আমেরিকানদের সবার উচ্চারণও যে খুব শ্রুতিমধুর তা নয়। দু-একজন আছে যাদের কথা শুনলে মনে হয় ইচ্ছে করেই তারা আমাদের সাথে এমন ভাবে কথা বলে যেন বুঝতে গিয়ে আমাদেরকে বেশ বেগ পেতে হয়। এখন আমরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বিধায় কোন সমস্যা হয়না, তবে খুব শুরুর দিকে এদের কথা শুনে মনে হত ক্যাসেট প্লেয়ারের ফিতে বেশ জোরে ফরওয়ার্ড করলে যে এক ধরনের নয়েজ হয়, অমন করে কিছু বলছে। তখন ওরা অনেকক্ষণ কথা বলার পর কিছু জিজ্ঞাসা করলে আমরা শুধু তাকিয়ে থেকে হাসতাম, আর 'ইয়া, হুমম, ইয়েস, ওওও, আহা, নাইস'- এসব উত্তর দিতাম যেটার মানে হ্যাঁ-না সবকিছুই হতে পারে। কেউ কিছু বলছে, যেটা আমার বোঝার কথা অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না- এটা যে কি দুঃসহ একটা পরিস্থিতি সেটা এই পরিস্থিতিতে না পড়লে বোঝা অসম্ভব। কেউ যদি মনে করে থাকে যে, সে ইংরেজিতে অনেক বেশি স্মার্ট- ঢাকার বড় বড় ফাস্ট ফুডের দোকানে খুব ভাব নিয়ে ইংরেজিতে অর্ডার করেছি কত্ত, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তো ইংলিশ ছাড়া আমি কঠাই বলিনা, হাফপ্যান্ট পড়েই তো আমি শপিংয়ে বেরোই সবসময়, মেটাল-রক-গোথিক এসব আমার লাইফ-- এখানকার আসল আমেরিকান লাইফ দেখলে তাদের সব লাফালাফি একবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রয়োগের অভাবে হয়ত আমাদের দেশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে একটু 'কাঁচা' হয়ে থাকে, কিন্তু যাদের মাঝে 'আঁটি'ই নেই তাদের এসব ভাব নেয়া যে কত্ত বিশাল গাধামি সেটা তারা বুঝলে আমাদের দেশের তারুণ্য আজ অনেক সুন্দর হত।
নেটিভদের মাঝে আরেক প্রজাতি হচ্ছে- 'কালো'। আমেরিকায় 'ব্ল্যাক' বা 'নিগ্রো' এধরণের শব্দ উচ্চারণ করা আইনত নিষিদ্ধ। এ যুগে হয়ত সাদা-কালো বিভেদ স্পষ্টভাবে কোথাও নেই, তবে কালচারে এ-দুজাতের বিশাল পার্থক্য। ভাষার ক্ষেত্রেও উচ্চারণেও আছে অনেক তফাৎ। এরা আধো কথা মুখে রাখে আর আধো কথা উচ্চারণ করে। আমি খেয়াল করে দেখেছি এরা প্রতিটি শব্দের ঠিক অর্ধেকটুকু উচ্চারণ করে এবং বাকি অর্ধেক উহ্য রাখে। ইউভিএ-তে কালো স্টুডেন্টদের সংখ্যা অনেক কম। এখানে কালোরা মূলত শ্রমজীবি বা বলা যায় শ্রমজীবিরা মূলত কালো। দোকান-পাট, কন্সট্রাকশনের কাজ, সিটিবাস, ক্লিনিং, মেইনটেনেন্স- এসব কাজেই আমি প্রধানত কালোদের দেখেছি। এদের 'আধো কথা' না বুঝলে যদি বলি- 'সরি, আমি বুঝতে পারিনি, আবার বলবেন?', সে ক্ষেত্রে ওরা আবার বলবে, যতবার বলি ততবার বলবে, কিন্তু তাও একবারও সুন্দর করে বলবে না। 'সৌন্দর্য্য' বিষয়টি এদের বেশিরভাগের মাঝেই অনুপস্থিত। দীর্ঘদিন শেতাংগদের অন্যায়ের সাথে লড়াই করে কোনমতে টিকে থাকতে থাকতে এদের অনেকের মাঝেই বোধহয় সৌন্দয্য, কোমলতা এসব জিনিস বিকশিত হতে পারেনি।
