আমার ডেক্স থেকে ২২৬ নম্বর রুম হচ্ছে ঠিক ২২ দশমিক ৬ সেকেন্ডের হাঁটা পথ। এইটুকু সময়ের মধ্যে মনে মনে শেষ মুহুর্তের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে নিলাম। কোন কিছু না পারলে বোর্ডে প্রশ্নটা লিখে ছবি-টবি এঁকে ভাব দেখাতে হবে আমি ব্যাপারটা জানি কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা। ভিনদেশি ছাত্র বলে ভাষায় সমস্যা হচ্ছে কিন্তু কনসেপ্টে আমার কোন সমস্যা নেই। খুব কঠিন টেকনিক, কিন্তু এটা ছাড়া আজকে আর উপায় নেই। ঠিক সাড়ে চারটায় ২২৬ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজায় কী স্ট্যাইলে টোকা দেব সেটা নিয়ে কনফিউজড থাকা অবস্থায় এক মহিলার গলার আওয়াজ পেলামঃ 'ইউ ক্যান কাম ইন'। মহিলা আর কেউ নয়, ডিপার্টমেন্ট হেড প্রফেসর ম্যারি লু সোফা।
ভাইভা রুমটাকে বেশ ছোট বলা চলে। চাপাচাপি করে বিশজন বসতে পারবে এমন একটা লম্বা কনফারেন্স টেবিল পুরো রুমটার সিংহভাগ জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেই টেবিলের দু-পাশে দুজন দুজন করে চারজন প্রফেসর কাগজ কলম নিয়ে বসে আছে। পাঁচজনের জায়গায় চারজনকে দেখে প্রথমে একটু খুশি হলাম। ভাবলাম এক্ষুণি জানতে পারব যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রফেসর অমুক আজকে আসতে না পারায় তোমাকে একটি বিষয়ে কোন প্রশ্ন না করেই বেনিফিট অফ ডাউটের ভিত্তিতে পাস করিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারি ব্যাপারটি তা নয়। আমি হোয়াইট বোর্ডকে পেছনে আর ভাইভা বোর্ডকে সামনে রেখে কনফিডেন্ট একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছেনা। সবাই চুপ, নিস্তব্ধ একটা পরিবেশ। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম যে রুমে পিনড্রপ সাইলেন্স বিরাজ করছে নাকি আমার আবার কানে শোনা বন্ধ হয়ে গেছে ভাইভার টেনশনে? এমনই সময় প্রফেসর অ্যান্ড্রু গ্রিমশ নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বলতে লাগলেনঃ 'শাহরিয়ার নির্জন, ভাইভা বোর্ডের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে স্বাগত জানাই। আপনি বোর্ডের সদস্যদের সাথে পূর্ব পরিচিত থাকলেও আমি সৌজন্যের খাতিরে সবার সাথে আবারো পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। আপনার বামপাশে রয়েছেন প্রফেসর ম্যারি লু সোফা ও প্রফেসর সুধানভা গুরুমূর্তি আর ডানপাশে রয়েছেন প্রফেসর ওয়েসলি উইমার ও আমি অ্যান্ড্রু গ্রিমশ। আমরা চারজন পালাক্রমে দশমিনিট করে আপনাকে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ ও কম্পাইলার, আর্কিটেকচার, থিওরি এবং অপারেটিং সিস্টেমস নিয়ে প্রশ্ন করব। প্রফেসর উইমার এক্সট্রা দশমিনিট অ্যালগোরিদম নিয়ে প্রশ্ন করবেন। আপনি একটুও দুশ্চিন্তা করবেন না, আমরা সবাই চাই আপনি কোয়ালিফায়ার এক্সামে সাফল্যমণ্ডিত ভাবে পাশ করুন। আপনি আমাদের সবাইকে পুরোটা সময় যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকায় পাবেন বলে আমি আশা করি।' তার লেকচার শেষ হলে বোর্ডের সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলাম। কারো চেহারাতেই সহায়ক ভূমিকার কোন লক্ষণ অবশ্য দেখতে পেলাম না।
