আরেকটি প্রেজেন্টেশন হলো কী করে ক্লাস কন্ট্রোল করতে হবে সেটার ওপর। খানিকক্ষণ প্রারম্ভিক কথাবার্তা শোনার পর যখন মনে হচ্ছিল শেষতক লেকচারটি বেশ একঘেয়ে হবে, ঠিক তখনি পুরো ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নিল। ইন্সট্রাকটরের নির্দেশে আমাদের সবাইকে পাঁচজন পাঁচজন করে এক একটি গ্রুপে ভাগ করে ফেলা হলো। এরপর প্রতিটি গ্রুপকে একটি করে ক্লাসরুম সিনারিও দিয়ে বলা হলো সমস্যাটা অভিনয় করে দেখাও। আমি আমার জীবনে কোনদিন অভিনয় করিনি কিন্তু আমাকে যে পার্ট দেয়া হলো সেটা কমন পড়ে যাওয়াতে আমার কোন সমস্যা হলনা। আমাদের গ্রুপের দায়িত্ব ক্লাসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ছাত্র-ছাত্রীরা টেক্সট মেসেজ আদান-প্রদান করছে কিংবা গেম খেলছে এই পরিস্থিতি অভিনয় করে দেখানো। আমি হচ্ছি একজন দুষ্ট ছাত্র, যে কিনা আরেকজন ঘাগু দুষ্টের দেখাদেখি ক্লাসে মোবাইল ম্যাসেজিং শুরু করে। অভিনয় শেষে বাকিরা বলবে পরিস্থিতিটি কী ছিল এবং এই পরিস্থিতিতে ক্লাস টিচার হিসেবে করণীয় কি? প্রতিটি গ্রুপ খুব সুন্দর করে অভিনয় করে দেখালো। প্রত্যেকেই মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি করতে আসা সিরিয়াস প্রজাতির প্রাণী হলেও, নিজেকে উজার করে হাস্যকর ভাবে অভিনয় করছিল বলে পুরো সময়টা সবাই বেশ উপভোগ করলাম। দু-একজনের অভিনয় সত্যিই খুব প্রানবন্ত হয়েছিল। একটা রাশিয়ান মেয়ে পরীক্ষায় খারাপ করে শিক্ষকের সাথে দেখা করতে আসার অভিনয় এত সুন্দর করে করেছিল যে আমরা সবাই অভিনয় দেখে যার পর নাই মুগ্ধ! পরে তার কাছে জানতে পারলাম সে বাস্তবিকই একজন অভিনেত্রী। রাশিয়ায় থাকাকালীন স্টেজ ড্রামাতে সে নাকি বেশ কয়েকবার অভিনয় করেছে। আমি বাংলাদেশি ড্রামাতে কখনও অভিনয় না করলেও সেদিনের পারফরমেন্স খুব একটা খারাপ ছিলনা!
