খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে দুটো সেলে আটকে রেখে ইম্পেরিয়াল এক্সাম নেয়া হচ্ছে। হিউওম্যান রাইটস বিবেচনা করে তাদের বেঁধে না রেখে বরং এসিওয়ালা ঘরে ল্যাপটপ সহকারে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। সিস্টেমস রিলেটেড রিসার্চে ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার খ্যাতনামা প্রফেসর জ্যাক স্ট্যানকোভিককে দেয়া হয়েছে পুরো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের ভার।
জ্যাক তার অন্যতম প্রিয় একজন বাংলাদেশি ছাত্রকে ডেকে বললেন, দেখ, তোমার দেশের সবচেয়ে মেধাবী দুজন মানুষের মাঝে কে সবচেয়ে মেধাবী ও দেশপ্রেমিক তাকে আজ বাছাই করা হবে। ইসন্ট ইট ইক্সাইটিং?
ছাত্র বলল, ইয়া ইয়া।
জ্যাক বর্ণনা করছে, এই পরীক্ষা পদ্ধতিতে সারা দেশের সকল মানুষের হৃদয়ের চাওয়া-পাওয়াকে আমাদের সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমস দিয়ে ক্যাচ করা হবে। তারপর সেগুলিকে ক্লাসিফাই করে তৈরি করা হবে সর্বকালের সেরা একটি প্রশ্নপত্র, যেটাতে সারাদেশের মানুষের সকল জিজ্ঞাসার নিখুঁত প্রতিফলন থাকবে।
ছাত্রের অভিব্যক্তি, ইয়া ইয়া।
এরপর একটার পর একটা প্রশ্ন দুই নেত্রীর সামনের স্ক্রিনে আসবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। সেলের দেয়ালে লাগানো কোটি কোটি সেন্সর ডিভাইস তাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরণকে মনিটর করবে। দেশবাসীর প্রশ্ন শুনে তাদের ব্রেইনে যে অনুরণন হবে, তোমার লেখা ব্রেইন মেজারমেন্ট প্রোগ্রাম দিয়ে সেই ডাটা বিশ্লেষণ করে আমরা জেনে যাব কার ব্রেইন কত শক্তিশালী। পুরো কম্পিউটেশন পলিনোমিয়াল টাইমে শেষ হতে বাধ্য। আর সেটার অর্থ কী সেটা তুমি জানো। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তরটি নিয়ে আমাদের অনেকদিনের ক্লেইম আজকে প্রমাণ হয়ে যাবে। আমি হব চিরস্মরণীয় ও মহান। তুমি পাবে তোমার ডিগ্রি।
ছাত্র জোরে মাথা নেড়ে বলল, ইয়া ইয়া।
এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। দেশবাসীর অগণিত আকুতি ক্লাসিফাই হয়ে শেষপর্যন্ত একটা মাত্র প্রশ্নে কনভার্জ করেছে- ‘তোরা কবে যাবি?’
জ্যাক বাংলা জানেনা, সে শুধু মন্তব্য করল, বাহ সারাদেশের লোকজনের দারুণ ঐক্য, এত ডাটা থেকে মাত্র একটি প্রশ্ন? উত্তরটা মাত্র এক বাইটেই আমরা স্টোর করতে পারব মনে হচ্ছে।
ছাত্র বলল, ইয়া ইয়া।
এরপর দুই নেত্রীকে তাক করে একসাথে সমস্ত সেন্সর ফায়ার করল। কগনেটিভ হাইপার এক্সরে সেন্সরের সমস্ত ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে ব্রেইনের সব সেল তন্ন তন্ন করে উত্তর খোঁজা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যেখানে এক পিকো সেকেন্ডে উত্তর চলে আসে, সেখানে পুরো এক মিনিট পার হয়ে গেলেও কোন উত্তর নেই। স্ট্যানকোভিকের নিজের ব্রেইনের ক্ষেত্রে লেগেছিল ছাপ্পান্ন সেকেন্ড। স্ট্যানকোভিক তাই মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করল, অ্যামেজিং, আনবিলিভেবলি