প্রথম প্রশ্নটা আসলো প্রফেসর ম্যারি-লু-সোফার কাছ থেকে। এই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আমার নিজের আইডিয়া খুবই কনফিউজিং। একেক সময় একে একেক রকম মনে হয়। অবশ্য এটা বোধহয় পৃথিবীর সকল নারীর ক্ষেত্রেই প্রজয্যো। যেমনঃ তার সেমিনার টক গুলো খুবই সুন্দর হয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে বিকারহীন চেহারায় সুন্দর করে জোকস ঢুকিয়ে দেন। তার উপদেশ গুলোও খুব সুন্দর হয়। এসব ক্ষেত্রে তাকে বেশ ভালো মনে হয়। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে এবং সেটা তার পছন্দ না হলে এমন ঝারি দিয়ে উত্তর দেন যে তাৎক্ষণিকভাবে আমার বুয়েটের সাইদূর রহমান স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। আজকে যেমন শুরুতেই জিজ্ঞাসা করলেনঃ 'তুমি পড়াশোনার বাইরে কি করতে পছন্দ কর?' আমি উত্তর দিলামঃ 'ব্লগিং'। উনি পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেনঃ 'কী নিয়ে লেখ?' আমি বললামঃ 'ইউভিএ'। উল্লসিত হয়ে ম্যারি লু বললঃ 'দারুণ, তোমাকে আমার আর জিজ্ঞেস করার কিছুই নেই আজকের ভাইভায়। তুমি পাশ।' আমি হতচকিত হয়ে গেলেও পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এটা তার একটা জোকস ছিল। অবশ্য এটাও বুঝতে পারলাম, তার মেজাজ ভালো। ইউভিএ নিয়ে লিখি এটা বলাতে খেলার শুরুতেই এক-শূন্য গোলে এগিয়ে গিয়েছি। এরপর অবশ্য আমার উপর এ্যাটাক শুরু হলো। সে আমাকে কম্পাইলারের প্রতিটি ধাপে যা যা ঘটে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। 'এটা কেন, সেটা কেন, অন্য রকম হলে কি হত?' এইসব নানান মারপ্যাঁচের প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে গ্রিমশ আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলল, 'আই অ্যাম সরি টু ইন্টরাপ্ট দ্য নাইস ডিসকাশন, বাট টাইম’স আপ। এখন প্রফেসর সুধানভার পালা।'
মারিলুর পর সুধানভা গুরুমূর্তির পালা। ভদ্রলোক আর্কিটেকচারের ওপর প্রশ্ন করবেন। ইউভিএর একমাত্র ইন্ডিয়ান প্রফেসর ইনি। প্রতিবেশি দেশের লোক, আশা করেছিলাম আমার ওপর সদয় হবেন। সে আশায় গুড়েবালি। হিন্দি ছবির ভিলেইন গুলশান গ্রোভারের ভঙ্গিতে সে মাল্টি প্রসেসর আর্কিটেকচার নিয়ে বিশাল আলোচনা শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে এসে প্রশ্ন করে বসলঃ 'বল দেখি, মাল্টিপ্রসেসর সিস্টেমের ক্যাশ কোহেরেন্সি আর ক্যাশ কনসিসটেন্সির মধ্য কি কি পার্থক্য আছে?' আমার কাছে এ দুটোর পার্থক্য জলের মত পরিষ্কার – ক্যাশ কোহেরেন্সি আমি হাল্কা হাল্কা পারি আর ক্যাশ কনসিসটেন্সি আমি এক ফোঁটাও পড়ে আসিনি। সারা বইয়ের হাজার হাজার টপিক থাকতে ভদ্রলোক ধাপে ধাপে প্রশ্ন করতে করতে আমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে আসলো যে এক পর্যায়ে আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম এই বিষয়ে এতটা পড়াশোনা নেই। মনে হল, এতে সে শেষ পর্যন্ত শান্ত হলো এবং ততক্ষণে কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর গ্রিমশও জানালেন সময় শেষ। ঠিক