টিচিংয়ের ওপর এধরনেরই একটি প্রশিক্ষণ আমি বুয়েটেও করে এসেছি। বুয়েটে যারা শিক্ষক হিসেবে নতুন যোগদান করে তাদেরকেও টিচিংয়ের ওপর দু-দিনের একটি অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স করতে হয়। সেই কোর্সে বুয়েটের বাঘা বাঘা সব টিচাররা একটার পর একটা লেকচার দিয়ে যান। এই কোর্সে শেখানো হয়- ব্ল্যাকবুক আর ব্লু-বুকের নিয়মাদি, শিক্ষকদের কোড অফ কন্ডাক্ট কেমন হবে, তাদের কথা-বার্তা কেমন হবে, তাদের পোশাক-আশাক কেমন হবে, তাদেরকে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে নূ্ন্যতম কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখা আবশ্যক, তাদেরকে কিভাবে হাঁটতে হবে, ক্যাম্পাসের কোন কোন স্থান এখন থেকে তাদের জন্য নিষিদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা একজন সদ্য বিএসসি পাশ করা ছাত্রকে পুরোদস্তুর শিক্ষকে পরিণত করতে যাবতীয় যত মন্ত্র আছে তা পাঠ করা হয় এ অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে। ফলশ্রূতিতে কেউ কেউ হয় মন্ত্রমুগ্ধ, আর কেউ কেউ হয় বিরক্ত। বুয়েটের টিচারদের লেকচার আমাকে কোন কালেই আকর্ষণ করত না, তবে আমার মনে আছে দুদিনের সে কোর্সে (বেশির ভাগ লেকচারে গভীর ঘুম পেলেও) সিভিল ও মেকানিকালের কিছু কিছু বর্ষিয়ান টিচারের প্রাঞ্জল বক্তব্য আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছিল। ঘন্টা জুড়ে তারা নানান মারপ্যাঁচের জিনিস শেখালেও, তাদের বিষয়বস্তু আর উপস্থাপনা এত চমৎকার ছিল যে আমার মত সর্বনিম্ন স্তরের অমনযোগী ছাত্রও (শিক্ষকও) সেদিন ক্ষণিকের জন্য তন্ময় হয়ে কথাগুলো শুনছিল। একজন ভালো শিক্ষকের সাথে একজন পাতি লেকচারের এখানেই পার্থক্য। তাঁরা জানেন, কি করে শিক্ষকতা করতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক যে, এধরনের শিক্ষকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অল্প। আর একারনেই ভোর আটটা বাজতে না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে একলাফে ক্লাসে পৌঁছে আবার সাড়ে আটটা বাজার আগেই দ্বিতীয় দফা ঘুমের প্রস্তুতি শুরু করে দেয় বুয়েটের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। সেই শান্তির ঘুমের দিনগুলির কথা মনে পড়লে আজও আফসোস হয়।
লেকচার বা প্রেজেন্টেশন যত ছোটই হোক আর যত দীর্ঘই হোক, যারা শুনছে তারা যদি একবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তবেই সব পন্ড। ভালো বক্তারা শুরুতেই বোম-ফাটানো কোন কিছু দিয়ে শ্রোতাকে উৎসাহী করে তোলে। এরপর বক্তব্য যতই এগোতে থাকে, শ্রোতাদের আগ্রহ ততই বাড়তে থাকে। বক্তব্য শেষ হবার পর যদি সকলের মনে হতে থাকে কেন এত তাড়াতাড়ি শেষ হল, এ প্রশ্নের