প্রতি মূহুর্তে এসব হরেকদেশের হরেকরকম ইংরেজি শুনে-বুঝে-কথা বলে- ক্লান্ত হয়ে যখন এনামুল-তনিমা-মুনির অথবা তানিয়া আপার ডেস্কে গিয়ে দু-বাক্য বাংলা বলতে পারি তখন মনে হয় প্রাণে বুঝি একটু স্বস্তি এসেছে।
ইংরেজি ক্লাসে আমাদের অনেক বিচিত্র বিচিত্র কাজ করতে হচ্ছে। কিছু আছে খুব বাচ্চাদের কাজ আবার কিছু আছে সত্যিই বেশ দরকারি। মজার মজার অনেক কিছুও এসময় জানা যায়। যেমনঃ উচ্চারণে পার্থক্যের কারণে যে অর্থ কত বদলে যেতে পারে সেটার উদাহরণ হিসেবে মিস বারিটো একদিন চায়নীজ ভাষায় 'মা' শব্দটির কথা বললেন। চায়নিজ ভাষায় 'মা' কথাটির অর্থ নাকি 'মা', 'দড়ি', 'অভিশাপ' কিংবা 'ঘোড়া' যে কোন কিছু হতে পারে। বারিটোর অনুরোধে একজন চায়নিজ ছাত্র একদিন চারটি উচ্চারণই আমাদেরকে করে শোনায়। আমরা কেউ প্রথম তিনটিতে কোন পার্থক্য বুঝলাম না, কেবল 'ঘোড়া' বোঝানোর সময় ঘোড়ার ডাকের মত করে কাঁপা গলায় 'মা--' উচ্চারণ করাতে আমরা সেটা বুঝতে পারলাম। বুয়েটের হিসেবে এই ছেলের নাম এখন থেকে 'ঘোড়া' হয়ে যাবার কথা। কিন্তু এখনও কেন হয়নি সেটা বুঝে উঠতে পারছিনা।
দরকারি জিনিসে আমার আগ্রহ কম হওয়া সত্ত্বেও আমি বেশ কিছু ভালো জিনিস শিখেছি এই কোর্সে। যেমনঃ লেখায় রেফারেন্স যুক্ত করার যে এত স্ট্যান্ডার্ড থাকতে পারে তা আমার জানা ছিলনা। অনেক সময় বইতে কোন থিওরাম কিংবা কাজের কথা উল্লেখ করতে লেখকের নাম ও নামের পাশে একটা সন ব্রাকেটের ভেতরে লেখা থাকে, যেমনঃ (নিউটন ১৬৬৬)। আমি এতদিন এটাকে লেখকের জন্মসাল ভাবতাম। এই ক্লাসে এসে জানতে পারি যে এটা আসলে কত সালে লেখাটি ছাপা হয় সেটা বুঝাচ্ছে। এছাড়াও এক ক্লাসে আমাদেরকে শেখানো হলো অনলাইনে কি করে ইউভিএ'র লাইব্রেরি থেকে বই, জার্নাল, থিসিস ইত্যাদি সার্চ করে ইস্যু করা যায়। এসব আমরা আগে থেকে জানলেও নতুন জানতে পারলাম ইউভিএ লাইব্রেরির স্পেশাল রাইটস এর কথা, যার বদৌলতে বিশ্বের যে কোন লাইব্রেরি বা জার্নাল থেকে আমি বই, আর্টিকেল ইত্যাদি ইস্যু করতে পারি এবং ইউভিএ কতৃপক্ষ সেটার সফট কপি তিনদিনের মাঝে এবং যে কোন হার্ডকপি দু-সপ্তাহের মধ্য এনে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ কথা বাসায় এসে মুনিরকে শোনানো মাত্র মুনির বলতে থাকে- 'হায় হায়, তাইলে তো আমরা হুমায়ূন আহমেদের সব নতুন বই অর্ডার দিতে পারি এখন থেকে! বইমেলাতে বই বের হলেই সাথে সাথে আমরা দিব অর্ডার।' আমি অবশ্য এ ব্যাপারে তাকে কোন আশ্বাস দিতে পারলাম না। চিন্তায় পড়ে গেলাম, আমি কি 'বিশ্বের যে কোন লাইব্রেরি' শুনেছি নাকি 'আমেরিকার যে কোন লাইব্রেরি' শুনেছি। তখন মনে হলো আমার এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র স্বর্ণকেশী, বাকপটু, অমায়িক, প্রতিভাময়ী, কো-অর্ডিনেটর অফ ব্রাউন লাইব্রেরি ক্যাথরিন-ডি-স্যুলেই সঠিকভাবে দিতে পারবে। ইস, মানুষ কার্ড দিলে সেটা সাথে সাথে ফেলে দেবার অভ্যাসটা যে কেন করেছি!
ইংরেজিতে কথাবলার পাশাপাশি প্রফেশনাল লাইফে আরেকটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো প্রেজেন্টেশন। বুয়েটে পড়ার সময় আট সেমিস্টার মিলিয়ে বড় জোর দু-তিনটি প্রেজেন্টেশন করতে হয়েছে। আমরা এটাকে খুবই অপছন্দ করতাম এবং সেসব স্যাররা প্রেজেন্টেশনের কথা বলতেন তাদেরকে আমরা অহেতুক ঝামেলা সৃষ্টিকারী টিচার মনে করতাম। এখানে এসে যেটা দেখি চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সব প্রফেসরই খুব সিরিয়াসলি জিনিসটাকে দেখেন এবং আমাদেরকে উৎসাহ দেন আরও সুন্দর করে প্রেজেন্ট করার প্রতি। আমাদের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট মিস ম্যারি একবার খুব সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন। তার ভাষ্য মতে, একজন রিসার্চারের নিজস্ব রিসার্চের বিষয়ের ওপর চার রকমের স্পীচ সবসময় তৈরি রাখতে হবেঃ দুই-মিনিট স্পীচ, পাঁচ-মিনিট স্পীচ, পনের-মিনিট স্পীচ ও এক ঘন্টার স্পীচ। দুই-মিনিটের স্পীচ হচ্ছে 'এলিভেটর স্পীচ', অর্থাৎ আপনি কারো সাথে লিফটে করে যাচ্ছেন এবং সে জিজ্ঞাসা করল- 'ভাই, আপনি কি নিয়ে কাজ করেন?'। তখন তাকে দিতে হবে দু-মিনিটের একটি এলিভেটর স্পীচ। পাঁচ-মিনিটের স্পীচ হচ্ছে কোন পার্টিতে যখন দুজন রিসার্চারের দেখা হবে তখন পান-পাত্রে চুমুক দিতে দিতে তাকে দিতে হবে পাঁচ-মিনিটের 'পার্টি স্পীচ'। পনের মিনিটের 'কনফারেন্স স্পীচ' হচ্ছে নিজের গবেষণা পত্র কোন কনফারেন্সে উপস্থাপনের জন্য। আর এক ঘন্টার স্পীচ হচ্ছে পিএইচডি ছাত্রদের জন্য ভয়াবহ 'ডিফেন্স স্পীচ' যেটার পাস-ফেলের ওপরই আপনার সবকিছু নির্ভর করছে। (আরেকটু বাকি)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১২:৩৬