ট্যালেন্ডেড লেডিস। মিনিট খানেক পেরিয়ে গেল কিন্তু কোন রেজাল্ট নেই। ফেমটোপ্রসেসরের প্রসেসিং পাওয়ার শেষ হয়ে আসছে, সারা আমেরিকার সকল ব্যাকআপ স্টেশন দিয়ে আর হয়ত মিনিট দশেক টিকিয়ে রাখা যাবে কম্পিউটেশন। উত্তেজনায় আর আশঙ্কায় জ্যাকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শুধুমাত্র একটা সিগন্যাল ধরতে পারলেই সেটা এই মূহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও সফল কম্পিউটেশনের অবিস্মরণীয় রেকর্ডে পরিণত হবে।
হঠাৎ দপ করে সব যন্ত্রপাতি বন্ধ হয়ে গেল। গোটা আমেরিকা অন্ধকারে নিমজ্জিত। বিশাল বপু জ্যাক হতাশা আর দুঃখে ছোট্ট শিশুর মত কাঁদতে লাগল। বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রজেক্ট, অব্যর্থ একটি সিস্টেম, যা কিনা সমগ্র বিশ্বের যে কোন মানুষের ব্রেইনসেলের তথ্য পলিনোমিয়াল টাইমে পড়ে আনতে পারে বলে সে দাবী করে আসছিল, আজ তা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে প্রত্যন্ত বাংলাদেশের অসাধারণ মেধা সম্পন্ন দুজন মহীয়সী নারী। তাদের মস্তিষ্কের রেজোনেন্স ডিফেন্স পাওয়ার এত শক্তিশালী যে, বিলিয়ন বিলিয়ন ব্রেইন সেলের একটিও হার মানেনি জ্যাকের ডিভাইসের কাছে। অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে জ্যাক ছাত্রের হাতে পিএইচডি ডিগ্রির রেকোমেন্ডেশন পেপার দিয়ে বলল, আমি হার মেনেছি। কাল থেকে আমার জায়গায় তুমিই এই ল্যাবের নতুন কর্ণধার। পারলে নতুন কোন বিষয়ে নতুন কিছু নিয়ে গবেষণা করো। আজ থেকে আমার ছুটি। বাকি জীবনটা আমি বাংলাদেশে কাটাতে চাই। তোমাদের আলো-বাতাসে কিছু একটা আছে, যেটায় আমার কমতি আছে। সেটা কী আমি শুধু একবার জানতে চাই। ওহ জিসাস, অ্যামেজিং, আনবিলিভেবলি ট্যালেন্ডেড লেডিস।
ছাত্র আস্তে আস্তে বলল, ইয়া ইয়া।
ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় জ্যাক চলে গেল ওলসন ল্যাব ছেড়ে। ডিগ্রি হাতে ছাত্র বেশ কিছুক্ষণ তার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বেশ খানিকক্ষণ পর নিথর হয়ে থাকা ফেমটোপ্রসেসরের সামনে গিয়ে সে দাঁড়াল। এরপর প্যান্টের বাম পকেট থেকে বাংলাদেশ থেকে আনা চান্দা ব্যাটারিটি বের করল। পাওয়ার আউটের এ আশঙ্কা তার আগেই হয়েছিল, আর তাই আগে থেকেই সে সতর্কতা নিয়ে রেখেছিল। ফেমটোপ্রসেসরের ব্যাটারি হোলে চান্দা ব্যাটারি ঢুকিয়ে নিমিষেই যন্ত্রটিকে সে আবার সচল করে ফেলল। প্রসেসরের কম্পিউটেশন বন্ধ হবার ঠিক আগ মুহূর্তে সেটি যেন মেমরি ডাম্প করে রাখে সে ব্যবস্থা সে আগেই নিয়ে রেখেছিল। প্রোগ্রাম ঠিকমত কাজ করে থাকলে মেমরি ফুটপ্রিন্ট দেখে বের করে ফেলা সম্ভব কী কারণে প্রসেসর এত সময় নিচ্ছিল। ক্র্যাশ করলেও লগ ডিভাইসে সব এক্সেপশন মেসেজ সেইভ থাকার কথা। তিলে তিলে একবাইট একবাইট করে লিখেছে সে পুরো প্রোগ্রামটি। ঠিক কততম বাইটে সেই মেসেজ থাকবে সেটা সে ছাড়া আর কেউ জানেনা। একটা একটা করে লগ মেসেজের প্রতিটি বাইট সে পড়ে ফেললো। এরপর সেগুলোকে সাজিয়ে ক্যারেকটারে কনভার্ট করে উদ্ধার করে আনল ফেমটোপ্রসেসরের এক্সেপশন মেসেজটি- ‘এক্সেপশন ৮৮০২- ডিভাইড বাই জিরো এক্সেপশন, নো নিউরণ ফাউন্ড ইন ব্রেইন, প্লিজ ইনপুট এ হিউম্যান ব্রেইন।