কী উত্তর, ওটা আরেকটু বুঝিয়ে বললে ভালো হতো-- তবেই বক্তা 'পাশ'। এ বিষয়টির অনুশীলন আমি এখানকার প্রায় প্রতিটি লেকচারেই দেখে থাকি। এ পর্যায়ে প্রফেসর স্ট্যানকোভিকের কী-নোট স্পিচের উদাহরণটি আমি আর না দিয়ে থাকতে পারছি না। তার আগে স্ট্যানকোভিকের একটি ছোট্ট ভূমিকা দেয়া প্রয়োজন। জন স্ট্যানকোভিক হচ্ছে ইউভিএর নামিদামী প্রফেসরদের একজন, ইংরেজিতে বলতে গেলে- 'হট কেক'। অসংখ্য প্রফেসরদেরও প্রফেসর। সে যত ছাত্রের পিএইচডি অ্যাডভাইজার, আমার বয়স সেই সংখ্যার সমান হতে হলে এখনও এক যুগ বাকি। দীর্ঘদিন রিয়েলটাইম কম্পিউটিং, কন্ট্রোল-থিওরী, সেন্সর নেটওয়ার্ক ইত্যাদিতে রিসার্চ করে সে এখন 'সাইবার ফিজিকাল সিস্টেমস' নামক নতুন এক ধারার জন্ম দেয়ার চেষ্টা করছে। ঘটনাক্রমে এই জন্মদান প্রক্রিয়ায় স্ট্যানকোভিকের সুবিশাল রিসার্চ গ্রুপের অনেকের সাথে আমাকেও সাপোর্টিং রোলে থাকতে হচ্ছে। কারণ, সে আমারও শিক্ষক, আমার পিএইচডি অ্যাডভাইজার, আমার অ্যাকাডেমিক ফাদার, বিনা কারণে পছন্দ হয়ে যাবার মত একজন মানুষ। সবাই তাকে প্রফেসর স্ট্যানকোভিক, বিপি আমেরিকা প্রফেসর, বিগম্যান, গড ইত্যাদি ডাকলেও, আমি তাকে ডাকি ‘জ্যাক’। জ্যাক ওর ডাকনাম। ইংরেজিতে সব বড় বড় নামের ছোট ছোট রূপ আছে। রবার্টসনের ডাকনাম ‘রব’, ডেভিডসনের ডাকনাম ‘ডেভ’, মাইকেলের ডাকনাম ‘মাইক’, তেমনি জনের ডাকনাম ‘জ্যাক’। এভাবে দিয়ে চিন্তা করলে ‘জ্যাক’ ডাকনামটি ব্যাতিক্রম, কেননা এখানে ডাকনামটি দৈর্ঘে মূল নাম ‘জন’ এর সমান সমান। এই তথ্যটি আমাদেরকে জ্যাক নিজেই দিয়েছিল। একবার তার লেখা একটি লেকচার নোট কারেকশন করতে গিয়ে সেখানে ‘জন স্ট্যানকোভিকের’ জায়গায় ‘জ্যাক স্ট্যানকোভিক’ লেখা দেখে এনামুল খুব গর্বিত ভঙ্গিতে তাকে জানাতে গেছে- লেকচার নোট তো দেখলাম সব ঠিকঠাক আছে, কিন্তু তোমার নামের বানানই তো ভুল লেখা। এর উত্তরে জ্যাক আমাদের সেদিন আমেরিকান ডাকনামের এই কাহিনী শোনায়। আমরা তখনও ইউভিএ-তে নতুন। এত বিশাল ও ব্যস্ত একজন মানুষের আমাদের মত কতিপয় নিতান্ত ফার্স্টইয়ার গ্র্যাডকে এত ছোট একটি বিষয় এতটা ধৈর্য্য নিয়ে বোঝানো দেখে সেদিনই বুঝতে পারলাম তার নামের মত সে নিজেও ব্যতিক্রমধর্মী একজন মানুষ। বিধাতা যেখানে তার নামকে গোটা রিসার্চ ওয়ার্ল্ডে এত বড় করেছেন, আমেরিকান কথ্যভাষা হয়ত তাই সেটাকে একটুও ছোট করতে পারেনি।
জ্যাক প্রায়শই বড় বড় রিসার্চ সেমিনারে কী-নোট স্পীচ দিয়ে থাকে। কী-নোট স্পিচ হচ্ছে বিশেষ উদ্বোধনী বক্তৃতা যেটা যেন তেন প্রফেসর না হলে দেয়া যায়না। জ্যাক শুরু করে এভাবে, আজকে আমি আপনাদের সবাইকে সাইবার ফিজিকাল সিস্টেমস সম্বন্ধে ধারণা দিচ্ছি। আপনারা কি কেউ জানেন বিষয়টি কী বা এটা নিয়ে আমি কেন এত রিসার্চ করি? আমরা যারা তার ছাত্র তারা জানি যে, সাইবার ওয়ার্ল্ড আর ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডের ফিউশনে সাইবার ফিজিকাল সিস্টেমসের সৃষ্টি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভবিষ্যতের বুদ্ধিমান যন্ত্রগুলো প্রকৃতি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সেটাকে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রসেসিং করে আবার প্রকৃতিকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রিসার্চারদের অনেকেই বিষয়টির নামও শোনেনি। সবাই তাই চুপচাপ থাকে বা একটু আধটু গুনগুন করলেও এতবড় প্রফেসরের সামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়না। জ্যাক তখন পরের স্ল্যাইডে যায়। সেখানে একটি সুপারম্যানের ছবি। সুপারম্যান বডিবিল্ডিং করছে আর সুপারম্যানের মাথার জায়গায় জ্যাকের নিজের মাথা বসানো। সে বলতে থাকে, আমি সাইবার ফিজিকাল সিস্টেমস নিয়ে রিসার্চ করি, কারণ এটা আমাকে প্রতিদিন ভালো সেক্স করতে সাহায্য করে। তার কথা শুনে দেশ-বিদেশ থেকে আগত শত শত রিসার্চারের আক্কেলগুড়ুম- একী বলছে জ্যাক? তারা কি ভুল শুনছে? লোকটা পাগল হয়ে গেল নাকি? নাকি আবার জিনিসটা সত্যি? ইত্যাদি। তাদের গুঞ্জন থামলে জ্যাক ব্যাখ্যা করে বলে, এটা একটা জোকস ছিল। এবার সঠিক জিনিসটা বলছি- সাইবার ওয়ার্ল্ড আর ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডের সমন্বয়ে সাইবার ফিজিক্যাল সিস্টেমস---। কোন সন্দেহ নেই এধরনের একটি ভূমিকার পর সবাই আগ্রহ নিয়ে পুরো লেকচারটি শুনবে এবং বিষয়টা সবার মনে দাগ কাটবেই। একবার তার লেকচার শেষে অন্য ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর মন্তব্য করেছিল- দেখ, তোমার এই লেকচারটা আমি আগেও শুনেছি বলে মনে পড়ছে, যদিও সেটার কথা আমার কিছুই মনে নেই, তবে সেক্সের ব্যাপারটা যে তুমি বলেছিলে সেটা আমার এখনও খেয়াল আছে।
মিস বারিটোর অধিনে আমাদেরকে যে ল্যাংগুয়েজ ক্লাস করতে হচ্ছে সেখানেও আমাদের প্রত্যেককে একটি করে প্রেজেন্টেশন করতে হয়েছে ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে। সেমিস্টারের শেষের দিকে একদিন বারিটো আমাদের সবাইকে নিজ নিজ কালচারের সাথে মানানসই কিছু একটা প্রেজেন্ট করতে হবে ঘোষনা করলেন। ক্লাস করতে মজা, কিন্তু হোমওয়ার্ক মানেই ঝামেলা। তারপরও কদিন খেঁটে খুঁটে কিছু একটা দাঁড় করালাম। নির্ধারিত দিনে আমরা সবাই যার যার স্লাইড নিয়ে হাজির। কে কি বানিয়েছে সেটা নিয়ে সবার মাঝেই কৌতূহল। প্রথমে এক চায়নিজ শুরু করল তার প্রেজেন্টেশন। শুরুতে খানিকক্ষণ সময় লাগল এটা ঠাওর করতে যে সে চায়নীজ বলছে নাকি ইংরেজি। তার ইংরেজি শুনে সত্যি