যেন- আমি কোন হিন্দি ছবিতে অভিনয় করছি যেখানে আমাকে একটা হাতল-ওয়ালা কাঠের চেয়ারের সাথে নাইলনের রশি দিয়ে টাইট করে বেঁধে ভিলেইন গুলশান গ্রোভার বিভিন্ন ভাবে মারধোর করছে আর জিজ্ঞাসা করছে- 'বল ব্যাটা, কোথায় আছে ‘ক্যাশ’, কী করেছিস তুই ‘রেজিস্টার’, কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস ‘কাউন্টার’- বল, বল।' আমি অসহায়ের মত মার খেয়ে যাচ্ছি কিন্তু তাও এসবের হদিস দিচ্ছিনা। শেষপর্যন্ত সিনেমার ডিরেক্টর গ্রিমশ ‘কাট, এক্সেলেন্ট শট’ বলার পর আমাদের যুদ্ধ থামলো।
এরপর থিওরি। প্রশ্নকর্তা ওয়েসলি উইমার। তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে প্রায় সাইরেনের স্পীডে ইংরেজিতে কথা বলে, যার শতকরা ষাট ভাগ কথা আমি বুঝিনা। ক্লাসে সে সবসময় চকলেটের প্যাকেট নিয়ে আসে। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লাসে যে কোন প্রশ্ন করলেই তাকে সে চকলেট ছুঁড়ে মারে। ফিগার সচেতন ছাত্রীদের জন্য আবার থাকে সুগার-ফ্রী চকলেট। ক্লাসকে ইন্টারএ্যাকটিভ করার এটা দারুণ একটা পদ্ধতি। কিন্তু আজকে তার কাছে কোন চকলেট নেই। আজকে সে চকলেটের বদলে বোমা নিয়ে এসেছে বলে আমার ধারণা। একটার পর একটা বোমা মারবে যতক্ষণ না আমি আত্মসমর্পণ করছি। আমি ডানহাতে মার্কার পেন শক্ত করে চেপে ধরে ডিফেন্সের জন্য প্রস্তুত। মনে মনে একবার অ্যালগোরিদম বইয়ের পাতাগুলো মনে করার চেষ্টা করলেম। দেখলাম পৃষ্ঠাগুলো মাথায় ঠিক ঠাক আছে। কোরম্যানের অ্যালগোরিদম বই বুয়েটে ঢোকার পর থেকে অসংখ্যবার পড়তে পড়তে ও পড়াতে পড়াতে ঝালা ঝালা হয়ে গেছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে ভাইভা রুমে কথাবার্তার ওপর আছি বলে শুরুর দিকের আঢ়ষ্টতাও কেটে গেছে। আমি অপেক্ষায় আছি ওয়েসলির বেস্ট শটের। খুব মন দিয়ে প্রশ্ন শুনতে হবে। প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারার পার্টটাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলঃ 'পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন অর্ডারের পাঁচটি অ্যালগোরিদমের নাম বল দেখি'। প্রশ্ন শুনে মনে মনে আমার মুখ বিস্তৃত হাসি- মামা, এটা তোমার বেস্ট শট? এই প্রশ্ন আমাকে না করে বুয়েটে আমার ওয়ান-ওয়ানের ক্লাসের ছাত্রদের করলেও দেখা যাবে চার-পাঁচটা আঁতেল ছাত্র হাত উঠিয়েছে, আর এই প্রশ্ন আমাকে করছ পিএইচডির ভাইভায়! তারপরও আমি মাথা ঠান্ডা রাখলাম। কেননা ১৯৯৯ সালের ক্রিকেট ওয়ার্ল্ডকাপে হার্সাল গীবস ঠিক এমনই আনন্দের আতিশয্যে স্টিভ ওয়াহর সহজ ক্যাচটি ফেলে দেয়াতেই ক্রিকেটের ইতিহাসটা পালটে যায়। আমি কোয়ালের ইতিহাস পাল্টাতে আগ্রহী নই বিধায় ঠান্ডা মাথায় অতি সহজ পাঁচটা অ্যালগোরিদমের নাম বোর্ডে লিখলাম। সবচেয়ে সহজ কিছু উদাহরণ বেছে নেয়ায় ওয়েসলি বুঝলো তার প্রশ্নকে আমি সামান্য কটাক্ষ করেছি। বুঝতে পেরে সরাসরি সে কম্পিউটেশনাল কমপ্লেক্সিটি, এন-পি কমপ্লিটনেস এসব কিম্ভুতকিমাকার তত্ত্ব থেকে একের পর এক বোমা বর্ষণ করতে লাগল। বেশ খানেক বছর আগে বুয়েটের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র থাকাকালীন পড়া