‘ ছাত্রের মুখে হাসির আভা, সে জানে ডিভাইস নিখুঁতভাবে কাজ করছে। শুধু ইনপুট নেবার সময় একটা নতুন কনডিশান যোগ করতে হবে মাত্র। চান্দা ব্যাটারির পাওয়ার শেষ। ডিভাইস বিপ বিপ করে জানাতে লাগল সে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মুচকি হেসে সে মনে মনে বলল, ইয়া ইয়া।
বারিটোর সুদীর্ঘ ক্লাসে ডজন খানেক পূর্ণদৈর্ঘ্য দিবাস্বপ্ন দেখেও সময় কাটানো কখনো কখনো মুশকিল হয়ে যায়। আজকে আর নতুন কিছু চিন্তা শুরু করা যাবেনা। কারণ, একটু পর আমার নিজের প্রেজেন্টেশনের পালা।
আমি এতক্ষণ অন্যান্যদের প্রেজেন্টেশন শুনছিলাম আর মজার কিছু পেলে টুকেও রাখছিলাম। মিস বারিটো সবার শেষের সিটে বসে প্রেজেন্টেশন গ্রেডিং করছে। সে আগেই বলে রেখেছিল, কারো কথা যদি স্পষ্ট শোনা না যায় তবে তাকে পেছন থেকে চেয়ার ছুঁড়ে মারবেন। আমাকে নোট টুকতে দেখে কখন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা খেয়াল করিনি। একপর্যায়ে যখন পিঠ চাপড়ে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাভিং ফান? আমি ভয় পেয়ে চমকে উঠে বললাম, ইয়া ইয়া। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে হাসি দিয়ে বারিটো বলল, ইয়র টার্ন নেক্সট।
পেনড্রাইভ থেকে আমার প্রেজেন্টেশনের কপিটা ডেক্সটপ মেশিনে কপি করে পাওয়ার পয়েন্ট খুলে আমি রেডি। শত শত ছাত্রছাত্রীর সামনে অসংখ্য ক্লাস নিয়েছি ঢাকায়। ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশনও করেছি দু-একবার জীবনে। তারপরও কেন যেন গলা শুকিয়ে যেতে শুরু করল। মুখের হাসিহাসি ভাবটাও ধরে রাখাটা কষ্টকর হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সামনে বসা সবার চেহারা কেমন যেন অস্পষ্ট। বাংলাদেশের কোন এক ওয়ানডে ক্রিকেটের কমেন্ট্রিতে গাভাস্কারকে একবার বলতে শুনেছিলাম, ক্রিজে গিয়ে টেনশন হলে ব্যাটসম্যানের উচিত দু-তিনবার লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়া। সেই উপদেশ কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। তিনবারে কাজ হলো না। সাত-আটবার পর সামনে বসা সবার চেহারা একটু একটু করে পরিষ্কার হতে লাগলো। পেছনে চোখ পড়তেই খেয়াল করলাম, মিস বারিটো শুরু করার জন্য বার বার ইশারা করছে। শীতকালে ঠান্ডা পানিতে যারা গোছল করেছেন তারা জানেন যে প্রথম মগ পানি গায়ে ঢালাটাই সমস্যা, এরপর বাকিটুকু খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। একই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যা থাকে কপালে বলে এফ-ফাইভ চাপ দিলাম। গাঁঢ় নীল ব্যাক-গ্রাউন্ডে সবার সামনে বড় হয়ে ভেসে উঠল আমার সাদামাটা স্লাইড। বোম ফাটানো কিছু নেই সেখানে। শুধু ছোট্ট একটি প্রশ্ন- ‘আপনার দেশে নিজের ভাষায় কথা বলতে কত দাম দিতে হয়?’
সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। সবাই বলাবলি করতে লাগল- মানে? কিসের দাম? কথা বলতে আবার টাকা কেন? ও-তুমি মোবাইল ফোনের কথা বলছ? চায়নায় মাসে ২০, ইন্ডিয়ায় মিনিটে ১ রুপি, বাংলাদেশে কত দিতে হয়? আমি বললাম, এখন পুরো ফ্রী, তবে ইনিশিয়ালি কিছু খরচ ছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া আমাদের মতই কিছু তরুণকে প্রাণ দিতে হয়েছে, রাজপথ একটু নোংরা করতে হয়েছিল বুকের উষ্ণ রক্তে- ব্যস, তাতেই কাজ হয়ে গেল। তাদেরকে একে একে পরিচয় করিয়ে দিলাম উপমহাদেশের মানচিত্রের সাথে, জিন্নাহ আর লিয়াকত আলীর সাথে, কলাভবনের সাথে, মিছিলের সাথে, বন্দুকের গুলির সাথে, মৃত্যুর সাথে আর স্বাধীনতার সাথে।
প্রেজেন্টেশন শেষে সবার মাঝেই কৌতুহল- এটাও কি সম্ভব? নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ইন্ডিয়ার ছেলেটা প্রথম প্রশ্ন করল, এই ঘটনা ১৯৫২ সালের, এর সাথে কী ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কোন সম্পর্ক আছে? আমি প্রথমে বুঝিনি, পরে ব্যাপারটা বোঝার পর মনে হচ্ছিল ব্যাটাকে সবার সামনে একটা চটকানা লাগাই। সে বোঝাতে চাচ্ছিল, ৪৭-এর পর থেকেই পাকিস্তানের সাথে ভারতের টানাপোড়েন চলছিল বাংলাদেশ নিয়ে। ৭১ সালের ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। চল্লিশ বছর পর আজকে এই কথা শুনছি দেখে আমার তো আক্কেলগুড়ুম। তাকে জানালাম, আঙ্কেল, যুদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে টানা নয় মাস। খেলা জেতার পর লাস্ট মোমেন্টে ইন্ডিয়া আসে ক্রেডিট নিতে। এই কোর্সে আমরা তিনজন বাংলাদেশের আর ইন্ডিয়ার সে একা। এনামুল আর তনিমাও লেগে গেল ওর সাথে তর্ক যুদ্ধে। আমাদের সাথে না পেরে সে চুপ মেরে গেল। বারিটো প্রশ্ন করলেন, তোমাদের যুদ্ধ কী এখনকার পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মাঝে যে মতানৈক্য আছে এটার মত কিছু, নাকি কাশ্মীরের মত কিছু? ওকে বুঝিয়ে বললাম, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক সব কারণ। আমার একা সমস্যা হচ্ছিল বুঝতে পেরে এনামুলও লেগে গেল ব্যাখ্যায়। সে ঠিকঠাক মতই অনেক কিছু বলল, কিন্তু আমার হাসি পেল নাইন-টেনের পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে পয়েন্টগুলো লেখা ছিল হুবহু সেটাকেই অনুবাদ করে করে বলার ধরণ দেখে। তার কথা শেষ হতেই ইন্ডিয়ান ছেলে এবার কাশ্মীরের কাহিনী ব্যাখ্যা শুরু করলো। কাশ্মীর নাকি ইন্ডিয়ারই ছিল শুরুর দিন থেকে। কিন্তু ইন্ডিয়ান গভর্ণমেন্ট কাশ্মীরকে নিজেদের বলে স্বীকৃতি দিয়েছে এই খবর কাশ্মীর পর্যন্ত পৌঁছাতে একদিন দেরি হয়। এর মাঝেই নাকি সুযোগ বুঝে পাকিস্তান কাশ্মীরকে নিজেদের বলে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। সেই থেকেই কেউ এটাকে পাকিস্তানের, আর কেউ ইন্ডিয়ার দাবি করে। তার কথায় আমি বুঝলাম, বেশির ভাগ ইন্ডিয়ানরাই বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এই একই ধারণা পোষণ করে। ইন্ডিয়ানদের ধারণা বাংলাদেশ তাদের অংশ ছিল, কিন্তু পাকিস্তান এটাকে কব্জা করে রাখে অনেকদিন। এরপর ইন্ডিয়াই বাংলাদেশকে রক্ষা করে তাদের হাত থেকে। তখন একবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ইন্ডিয়ার কী? সময় আর সেটার অনুমতি দিল না। জমে ওঠা তর্ক ঘড়ির কাটার নির্মম আঘাতে নিমেষেই মিলিয়ে গেল।
