন্ডায় বসা হেলমেট দেয়া ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার কথা চলছে!
যথারীতি পাত্র দেখতে যাওয়া হল,আমি নিয়ে গেছি আমার এক খালাতো বোনকে।পাত্রের খালাশাশুড়ি হিসেবে ওও বেশ কিছু জিজ্ঞাসা করছিল।যা সাধারণত করা হ্য়
-পাত্র লেখাপড়া কতদূর করেছে?পাত্রর স্বভাব কেমন?পাত্র নামায ঠিকমত পড়ে কি না-এসব!!
এখন ভাবলে বেশ মজা লাগে।
যাইহোক! এত কিছুর পর বিয়ে ঠিক হল।মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে তত্বও আসল।যেমন-ছোট একটা চিরুনি,কাপড়ের ছেড়া টুকরা দিয়ে শাড়ি,ছোট বোতলে করে ব্যবহার করা শ্যাম্পু! আমিও বেশ ব্যস্ত! আমারও তো বেশ যোগাড় করতে হচ্ছে সব।যৌতুক দিবনা আগেই ঠিক করা ছিল।মিনা-র যৌতুক বন্ধ করো-দেখে ততদিনে যৌতুক কি ভালোই বুঝি!
অবশেষে আসল বিয়ের দিন। বাসার ড্রইংরুম পুরোই আমার দখলে।আমার সব খেলার বন্ধুরা মিলে রুমের একসাইডে বর পক্ষ আর আরেক দিকে আমরা-কনে পক্ষ! নিচতলার সৈকত বিয়ে পড়াবে বলে ঠিক হল।কিন্তু আমরা কেউই তো অত বেশি আরবী জানিনা তখন, শেষমেশ "আলহামদুলিল্লাহ-সুরা ফাতিহা"পড়েই কবুল বলে বিয়ে হয়ে গেল আমার পুতুলটার সাথে ঐ হোন্ডায় বসা-হেলমেট পরা পাত্রর!
আম্মু বিরিয়ানী রান্না করেছিল,সবাই বিয়েবাড়ির মত করে খাওয়াদাওয়া করলাম।গিফটও এনেছিল কেউ কেউ।আমি তো তখন আবার শাশুড়ি হয়ে গেছি!! কত দায়িত্ব।পুতুলটাকে আমার নিয়ে গেল আমার বন্ধুটা।ফেরাযাত্রায় অবশ্য এসেছিল দুজনেই।
আরে!শুধু কি আমি পুতুল-ই খেলেছি?আমি খুবই মনোযোগের সাথে ক্রিকেট খেলতাম! আমাদের বাসা vs পাশের বাসা টুর্নামেন্ট খেলতাম।ফুলদানীর নিচের অংশকে ট্রফি বানিয়ে আর পুরষ্কার স্বরূপ সবার থেকে ২টাকা করে প্রাইজমানি দেয়া হত ! কি সব টান টান উত্তেজনাপূর্ণ খেলা! প্রতিদিন বিকাল বেলা দৌড় বাসার নিচে আমাদের গলি-রাস্তায়।রাস্তাটাকে স্টেডিয়ামের চেয়ে কম সুন্দর লাগত না।আবার আমরা আলোচনা অনুষ্টানও করতাম।১৬ডিসেম্বর,২৬মার্চ,শবে বরাত-সিড়ি ঘরে বসত আমাদের বাচ্চাপার্টির আলোচনা।আর যে যা বলতাম,সবাই মিলে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে মতামত দেয়া ! পিকনিক করতাম প্রায়ই।বাসার ছাদে,আমাদের বাসা, পাশের বাসার পিচ্চিরা মিলে চাদর বিছিয়ে-সবার বাসা থেকে দেয়া সব কিছু নিয়ে বানানো হত-খিচুড়ি! একবার এমন গলে গেল, তাও আমাদের কাছে সেটা অমৃত লাগছিল!
আরও অনেক কিছু খেলতাম মাংসচোর, বরফপানি, বউছি, ছোয়াছোয়ি, কানামাছি, মনোপলি-সবই খেলেছি! আর আরেকটা নিজের বানানো খেলা ছিল-নাটক নাটক! আমি আর আমার খালাতো বোন খেলতাম এটা বেশি।নিজেরাই ছেলে, নিজেরাই মেয়ে হয়ে-ছেলে হলে আকাশ,মেয়ে হলে-গোলাপ নাম দিয়ে কি যে নাটক নাটক খেলতাম!! শাড়ি পরে মুরব্বিগিরি তো বোনাস!! ভাবলে এখন হাসি আসে অনেক।
কত কি যে করতাম ছোটবেলায়। বেশ ঘটনাবহুল পিচ্চি ছিলাম এখন মনে হয়।আব্বুআম্মুরা যে কত কি প্রশ্রয় দিয়ে গেছে-এখন বুঝি।শহুরে কোলাহলেও এত চমৎকার একটা শৈশবটার জন্য এখনও মাঝেমধ্যে মনে পড়লে আপনমনেই হাসতে থাকি।
উৎসর্গ: এই লেখাটা আর ছোটবেলার প্রিয় গানগুলো -
আমাদের দুষ্টের রাজা-আরদি
আমাদের পাকনিবুড়ি-ফারহিন
ছোটবাবু-বেন১০ রাজকুমার
রিমঝিম-রাজকন্যা
সোহামণিসোনাটা,প্রিয় আর তার ভাইরা,স্বচ্ছবাবাটা,আনিকা,আয়না,আমার তিনকন্যা-কে উৎসর্গকৃত।
ছোটবেলার কিছু প্রিয় গান
ছেলেবেলার গল্পশোনার দিনগুলো
ধিতাং ধিতাং
ধিতাং আরেকটা
ভোম্বল দাস
হাট্টিম টাট্টিম
ও নদীরে
লাল নীল সবুজের মেলা
আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
একদিন ছুটি হবে
হারজিত চিরদিন থাকবে
তাঁতের বাড়ি ব্যাঙের বাসা
বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে
এক যে ছিল রাজা
নাচো তো দেখি ..আমার পুতুল সোনা!!
ও মাগো মা..
মোমের পু্তুল
আজ ধানের ক্ষেতে.
মেঘের কোলে রোদ..
আমরা সবাই রাজা
নাতিখাতি বেলা গেল
সাত ভাই চম্পা
ও সোনা ব্যাঙ
আয় ছুটে আয়,পূজোর গন্ধ এসেছে
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ
প্রতিমা ব্যানার্জীর কন্ঠে-বাঁশ বাগানের মাথার উপর
ডাউনলোড লিংক
মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে