(১)
স্কুল জীবনে পাঠ্যবইতে কম করে হলেও ডজন বিশেক নীতিবাক্য শেখানো হয়। সুদীর্ঘ তিরিশোর্ধ জীবনে তার কোনটাই কাজে লাগাতে না পারলেও সবগুলোই কম বেশি চেষ্টা করে গেছি, এবং এখনও চেষ্টা জারি আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছেঃ স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সকল নীতিবাক্যের মধ্যে এটাই বোধহয় আমাদের সকলের অলটাইম বেস্ট অবহেলিত বিষয়। তার অবশ্য যথার্থ কারণও আছে। হাজারটা না-পাওয়ার হতাশার মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে অনেকটা স্যান্ডোগেঞ্জির সাথে সানগ্লাস পরে বসে থাকার মত। মাঝে মধ্যে মনে হয় মানুষজন এইসব নীতিবাক্যগুলো পেল কোথায়? আমার জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত তো কোন নতুন নীতিবাক্য সৃষ্টি হতে দেখলাম না। হয়ত নীতির কোন প্রয়োগ নাই দেখেই নীতিবাক্যের সৃষ্টি হওয়া দিনে দিনে বন্ধ হয়ে গেছে।
বন্ধু-বান্ধব সামলাও, পড়া সামলাও, পেট সামলাও, নেট সামলাও – এত কিছু সামমানোর পর স্বাস্থ্য সামলানোর আসলে উপায় থাকেনা। তারপরও জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে একবার করে স্বাস্থ্য সচেতনতার ঝোঁক ওঠে। প্রথম একবার উঠল ঠিক এসএসসি পরীক্ষার পর পর। পরীক্ষা শেষ, পড়ালেখা নাই, ষোল বছরের টিন এজার মানুষ। ভাবলাম এবার থেকে ব্যায়াম-ট্যায়াম করে পুরোদস্তুর ফিট হয়ে তবেই কলেজে ঢুকব। ঢাকা কলেজে পড়ার খুব শখ। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজের ছাত্রদের জন্য আবার ফিটনেস খুবই অত্যাবশ্যক বিষয়। বলা নাই, কওয়া নাই, যে কোন সময়ে ক্যাম্পাসে গোলা-গুলি শুরু হয়ে যাওয়া হচ্ছে তখনকার নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা। এখনকার মত তখন ফেসবুকে দু-চারটা স্ট্যাটাস দিয়ে ভাব নেয়া যেতনা যে দেশ-জনতা নিয়ে আমি অতীব সচেতন। কিছু বলতে চাইলে ক্যাম্পাসে আসতে হত, মিছিল করতে হত, রাবার-বুলেট আর টিয়ার গ্যাসের জন্য প্রস্তুত থাকতে হত। আমার মত নির্ঝঞ্ঝাট ছাত্রদের জন্য গোলাগুলি শুরুর পর কলেজ থেকে জান বাঁচিয়ে, এক দৌড়ে, রূদ্ধ-শ্বাসে, পুলিশের টিয়ার-শেল আর রাবার বুলেটের সাথে রেস দিয়ে, মিনিটের মধ্যে এলিফ্যান্টরোড পেরিয়ে যেতে পারাটা কলেজে পড়ার জন্য ছিল ন্যূনতম যোগ্যতা। মনস্থির করলাম নিজেকে প্রস্তুত করতে প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় নিয়মিত মর্নিংওয়াক শুরু করব। প্রথম কিছুদিন হাঁটাহাঁটি, তারপর দৌড় প্রাকটিস করা হবে, এসবের পর সুযোগ থাকলে টিয়ার-গ্যাস ট্রাই করা হবে।
মর্নিংওয়াকের বিষয়টা বাসায় জানানোর পর দেখা গেল সবাই ব্যাপারটা সহজভাবে নিয়েছে। আমি কোনদিনও ভোরবেলা ঘুম ছেড়ে উঠতে পারবোনা এ ব্যাপারে নিশ্চিত দেখেই বোধহয় বিষয়টিতে কেউ আমল দেয়নি বলে মনে হলো। শুধু আব্বা বলল, ‘আমি ফজরের পর রমনায় যাই। যেতে চাইলে আগেই রেডি থাকতে হবে।‘ আমার বাবা ডায়াবেটিকের রোগী হওয়ায় প্রতিদিন রমনায় হাঁটতে যেত। আমিও তার সাথে যাওয়া শুরু করলাম। নিয়মিত যেতে যেতে আবিষ্কার করলাম, যারা প্রতিদিন রমনায় যায় তাদের মধ্যে মোটামুটি একটা কমিউনিটি কমিউনিটি ভাব হয়ে যায়। দেখা গেল হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পর পর পরিচিত কারো সাথে দেখা হচ্ছে আর আমার বাবা - ‘কী খবর’, ‘কেমন আছেন’ করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে দু-একজন আবার ভ্রু-কুঁচকে আমার দিকে তাকালে আব্বা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন – ‘এ হচ্ছে আমার ছোট ছেলে, মাত্র এসএসসি দিল, এখন কলেজে ঢোকার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে।’ এদেরই মধ্যে এক ভদ্রলোক আমাকে দেখে মন্তব্য করলেন, ‘ছেলের স্বাস্থ্য তো খুবই খারাপ। ঢ্যাপসা বডি। ভেতরে কোন স্ট্রেংথ নাই। হাই পাওয়ার চশমা - চোখেও কিছু দেখেনা। একে আমার কাছে রেখে যাবেন প্রতিদিন এক ঘন্টা। সব ঠিক করে দেব।’ আব্বাকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল, ‘এই লোক হচ্ছে ব্রিটিশ পিরিওড (কিংবা পাকিস্তান পিরিওডের) গোল্ড মেডেল পাওয়া ব্যায়ামের ইন্সট্রাকট্রর। রমনায় একে সবাই ‘ওস্তাদ’ নামে চেনে।’
ফ্রী-তে একজন আমার ঢ্যাপসা বডি, ঝাপসা চোখ সব ঠিক করে দেবে – তাই ভেবে ওস্তাদের কাছে যাওয়া শুরু করলাম। প্রথমদিন ওস্তাদকে দেখে চক্ষু চড়কগাছ। রমনার মাঝে একটা নির্জন জায়গায় আস্তানার মত বানিয়ে সে শীর্ষাসন করছে – অর্থাৎ মাথার উপর ভর দিয়ে, পা উঁচু করে উল্টো হয়ে আছে। দীর্ঘক্ষণ এভাবে থাকার ফলে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। আমাকে দেখে সে সোজা হলো। তারপর স্বাস্থ্য নিয়ে ছোট একটা ইন্ট্রোডাক্টরি লেকচার দিল - ‘এ্যান আউন্স অফ হেলথ ইজ বেটার দ্যান এ টন অফ গোল্ড, বুঝলে ইয়াংম্যান? আর হেলথ ভালো রাখতে হলে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। তুমি তো চোখেটোখে দেখনা, তোমার জন্য শীর্ষাসন হচ্ছে পারফেক্ট ব্যায়াম। শরীরের সব রক্ত মাথায় সারকুলেট করবে আর দেখবে এভাবে এক মাস প্রতিদিন আধাঘন্টা করলে আর চশমাই লাগবে না।’ আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবিষ্কার করলাম ওস্তাদ আমার পা-দুটো ধরে এক হ্যাঁচকা টান মেরে আমাকে উল্টো করে ফেলেছে। আমার দু-হাতের কনুই আর একটা মাথা – এই তিনটে খুঁটির ওপর পুরো শরীর দাঁড়ানো। অনেকটা ক্যামেরার ট্রাইপডের মত টেকনিক। ভদ্রলোক আমার পা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলে আমি ঐ অবস্থায় বড় জোর সেকেন্ড পাঁচেক থাকতে পারলাম। এরপর ধাস করে চিৎপটাং হয়ে পরে গেলাম। প্রচন্ড ব্যাথায় আমি যখন কাতর, ওস্তাদ বলতে লাগলেন, ‘আরো প্রাকটিস লাগবে। বাড়িতে গিয়ে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে প্রাকটিস করবে। আর মনে রাখবে, এ্যান আউন্স অফ হেলথ ইজ বেটার দ্যান এ টন অফ গোল্ড।’
এরপর আরো কিছুদিন রমনায় গেলেও ওস্তাদের ডেরার দিকে ভুলেও পা বাড়াইনি। একসময় এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো, কলেজে ঢুকে ব্যস্ততা বেড়ে গেল, রমনায় যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। অনেকদিন পর একবার আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওস্তাদ কেমন আছে? দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাকি?’ আব্বা জানাল, ‘ওস্তাদ মারা গেছে। রমনাতেই তার আস্তানায় একদিন তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে ঠিক কিভাবে মারা গেছে কেউ জানেনা।’ আমার অবশ্য ধারণা করে নিতে কোন অসুবিধা হলনা। ওস্তাদের ভীতিকর প্রস্থানই হোক আর কলেজের পড়ালেখার চাপেই হোক, স্বাস্থ্যখাতে সময়ের বরাদ্দ আবারও শূন্যের কোঠায় চলে গেল। কলেজের পর বুয়েট কোচিং, বুয়েটে চান্স পাবার পর টিউশনি আর বুয়েট জীবনের ঘানিটানাটানির দিনগুলোতে সেই বরাদ্দ আর একটুও বাড়েনি। কিন্তু বলিউডের বডিগার্ড মুভিতে ক্যাটরিনার স্পেশাল অ্যাপিয়ারেন্সের মত আমার জীবনেও স্বাস্থ্য সচেতনতার রি-আপেয়ারেন্স ঘটল যেদিন থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমালাম।