স্প্রিং শেষ হয়ে গেছে। শারলোটসভিলের গাছপালা আবারো সবুজ পাতায় পাতায় ভরে গেছে। বারিটোর প্রশংসামাখা স্কোর রিপোর্টটাও অ্যাডভাইজারের টেবিলে পৌঁছে গেছে। মজায় মজায় একটা কোর্স শেষ হয়ে গেল, কিন্তু সত্যিই কি কিছু শিখেছি? আমার তো কিছু মনে হয়না। আচ্ছা একটু পর্যালোচনা করে দেখা যাক-
ব্লুপারসঃ
(১) তৃতীয়বর্ষের আন্ডারগ্র্যাড এরিকের সেদিন মাইক্রোসফটে ফোন ইন্টারভ্যূ। প্রোগ্রামিং কনটেস্টের বদৌলতে আমার সাথে তার পরিচয়। আমাকে বলছে, কী করা যায়? তাকে বেশ কিছুক্ষণ তালিম দিলাম ডাটাস্ট্রাকচার, লিঙ্কলিস্ট উল্টানো, টেস্টিং এসব নিয়ে। যাবার আগে বলে গেল, ইওর ইংলিশ ইস মাচ বেটার নাউ! সবকিছু দারূণ করে বোঝালে। ইন্টারভ্যূতে এখন এসব তোমার মত করে গুছিয়ে বলতে পারলেই হয়।
(২) মেইনটেনেন্সের নিগ্রো লোকটা এসেছে। তাকে দিয়ে দেয়ালে টিউবলাইট লাগাবো কারণ বাল্বের লাল আলোতে আমি পড়তে পারিনা। সে এসে তর্ক জুড়ে দিল, দেয়ালে ফুটা করে কিছুতেই সে লাইট লাগাবে না। ঘরে এত বাল্ব থাকতে আবার কেন টিউবলাইট? এত বেশি লাইট-ফ্যান চালাই কেন? সারাদিন এসি চললে তো অচিরেই নষ্ট হবে। ওকে বললাম, তোমার কাজ তুমি কর। বিল তো আমার নিজের পকেট থেকে দিই। আমি সারাদিন কেন, সারা জীবন এসি চালাবো। আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশ গেলেও এই এসি সারাদিন চলবে, তাতে তোমার কী? অনেক তর্ক করেও কাজটা করিয়ে নিতে পারলাম না। যুক্তির ওপর যুক্তি, কথার ওপর কথা। চলে গেলে ভাবলাম, বাহ, ইংরেজিতে তুমুল ঝগড়া করছি, বেশ উন্নতি!
(৩) ঝোঁকের মাথায় পিএইচডি কোয়ালিফায়ারের রিটেন এক্সাম দিয়ে পাসও করে ফেলেছি আমরা অনেকে। রিটেন পরীক্ষার রেজাল্টের দুদিন পরেই পঞ্চাশ মিনিটের ভয়ঙ্করতম ভাইভা। কিছু পারবো তো? বোঝা এক জিনিস, বোঝানো আরেক জিনিস, অন্য ভাষায় বোঝানো আরো ভিন্ন জিনিস। এই শেষটাতেই তো ধরা! ডিপার্টমেন্টের সাপ্তাহিক টী-পার্টিতে এই আশঙ্কার কথা আলাপ করছিলাম সিনিওর পিএইচডি স্টুডেন্ট টিমোথি, তামিম আর এ্যান্থোনির সাথে। আমার সাথে এনামুল আর মুনিরও ভাইভা দিচ্ছে। পিৎজা খেতে খেতে টিম বেশ কিছুক্ষণ তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে আমাদের কিছু টিপিকাল ভাইভার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করল। আমাদের সলিড ডিফেন্স দেখে বলল, ইমপ্রেসিভ। তামিম যোগ করল, তোমাদের কারো সেই সমস্যা আর নেই।