জ্ঞানের সাথে বিগত কয়েক দিনের হাল্কা রিভিশন মেলানো সম্বল দিয়েই অনেকক্ষণ লড়াই করলাম। তবে আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলাম যে, পাঁচ-ছয় বছর আগে শ্রদ্ধেয় কাসেম স্যারের প্রচন্ড কড়া গ্রেডিংয়ের ভয়ে শেখা থিওরির জ্ঞান গুলোই শুধু এখন মনে পড়ছে। গত কয়দিনে বই-পুস্তক-উইকিপিডিয়া ঘেঁটে যা শেখার চেষ্টা করেছি তার কিছুই এখন মাথায় নেই। ভাবতেই ভয় লাগছে যদি ওই সময়ে স্যারের ভয়ে কিছুই না শিখতাম তবে আজ আমার কী হতো! বুয়েটের স্যারদের যতই ভাল-মন্দ বলি না কেন, তারা যদি এভাবে প্রেসার না দিতেন হয়ত কিছুই শেখা হতোনা।
টানা চল্লিশ মিনিট ভাইভা দিয়ে আমি ক্লান্ত। কথা বলতে বলতে কেমন যেন একটা ফ্লোয়ের মত তৈরি হয়েছে যেটা ভালো না মন্দ বোঝা যাচ্ছে না। ওরা যা যা জিজ্ঞাসা করছে সেটা নিয়ে যা কিছু মনে পড়ছে সেটাই বলে দিচ্ছি। ঠিক-ভুল কিছুই কেয়ার করছি না। উদাহরণ স্বরূপ, প্রফেসর গ্রিমশ এখন যদি আমাকে 'আখরোট ফল কী?' এটা জিজ্ঞাসা করে, তবে এই মুহুর্তে আমার শুধু মনে পড়বে শাহরুখ খানের 'বাদশা' মুভির কথা কেননা এই ফল ওই মুভি ছাড়া আমি আমার লাইফে কখনও চোখে দেখিনি এবং মনে পড়ছে ওই মুভিতে এটার একটি বিশেষ ভূমিকার কথা। আমি বলব, 'আখরোট একটি বিচিত্র ফল যেটাকে খাওয়ার আগে যে কোন একটি আয়নার দিকে তাক করে, কায়দা করে ঢিল মারতে হয় এবং এতে আয়না ভাংতেও পারে আবার নাও পারে। ভাঙ্গাভাঙ্গির বিষয়টা পুরোটা নির্ভর করছে নিক্ষেপকারীর হৃদয়ের অবস্থার ওপর। এই রুমে একমাত্র আপনার চশমাটা আমার কাছে কাঁচের মনে হচ্ছে। আপনার কাছে কোন আখরোট ফল থাকলে আমাকে দয়া করে এনে দেবেন কী, আমি আমার হৃদয়ের অবস্থাটা একবার একটু পরীক্ষা করে দেখতে খুবই আগ্রহী। প্লিজ।' বাস্তবে গ্রিমশ আখরোট ফল কী জিজ্ঞাসা না করলেও প্রশ্ন করল রিমোট প্রসিডিউর কল ও তার খুঁটিনাটি নিয়ে। আমি বুঝলাম না অপারেটিং সিস্টেমস-এ এত্ত কিছু থাকতে এই ভদ্রলোক কেন এই জিনিস আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমি আমার মাথার অদৃশ্য সার্চ বাটনে ক্লিক করে যা যা পেলাম তা-ই বললাম। ভদ্রলোক আমার জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে অপারেটিং সিস্টেম থেকে যাত্রা শুরু করে কিভাবে কিভাবে কথা বলতে বলতে নেটওয়ার্কিং এ চলে গেল। তারপরও তার জানার আগ্রহ শেষ হয়না। আমি ত্যক্ত, বিরক্ত, ক্ষুধার্ত, আর্ত হওয়া সত্ত্বেও তার জ্ঞান পিপাসা মেটানোর কাজে নিজেকে বাধ্য হয়ে নিয়োজিত রাখলাম।
পঞ্চাশ মিনিটের ভাইভা পঞ্চাশ মিনিটেই শেষ হলো। ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে সেটা চিন্তা করতে আর ইচ্ছা করছিল না। ভাইভা শেষে দুটো গুরুত্বপূ্ণ বিষয় আবিষ্কার করলাম। (এক) আমার সদ্য সেভ করা দাড়ি অজ্ঞাত কারণে আবার গজিয়ে বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে, এবং (দুই) ওলসন হল থেকে বেরিয়ে দেখি ঝির ঝির বৃষ্টি। মনে হলো, বাহ, এটাই তো দরকার ছিল আজকে। আজকে এই বৃষ্টিতেই হাটতে হাটতে বাড়ি যাব।
------------------------------------------------------------------------------