বলতে আমার কান্না পাচ্ছিল। অনেক কষ্টে একসময় বুঝতে পারলাম, সে 'মাটির পুষ্টি' বিষয়ক কিছু একটা প্রেজেন্ট করছে। এমনিতেই যে ইংরেজির বাহার, তার ওপর সবাই আশা করছিলাম চায়নিজ কালচারের কোন একটা কিছু তার কাছে শুনব, তাই প্রথমে বুঝতেই পারিনি সে আসলে কি বলতে চাচ্ছে। প্রেজেন্টেশন শেষে সে বারিটোর কাছে একটা ঝারি খেল কেন এই টপিক বেছে নিয়েছে সেজন্য। আমাদেরও একই প্রশ্ন। আমরা সবাই আমাদের নিজেদের কালচারের ওপর প্রেজেন্টেশন নিয়ে এসেছি। সে কেন ‘মাটির পুষ্টি’ নিয়ে প্রেজেন্টেশন বানিয়েছে এটা আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না। বাসায় এসে খাবার টেবিলে খেতে বসে যখন মুনিরকে এ গল্প বলছি, তখন মুনির জিজ্ঞাসা করল, মাটি থেকে বেশি পানি-টানি শুষে নেয় এই টাইপ গাছের উদাহরণ ছিল স্লাইডে? আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, হ্যাঁ। বিস্ময়ের কারণ, মুনিরের এই জিনিস কোনভাবেই জানার কথা না। সে গত সেমিস্টারেই কোর্সটি করে ফেলেছে, এবার সে এই কোর্সে নেই। মুনির বলতে লাগল, এটা নির্ঘাৎ চোথা। গত সেমিস্টারে আমাদের সাথেও এক চায়নিজ ছাত্র একই কাজ করে। আমি সিওর- এটা সেই চোথা। এ পর্যায়ে আমি নির্বাক।
দ্বিতীয় যে চায়নিজ ছেলেটা প্রেজেন্টশন করল, তার টপিকটা অবশ্য বেশ মজার। সে আমাদের চায়নিজ বর্ণমালা সম্বন্ধে ধারণা দিল। চায়নিজ বর্ণমালায় কিছু কিছু বর্ণ আছে যাদেরকে বলা হয়- 'পিক্টোগ্রাম'। এগুলো ছোট ছোট ছবির মত। যেমন, 'গাছ' বোঝাতে হলে আঁকতে হবে মূল-কান্ড বিশিষ্ট গাছের ন্যায় দেখতে একটি সিম্বল। 'বন-জঙ্গল' বোঝাতে হলে এরকম দুটো গাছ আঁকতে হবে পাশাপাশি। একটা মানুষ দু'হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে- এটা দ্বারা বোঝায় 'বড়'। 'চাঁদ' বোঝাতে ইংরেজি 'ডি' এর মত সিম্বল, আর 'বৃষ্টি' বোঝাতে তিনটি পানির ধারা। 'ছেলে' বোঝাতে মানুষের মত একটা সিম্বল, আর 'মেয়ে' বোঝাতে হলে সে সিম্বলটাকেই আরেকটু পেঁচিয়ে জটিল করে দিতে হয়। এরকম বাস্তববাদী বর্ণমালা দেখে বেশ মজাই লাগল। প্রেজেন্টেশন শেষে আমি প্রশ্ন করি- এ ধরনের সিম্বল আঁকতে তোমাদের কষ্ট হয়না? সে উত্তর দিল, এরকম একটা বা দুটো সিম্বল দিয়েই ওরা অনেক বড় বড় কথা বুঝিয়ে ফেলতে পারে, এতেই নাকি কষ্ট বরং কম হয়। আমার মনে হলে লাগল, ব্লগিংটা যদি বাংলার বদলে চায়নিজে শুরু করি তাহলে খাটনি অনেক কমে যাবে। ল্যাংগুয়েজ ক্লাসটিকে নিয়ে ব্লগ লেখার জন্য খুব বেশি সিম্বল হয়ত লাগবে না- দশটি মানুষ (ছয়টি সহজ ও চারটি জটিল মানুষের সিম্বল), একটি বুড়ি (মহা জটিল সিম্বল), বড় একটি ক্লাসরুম (বড় বোঝাতে প্রসারিত হাত মানুষ সিম্বল ও ক্লাসরুমের জন্য আমার ধারণা এখানে একটা বিল্ডিং আঁকলেই হবে)- ব্যস শেষ।