(২)
আমেরিকায় আসার পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এখানে সবাই সারাদিন মর্নিং ওয়াক করে। যে কোন সময় রাস্তায় বেরোলেই মিনিট-প্রতি দু-তিনজনকে দেখা যাবে ফুটপাত দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। বাংলাদেশে যেমন শুধু চল্লিশোর্ধ ডায়াবেটিক রোগিদেরকেই বারডেম থেকে সার্টিফিকেট পাওয়ার পর দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়, এখানে ব্যাপারটা সেরকম না। যারা দৌড়াচ্ছে তাদের বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট – বয়স বিশও পেরোয়নি। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়, ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। দিনে দিনে বুঝতে পারলাম, ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র-ছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক ফিটনেসকে কর্তৃপক্ষ খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে। ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার্থে ক্যাম্পাস জুড়ে বিশাল বিশাল জিমনেশিয়াম, সুইমিংপুল, ফুটবল, টেনিস, সকার, রাগবি, বেসবলের কোর্ট বানিয়ে রেখেছে। ফলাফলঃ ২০১২ সালের অলিম্পিক গেমসে ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া আমেরিকার হয়ে সর্বমোট তিনটি গোল্ড মেডেল জেতে। আমার ডিপার্টমেন্টের কাছের যে জিমনেশিয়ামের বিশাল সুইমিংপুলে আমি কখনও নামার সাহস পাইনি, সেখানে প্রাকটিস করেই লরেন পার্ডু ও ম্যাট ম্যাকলিনরা ৮০০ মিটার ফ্রী-স্টাইল রিলেতে অলিম্পিক গোল্ড জেতে। আমার বাড়ির কাছে যে সকার মাঠের মাইকের আওয়াজে প্রতি শনিবার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, সেখানে প্রাকটিস করেই বেকি সাওয়ারবার্ণ মেয়েদের সকার টিমের হয়ে অলিম্পিক গোল্ড নিয়ে আসে। আমেরিকান ফুটবল নামে এদেশে একটা খেলা প্রচলিত আছে যেটাতে একটা নারকেল সাইজের বল নিয়ে মারামারি করতে হয়। জাতীয় পর্যায়ে এই খেলার বিশাল কদর এবং এটা একটা বিলিওন ডলারের বিজনেসও বটে। এই খেলার সমস্ত খেলোয়ার আসে ইউনিভার্সিটিগুলো থেকেই। আন্ডারগ্র্যাড-পড়ুয়া কিছু স্টুডেন্টের স্বপ্নই থাকে পাশ করে একদিন আমেরিকার জাতীয় পর্যায়ে খেলার। এই স্বপ্ন বাংলাদেশের কোন ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী দেখেনা। শুধুমাত্র কিছু অছাত্রের মাঝে জাতীয় পর্যায়ে দল বা লীগের হয়ে রাজনীতির মঞ্চে জনগনের জান-মাল নিয়ে খেলার বাসনা দেখা যায় মাত্র।
(৩)
শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও আমেরিকানরা অতিশয় সচেতন। টিভি অন করলেই দেখা যাবে এই টাইপ অ্যাড দেখাচ্ছে – ‘আপনার কী মন খারাপ? ইদানিং কথা কম বলেন? দিন-দুনিয়া অসহ্য লাগছে? - তবে এই নিন আমাদের ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত মহৌষধ। ১০০ জন ডাক্তার বলেছে এই অসুধে কাজ হতে বাধ্য। এখনই ফোন তুলে নিন এবং অর্ডার করুন। বিশেষ কারণে আজকে এক বোতলের সাথে আরেক বোতল ফ্রী দেয়া হচ্ছে। আর যদি আগামী দশ মিনিটের মধ্যে ফোন করেন তবে অফার ডাবল - এক বোতলের দামে চার বোতল ফ্রী!’ এই জিনিস আমাদের কাছে হাস্যকর লাগলেও আমেরিকায় বিষণ্নতা একটা মহামারীর মত। আমার ধারণা আপাত-আনন্দময় অথচ অন্তঃসারশূন্য লাইফস্টাইলের কারণেই আমেরিকার এই অবস্থা। এদেশের কনসেপ্ট হচ্ছে ‘ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজম’ – অর্থ্যাৎ বয়স ১৮ হয়ে গেলে যার যার নিজের রাস্তা মাপো। বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ অপশনাল ব্যাপার। প্রচুর মানুষ শুধু ক্যারিয়ারের কথা ভেবে একা একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টেই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী, বাচ্চা-কাচ্চা সবাই যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। হয়ত কারো সাথে কারো দিনের পর দিন দেখাই নেই। একাকী থাকতে থাকতে যদি কখনও খুবই অসহায় লাগে, তবে তার জন্যও বানিজ্যিক চিকিৎসা আছে। একে বলা হয় - কাউন্সেলিং। আপনি একটা বিশেষ নাম্বারে ফোন দেবেন, আর একজন পাগলের ডাক্তারের সাথে কথা বলবেন। এই ব্যবসায় পসার ভালো বলে আজকাল অনেক সাধারণ মানুষ, যার কোনই ডাক্তারি-বিদ্যা নেই, এই কাজ ধরছে। আমি এদের নাম দিয়েছি ‘আমেরিকান পীর’। আমেরিকান পীর-বাবা আপনার সাথে কথা বলবেন আর জীবনের প্রতি আপনি নতুনভাবে উদ্যমী হয়ে উঠবেন। যত বেশি কথা, তত বেশি উদ্যম। কথা শেষে আপনাকে মিনিট-প্রতি একটা নির্দিষ্ট হারে টাকা দিতে হবে। এই পীর ব্যবসা চলছে, চলবে, এবং আমেরিকানদের দেখাদেখি হয়ত অচিরেই এই পীর ব্যবস্থা বাংলাদেশেও চালু হবে। টিভিতে তখন কিছুক্ষণ পর পর অ্যাড দেয়া হবে – ‘আপনার যে কোন মানসিক সমস্যার সমাধান এখন বাংলালিঙ্ক দামে।’ আমি অবশ্য বাংলালিঙ্কের চেয়েও কম দামে সমধান দিতে পারি। ক্লাসটেস্ট হোক, চাকরি হোক, আর আশরাফুলের ব্যাটিং-ই হোক, যে কোন বিষয়ে হতাশায় যদি নিজের বাবা কিংবা মা’র সাথে ১ লাইন কথাও কেউ বলে, তবে তার কোনদিন পীরের দরকার পড়বেনা। যার বাবা-মা নাই, সে কথা বলবে সরাসরি আল্লাহর সাথে। এই চিকিৎসা ২০০৮ সালে আমেরিকায় আসার পর থেকেই নিয়ে আসছি। আমার ক্ষেত্রে কাজ করেছে, সবার ক্ষেত্রেই করবে। যারা টার্মফাইনালে ফেলের চিন্তা করছে তাদের জন্যও করবে, যারা এ-প্লাস মিস হবে ভাবছে তাদের জন্যও করবে।
(৪)
স্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি যে জিনিস জড়িত তা হচ্ছে - খাদ্যাভাস। আমরা বাঙ্গালিরা যত আয়েস-আয়োজন করে খাই, এতটা কোন জাতি করেনা। আমেরিকায় আসার পর এজন্য প্রথম প্রথম পড়লাম বিপাকে। নিজে রান্না জানিনা, আবার দোকান-পাটে যা পাওয়া যায় সেগুলোও মুখে দেয়া যায়না। ভৌগলিক অবস্থানের মত আমেরিকান রান্নার রেসিপিও হচ্ছে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ ১৮০ ডিগ্রি উলটো। আমরা রান্নার শুরুতেই দশ-রকম মশলা মাখিয়ে তারপর জিনিসটাকে সেদ্ধ করি। আর আমেরিকানরা প্রথমে জিনিসটা সেদ্ধ করে, তারপর খাওয়ার সময় সসে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায়। এই দুয়ের মাঝে কোনটা আসলে কতটুকু স্বাস্থ্যকর এটা নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু করে দিলাম। খাবার নিয়ে গবেষণা এদেশে সহজ। দোকানে গিয়ে যাই কিনি না কেন তার গায়েই বড় বড় করে লেখা থাকে এই খাবারে কতটুকু ক্যালরি, কতটুকু ফ্যাট, কতটুকু কার্বোহাইড্রেট ইত্যাদি ইত্যাদি। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও খাবারের মেন্যুতে দামের পাশাপাশি লেখা থাকে এই আইটেমে কতটুকু ক্যালরি/ফ্যাট। শুধু তাই নয়, যে খাবার যত বেশি স্বাস্থ্যকর, সেটার দামও তত বেশি। যেমনঃ সবুজ শাক-সব্জি কিংবা ফলমূলের দাম, ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গারের দামের চেয়ে বেশি। শাক-সব্জি আবার আছে দুই রকমঃ যেটাতে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছে সেটার দাম কম, আর যেটাতে করা হয়নি (সেটাকে বলে ‘অর্গানিক’) তার দাম প্রায় চারগুণ বেশি।
অনেক গবেষণা করে আবিষ্কার করলাম, আমি যা খাই তা খেতে থাকলে অচিরেই মারা পড়ব। ‘ভাত’ – দুবেলা যে খাবারের জন্যই জীবনে এতটা কষ্ট করছি, পড়াশোনা করে দেখলাম এটা হচ্ছে সর্বরোগের মূল কারণ। ডিসিশন নিলাম, ভাত সহ যাবতীয় সকল সাদা রঙের খাদ্য পুরোপুরি বন্ধ। এই লিস্টের মধ্যে ভাত ছাড়াও পড়লঃ পাউরুটি, নুডলস, পাসতা, চিনি, চিজ, মাখন, চিপস, কেক-সহ আরো ডজন খানেক খাবার। এর বদলে খাবার তালিকায় যুক্ত হলো প্রচুর পরিমাণে শাক-সব্জি, লতা-পাতা ও ফল-মূল। কফির বদলে এলো ইস্পাহানি চা, কোকের বদলে অরেঞ্জ জুস। বাকি যা ছিল, যেমনঃ মাংস, মাছ, যে পরিমাণে ছিল তাই থাকলো। এভাবে বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন বাবা-মায়ের সাথে ইন্টারনেটে কথা বলতে বলতে বলে ফেললাম আমার মহৎ প্ল্যানের কথা। ব্যস, সাথে সাথেই ঢাকায় কান্না-কাটির রোল পড়ে গেল। একসময় আমার মা দাবী করে বসল, আমি টাকা পয়সার কষ্টে আছি, তাই ভাত না খেয়ে টাকা বাঁচাচ্ছি। দরকার পড়লে দেশ থেকে টাকা পাঠানো হবে, তাও ভাত খাওয়া শুরু করতে হবে। ক্যামেরার সামনে বসে তাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে ভাত খেতে হবে। প্রায় এক মাস ধরে চলমান উন্নত খাদ্যাভাসের এভাবেই অপমৃত্যু ঘটল। শিক্ষা হলো যে, বাবা-মায়ের সাথে প্রতিদিন ১ লাইন কথা বলা খুবই ভালো, কিন্তু কথাটা বুঝে-শুনে বলতে হবে।
যে মুহুর্তে এই লেখাটা লিখছি, সেই মুহুর্তে আরেকটি নতুন মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এবার সব ধরনের খাবার-দাবার বন্ধ করে দিয়ে চার-বেলা শুধু ভেজিটেবিল আর ফলের জুস খাব। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে একটা ডকুমেন্টারি থেকে এই আইডিয়াটা মাথায় এসেছে। এক অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক টানা দু-মাস শুধু ভেজিটেবিল আর ফলের জুস খেয়ে কাটায়। ডকুমেন্টারিতে ভদ্রলোকের প্রতিটি দিনের ভিডিও রেকর্ড আছে। তার স্বাস্থ্যের শুধু যে উন্নতিই হয়েছে তা নয়, তাকে দেখতেও অনেক ভালো দেখাচ্ছে আর তার চিন্তা-বুদ্ধিও নাকি বহুগুণে বেড়ে গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় ৩৫ ডলার দিয়ে ওয়ালমার্ট থেকে একটা জুস করার মেশিন ও অনেকগুলো ফলমূল, শাক-সব্জি কিনে এনেছি। আজকে মেশিন দিয়ে দুটো আপেল, তিনটে গাজর, আর ছোট সাইজের দশটা বীট জুস করে খেয়েছি। খেতে তাজা বিষ্ঠার মত হলেও এখন থেকে এই ভাবেই চলবে। কেননা, ‘এ্যান আউন্স অফ হেলথ ইজ বেটার দ্যান এ টন অফ গোল্ড।’