সাত দিন পরের ঘটনাঃ চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে বাথরুমে গোসল করছি। হঠাৎ শুনি এনামুল আরো জোরে চিৎকার করছে, বাথরুমের দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছে আর বলছে- ‘নির্জন ভাই, আমরা পাশ করছি, আমরা পাশ’। আর্কিমেডিস নই আমি। তাই পুরো গোসল শেষ করেই বেরোলাম। জানলাম ভাইভায় সব লেভেল মিলিয়ে অনেকেই পাশ করেছে এবার। অবশ্য প্রথম বর্ষের পঁচিশজন গ্র্যাড-স্টুডেন্টদের মধ্যে মাত্র তিনজন এ যাত্রায় পাশ করতে পেরেছে। এ তিনজনের মধ্যে আবার দুইজন বাংলাদেশি! তনিমা বাংলাদেশে বেড়াতে না গিয়ে থাকলে আর মুনির পেপার সাবমিশন নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে এই সংখ্যা ‘পাঁচ জনের মধ্যে চারজন’ এমনটা হতে পারতো।
ফলোআপঃ
(১) তারপরও ডিপার্টমেন্টে আমাদের এখন রমরমা অবস্থা। ছাত্র-প্রফেসরদের সবারই বাংলাদেশ নিয়ে বিস্ময়। এরা দেশটার নামই জানতনা কিছুদিন আগেও। এখন নাম মুখে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। কিছুটা বিপদও হয়েছে এ জন্য। প্রফেসরদের এক্সপেক্টেশন অনেক বেড়ে গেছে। এসব পূরণ করতে হলে মহাসমস্যা। আমার ক্ষীণ বিশ্বাসঃ আওয়ামীলীগ কিংবা বিএনপির কোন পলাতক ছাত্রনেতা আজকে যদি ইউভিএর কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে এসে বলে, ভাই আমি বাংলাদেশ থেকে ভিজিটে এসছি- আমার ধারণা বেশ কিছু প্রফেসর তাকে ডেকে-ধরে রুমে বসিয়ে ঘটা করে নিজস্ব রিসার্চের বিষয়ে আলোচনা দেবে। বর্ষীয়ান কেউ হলে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রীও দিয়ে দেয়া হতে পারে।
(২) কোয়ালিফায়ার পাশ করাতে আমার বেতন মাসে ১০০ ডলার বেড়েছে। একশ ডলার বেতন বাড়ার খুশিতে মাসে প্রায় তিনশ ডলার খরচ বেড়ে গেছে। যেমনঃ বড় দেখে নিজস্ব এ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছি যেটাতে ভাড়া বেড়েছে একশ, একটা গাড়িও কিনে ফেলেছি যেটাতে ইন্সুরেন্স আর তেল মিলিয়ে খরচ বাড়লো একশ, ঘরে এখন ক্যাবল লাইন সহ পার্সোনাল টিভি আছে যেটা অবশ্য অ্যাপার্টমেন্টের সাথে ফ্রী, নতুন হাচ দেয়া একটা সুন্দর ডেস্ক, বুক সেলফ কিনেছি, শুধু বাথরুমের পাপশ আর পর্দা কিনতে গেছে আরো একশ, একটা ম্যাকবুক আর একটা আইফোনও নেব নেব ভাবছি। পিএইচডি কোয়ালিফাই বলে কথা!
(৩) আগের লেখায় হ্যাংচ্যাং এর কথা বলেছিলাম। হ্যাংচ্যাং এবারও পিএইচডি কোয়ালিফাই করতে পারেনি। তবে সে এটা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। ইউভিএ থেকে তাকে বের করে দেওয়া হবে এটাতে তাকে মনে হলো বেশ খুশি। আজকাল সে মাইক্রোসফট-গুগোলে ম্যারাথন ইন্টারভ্যূ দিয়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য কোয়ালিফায়ার এক্সামে ছাত্র-ছাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে ডিপার্টমেন্ট কোয়ালিফায়ার এক্সাম পদ্ধতিকে পাল্টানোর ঘোষণা দিয়েছে। নতুন পদ্ধতি চালু হলে পাসের হার ব্যাপকভাবে বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। হ্যাংচ্যাং হয়ত নতুন পদ্ধতিতে সুইচ করে ফেলবে খুব শিগ্রী। (শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১৮