আমাদের মধ্যে প্রথমে তনিমা গেল প্রেজেন্ট করতে। তার টপিক- 'জামদানি শাড়ি'। শাড়ির প্রতি দেখলাম চায়নিজ মেয়েদের দারুন আগ্রহ। প্রেজেন্টেশনের পরতে পরতে প্রশ্ন। এটা কি করে পরে? এর দাম কত? এরকম একটা শাড়ি কতদিন লাগে বানাতে? আমাদের এনে দিতে পারবে?- এরকম হাজারো প্রশ্নবাণে মেয়েগুলি তনিমাকে জর্জরিত করে ফেলল। আমি মনে মনে বললাম, হে চীনদেশীয় মেয়েসকল, তোমরা যতই শাড়ি পরিধান কর, বাঙ্গালি নারীর সৌন্দর্য্য কোনদিনও অর্জন করতে পাবেনা। তোমাদের কাজ হাফপ্যান্ট পরে অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণজয় করা- তোমরা সেই কাজেই যথাযথ মনোনিবেশ কর। তনিমার এই প্রেজেন্টেশনে আমিও অনেক কিছু শিখলাম। জামদানী শাড়ির নাম হাজার বার শুনলেও আগে কখনও চিন্তা করে দেখিনি এর মাঝে এত বিশেষত্ব থাকতে পারে। আমার ধারণা মেয়েদেরকে যে কোন শাড়িতেই সুন্দর দেখায়, শাড়ির টাইপের সাথে সৌন্দর্য্য কম-বেশি হয় কিনা এটা এখন একটা পর্যবেক্ষণের বিষয়। কিন্তু এই মার্কিন মূল্লুকে জামদানী শাড়ি পরিহিতা রমণী আমি কোথায় পাই? আনমনে কারো কথা মনে পড়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিতেই নিজেকে নিজেই ঝারি দিলাম, ক্লাসে মনযোগ দাও।
তনিমার পর এনামুলের পালা। বাংলাদেশের অকল্পনীয় সুন্দর ও রোমান্টিক প্রাকৃতিক বেলাভূমি কক্সবাজারকে সে অকল্পনীয় সাদামাটা ও সহজাত আন-রোমান্টিক ভঙ্গিতে প্রেজেন্ট করল। আমি আশা করেছিলাম কক্সবাজারের সুন্দর সুন্দর অনেক ছবি থাকবে প্রেজেন্টেশনে। কিন্তু দেখা গেল বেশিরভাগ স্লাইডই টেক্সট দিয়ে ভরা। শুধুমাত্র শেষ স্লাইডটিতে সমূদ্র সৈকতের একটি ছবি, তাও আবার ঝাপসা। আরেকটু হতাশ হলাম কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন্স, ছেড়াদ্বীপ এসবের উল্লেখ থাকলেও, কোন ছবি নেই। প্রেজেন্টেশন চলাকালে সে অবশ্য আকারে-ইঙ্গিতে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিল কক্সবাজারের সাথে কুয়াকাটা বা সেন্টমার্টিন্সের পার্থক্য- কুয়াকাটায় পানিতেই সূর্য উঠে কিভাবে পানিতেই অস্ত যায়, কক্সবাজারে সূর্য না উঠেই কিভাবে শুধু অস্ত যায়, সেন্টমার্টিন্সে কেন কোন ডাইরেক্ট বাস নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই গিয়েছি, তাই আমি বুঝতে পারছিলাম সে কী বোঝাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা বাংলাদেশের নামই শোনেনি তাদেরকে শুধু তথ্য আর টেক্সট দিয়ে এসব বোঝানো কঠিন। আমার ধারণা, আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য কিংবা আমাদের সংস্কৃতির বিষয়াদি নিয়ে অনলাইনে তেমন ভালো আর্কাইভ নেই যেখান থেকে কোন একজন এ সম্বন্ধে জানতে পারবে বা অন্যকে জানাতে পারবে। এনামুলের প্রেজেন্টেশন এই সত্যটাকেই আমার সামনে তুলে ধরল।