(৪) ভাইভা দিতে যাব। ঠিক বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আমার টাইম। আর মাত্র দু’মিনিট আছে। সময় বাঁচাতে প্রিন্টিং রুমের মাঝ দিয়ে সর্টকাট একটা গলি বেছে নিলাম এক্সাম রুমে ঢোকার জন্য। হঠাৎ একটা মেয়ের গলার শব্দ- এক্সকিউজ মি, আমাকে একটু শিখিয়ে দেবেন কী করে স্ক্যান করতে হয়। ছেলে হলে ইগনোর করে চলে যেতাম, মেয়েটাকে আর পারলাম না। মেয়েটা আমাদের এখান থেকে মাস্টার্স করে এখন বার্কেলিতে পিএইচডি করছে। দীর্ঘদিন পর বিশেষ আমন্ত্রণে ইউভিএ এসেছে আগের রিসার্চ গ্রুপের সাথে দেখা করতে। আগের অনেক কিছুই তাই ভুলে গেছে। তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে স্ক্যান করার বিষয়টি (যেটা আমি নিজেও ঠিকমত পারিনা) শিখিয়ে দিলাম। সে শুনে বলল, এভাবেই তো অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, তাও হচ্ছে না। তার কাছে জানতে চাইলাম সে কী উপায়ে চেষ্টা করেছে। আবিষ্কার করলাম স্ক্যান করার সময় এই মেশিনে নিজের আইডি দু’বার ইনপুট দিতে হয়, সেটা সে জানেনা। সে জিজ্ঞাসা করল, দু’বার আইডি দেবার কী কারণ থাকতে পারে? চিন্তা করে বললাম, হয়ত তুমি নিজের একাউন্ট দিয়ে লগিন করে আবার অন্যের একাউন্টে স্ক্যান করা কাগজ পাঠিয়ে দিতে পারবে, তাই এ ব্যবস্থা। আমার যুক্তি তার মনে ধরেছে বলে মনে হল। আমি বললাম, আমার হাতে সময় নেই। আবার এক ঘন্টা পর এই পথ দিয়ে যখন ফেরত যাব, তখনও যদি দেখি তুমি আটকে আছ, তবে তোমার কাজ করে দিয়ে যাব। আমার রসিকতা সে বুঝতে পেরেছে। সরি, থ্যাঙ্কস, বেস্ট-অফ-লাক বলে আমাকে বিদেয় দিল। ঘড়ি দেখলাম। পাক্কা দুমিনিট এক নাগাড়ে কথা বলে গেলাম বিদেশিনীর সাথে! অপূর্ব।
(৫) বাইরে খেতে যাচ্ছি গাড়ি নিয়ে আমরা সবাই। দোকানের নাম জানলেও লোকেশন জানা নেই। জিপিএস যন্ত্র বোকার মত একই পথে ঘোরাচ্ছে আমাদের। তানিয়া আপা গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, কাউকে ফোন করে বলতে হবে ইন্টারনেটে সার্চ করে সে যেন আমাদেরকে দোকানের ফোন নাম্বারটা দেয়। এরপর দোকানে ফোন করে সঠিক ঠিকানাটা জেনে নেব আমরা। এনামুল ফোন করল কীর্তিকে। কীর্তি ইন্ডিয়ান ছাত্র- প্রায় সারাক্ষণই ডিপার্টমেন্টে পিসির সামনে বসে কাজ করে। আমাদের ঘটনা তাকে বুঝিয়ে বলার পর তার কাছ থেকে এনামুল দোকানের ফোন নাম্বারটা নিল। তনিমা সাথে সাথেই দোকানে ফোন করে জানতে চাইলো তারা কোথায় তাদের দোকান লুকিয়ে রেখেছে? আমরা কেন জিপিএস দিয়ে সেটাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাচ্ছিনা?
মাস খানেক আগেও যারা কিনা ফোনে কথা বলার কথা শুনলেই একে অপরকে ঠেলাঠেলি করত, আজ মনে হয় তারা নিজেরাই আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে! প্রয়োজনে ঠাট্টা করছে, অপ্রয়োজনে গালিও দিচ্ছে! একটু কি অবাক হওয়া উচিত?
বারিটোর কোর্সে আমরা কিছুই শেখার চেষ্টা করিনি। শেখার মত তেমন কিছু আসলে ছিলও না। সে শুধু আমাদের সাহস দিয়েছ, আর ভয়টা ভেঙ্গে গেছে আমাদের।
বারিটো সার্থক।
(বারিটোর ক্লাস-প্রেজেন্টেশনটির একটি কপি)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:২৯