চায়নিজ মেয়ে লু-য়ের পালা। ছিমছাম সুন্দর একটি মেয়ে। তিনজন চায়নিজ মেয়ের মাঝে একে নিয়েই যা একটু আগ্রহ ছিল, প্রেজেন্টেশনের বিষয় দেখার পর সেটা এক মূহুর্তে গায়েব। তার প্রেজেন্টেশনের বিষয় ‘চায়নিজ বিয়ে’। লু- তার নিজের বিয়ের সব ছবি দিয়ে সুন্দর করে প্রেজেন্টেশনটি সাজিয়েছে। এখানকার চায়নিজ স্টুডেন্টদের লাইফস্টাইল দেখে আমার ধারণা হয়েছিল এদের কালচারে বোধহয় বিয়ে বিষয়টি নেই। আমাকে ভুল প্রমাণ করে সে চায়নিজ কালচারের বিয়ের সবগুলি ধাপ একটা একটা করে বর্ণনা করল। বিয়ে শুরু হবে কোন একদিন সকালবেলা কনের বাড়িতে বরের আগমনের মাধ্যমে। কনে এবং তার সখীরা দরজা খুলবেনা, যতক্ষণ না পর্যন্ত বর ও তার সাথীরা বিভিন্ন বিষয়ে প্রমিস করে। এরপর দরজা খোলার পর বর-কনে মিলে বয়জৈষ্ঠ্যদের আশীর্বাদ নেবে। এই স্টেপটিতে একটা ফাঁক আছে মনে হলো। যেমন, কলেমা পড়ানো বা হিন্দুদের সাত পাক টাইপ কোন ধর্মীয় রীতির ব্যাপার আমি দেখলাম না। চায়নিজদের আসলে কোন ধর্ম-টর্ম নেই। এরা যা ইচ্ছা কিছু একটাকে নিয়ম বানিয়ে ফলো করছে বলে মনে হলো। বিয়ের রাতে বর ও কনের পরিবারের যৌথ উদ্যোগে বিশাল একটা খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়। গিফটের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। অতিথিরা যার যা সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু টাকা (ইয়েন) একটা লাল কাপড়ে মুড়ে বর বা কনের হাতে দিয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে বাচ্চা-বুড়োদের বিদেয় দিয়ে, শুধু বন্ধু বা পড়শিরা, বর ও কনেকে ঘিরে ধরে। এরপর ট্রুথ অর ডেয়ার টাইপ একটা খেলা খেলা হয়। সবাই সন্তুষ্ট হয়ে বিদেয় হলেই কেবল বর ও কনে একটু একা হতে পারে। এরপর হ্যাপিস-এন্ডিংস।
বাকিদের প্রেজেন্টেশন নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। ইন্ডিয়ান ছেলেটা বসন্ত উৎসব নিয়ে প্রেজেন্ট করল। এটা মনে হলো আমাদের দেশের পহেলা ফাল্গুনেরই ইন্ডিয়ান সংস্করণ। চায়নিজ মেয়ে লিউ প্রেজেন্ট করল চায়নীজ একটি রেসিপি। যা তৈরি হলো শেষ পর্যন্ত সেটার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসটা একটা অখাদ্য। চায়নিজ রান্নার সাথে আমি সামান্য পরিচিত। ডায়নিং হল বন্ধ থাকায় আমার তাইওয়ানের বন্ধু চি-হাউ একবার বেশ বিপদে পড়ে যায়। সে ডর্মে থাকে এবং ডায়নিং রুমে খাওয়া দাওয়া করে। সেমিস্টার ব্রেকে ডায়নিং বন্ধ থাকায় তার খাওয়া দাওয়ার সমস্যা। আমেরিকায় যে কোন জায়গায় লাঞ্চ বা ডিনার করতে গেলে ১০ ডলারের কমে ভালো কিছু পাওয়া যায়না। তার ওপর এসব খাবার পর পর দুদিন কারো ভালো লাগার কথা না। আমি একবার তার ডর্মে বেড়াতে গিয়ে এই সংবাদ শুনলাম। প্রস্তাব করলাম চলো আজকে তোমাকে রান্না করে খাওয়াই। সে রাজি। আমাকে সে নিচের কমন কিচেন দেখিয়ে দিল। আমি ম্যাকগাইভার স্টাইলে রান্নাঘরের ভেতরে চারপাশে তাকিয়ে কি দিয়ে কি রান্না করা যায় চিন্তা শুরু করে দিলাম। ফ্রিজে আছে আস্ত ব্রকলি (ফুলকপি টাইপ সবুজ সবজি) আর ডিম। কোন মসলা নেই। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম তোমরা রান্না কর কি দিয়ে? সে যা বলল তাতে বুঝলাম, রান্না শব্দের অর্থ পানি দিয়ে কোন কিছু সিদ্ধ করা। কোন কিছু যদি সস আর তেল দিয়ে ভাজি করা হয়, তবে তা হচ্ছে অমৃত। আমি বললাম, আমার মসলা চাই। সে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অন্য একজনের কাবার্ড থেকে কিছু মসলা জোগাড় করল। তখন আমেরিকায় আসার মাত্র মাস তিনেক হয়েছে। রান্নার মধ্যে পারতাম শুধু মুরগি আর ডাল। চিন্তা করে দেখলাম মুরগির রেসিপি দিয়েই কাজ হয়ে যাবার কথা। মসলা মাখিয়ে, তেল-পেয়াজ দিয়ে ভেজে, পানি দিয়ে বসিয়ে দিলেই শেষ। শুধু মুরগির জায়গায় থাকবে ব্রকলি- এইটুকুই পার্থক্য। কাজ শুরু করে মাঝপথে আবিষ্কার করলাম- পেঁয়াজ নেই। আমি পেঁয়াজ চাইলে সে বলে, সেটা আবার কী? আমি চিন্তায় পড়লাম, পেঁয়াজ এখন আমি একে কিভাবে চেনাই। আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর পর সে বলল, ওহ, তুমি গারলিকের কথা বলছ? ওটার একটা সস আছে আমার কাছে। গারলিক হচ্ছে রসূন। তাইওয়ানের সব রান্না নাকি রসূন দিয়ে করা হয়। ওরা পেঁয়াজ ব্যবহার করেনা। আমাকে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি দিয়ে রান্না কর? পেঁয়াজ নাকি রসূন? আমি বললাম, সব। বাংলাদেশি তরকারিতে ব্যবহার হয়না এরকম কোন কিছু এখনো আবিষ্কার হয়নি। শুধু অ্যালকোহলের ব্যবহার আমাদের ধর্মে নিষেধ। আমি তাকে আমাদের দেশীয় পদ্ধতিতে সিদ্দিকা কবীরস রেসিপি প্রোগ্রামের মত করে প্রতিটি স্টেপ দেখিয়ে রিয়েল লাইফ লেসন দিয়ে দিলাম কি করে যে কোন কিছু রান্না করা যেতে পারে। আমার প্রেজেন্টেশনে সে মুগ্ধ। রান্না শেষে আমি সেই তরকারি এক চামচ খেয়ে বিব্রত হলেও চি-হাউ সেটার স্বাদ ও গন্ধে মুগ্ধ। খাওয়া শেষে আমাদের দেশীয় রান্নাবান্না নিয়ে তার চরম আগ্রহ দেখে বুঝলাম, আমি এযাত্রায় ভালোভাবে পাশ। মিস বারিটোর ক্লাসে মিস লিউ-কে আমি মনে মনে ফেইল মার্কস দিলেও অনেকেই দেখলাম প্রেজেন্টেশন শেষে তার ইমেইল অ্যাড্রেস চাইছে রেসিপিটা পাবার জন্য। রেসিপি কিংবা মিস লিউ- কারো প্রতিই বিন্দুমাত্র আকর্ষণ না থাকায় আমি আর সেটাতে আগ্রহ দেখালাম না। (বাকীটুকু একটু বাকি)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০০৯ দুপুর ১:০৭