ইনসাফ বারাকাহ কিডনী এন্ড জেনারেল হাসপাতালের ডায়ালাইসিস সেকশনের সামনে বিছিয়ে রাখা প্লাস্টিকের একটা চেয়ারে আইরিন অনেকক্ষণ ধরেই চুপ করে বসে আছে। সম্ভবত আরো আধা ঘণ্টা বসে থাকতে হবে। আইরিন এসেছে ওর শ্বাশুড়ি’কে কিডনী ডায়ালাইসসিস করানো জন্য। প্রতি সপ্তাহে দুইবার করে উনাকে এই ডায়ালাইসিস করাতে হয়। যেদিন করানোর কথা, সেটার হেরফের হয়ে গেলেই ওর শ্বাশুড়ির শারীরিক অবস্থার মারাত্মক খারাপ হয়ে যায়। গতকাল’কে অফিসের কাজের চাপের জন্য কোনভাবেই ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি আইরিন। সন্ধ্যাবেলা থেকেই উনার অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হওয়া শুরু করে দিল। আজকে সকালে কোনরকমে অসুস্থ শ্বাশুড়ি’কে এখানে নিয়ে এসেছে ও। বেশি দেরি হয়ে গেলে একা আইরিন আনতেও পারতো না। মাসের একদম শেষের দিক এখন। উনি বেশি অসুস্থ হয়ে পরলে হাসপাতালে এক বা দুই দিন রাখতে হয়, আগেও হয়েছে। সেই খরচ অনেক ব্যয়বহুল ওর জন্য। এই মাসের বেতনের টাকা হাতে না পেলে সামনের সপ্তাহে ডায়ালাইসসিস করতে আসার সময়ে হয়তো কারো কাছে লোন করতেও হতে পারে। বড় করে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আইরিন। কিভাবে কিভাবে দুঃখকষ্টেই কেটে গেল এই জীবন। সহসাই জীবনের পিছনে ফেলে আসা দিনগুলিতে নিমিষেই হারিয়ে গেল আইরিন……
প্রায় দৌড়ে এসেই নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো আইরিন। ওর শ্বাশুড়ির হইচই এখনও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
-পড়ালেখা করেছিল? পড়ালেখা করে যেন আমাদের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলবে? কত বার বললাম সংসারের কাজ মনোযোগ দিতে! তা না, সারাদিন উড়ু উড়ু মন। সংসারের কাজে কোন আগ্রহই নেই। একটা কাজও মনোযোগ দিয়ে ঠিকঠাক মতো করে না।
মন খারাপ করে নিজের বিছানায় চুপ করে বসে আছে এখন আইরিন। ঘটনা খুবই তুচ্ছ। দুধ জ্বাল দিয়ে দেখতে বলেছিল ওকে ওর শ্বাশুড়ি। সামনের সপ্তাহ থেকে ওর এইচ.এস.সি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। রান্নাঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনা করছিল ও। একটা বাংলা রচনা ভালোভাবে পড়তে যেয়ে রান্নাঘরে ফিরে যেতে দেরি করে ফেলেছিল। যেয়ে দেখে অল্প কিছু দুধ ডেকচি উপচিয়ে পরেছে। সেটা নিয়েই এত হইচই শুরু করে দিয়েছে!
কিছুক্ষণ পরে আইরিনের শ্বশুর ওকে ডেকে নিয়ে গেল।
-এত পড়াশুনা করে কি হবে বলো তো মা? আমরা তো তোমাকে কোনদিনও চাকুরী করতে দেবো না। অযথাই পণ্ডশ্রম করছো না তো? কি লাভ এইসব করে?
-বাবা, এইচ.এস.সি পরীক্ষাটা পাশ করে নেই শুধু, এরপরই ছেড়ে দেব। দুইবছর এত কষ্ট করে পড়লাম, মাত্র এই অল্প কয়েকদিনের জন্য বাদ দিতে ইচ্ছে করছে না।
-শুধু শুধুই সংসারে অশান্তি লাগাচ্ছ, তোমার শ্বাশুড়ি তো তোমার লেখাপড়ার কথা শুনলেই ক্ষেপে যায়। এই পরীক্ষার কথা শুনলে আরো বেশি খেপে যাবে।
ঝট করে মুখ তুলে শ্বশুরের দিকে তাকিয়েও মুখ নামিয়ে ফেললো আইরিন। ওর শ্বাশুড়ি তো ক্ষেপবেনই! নিজে এইট পাশ। একমাত্র ছেলের বৌ যদি এইচ.এস.সি পাশ হয় সেটা উনার সহ্য হবে কিভাবে? মুখ বুজে সবকিছুই সহ্য করে নিল আইরিন। এই পরীক্ষা ওর দিতেই হবে। শ্বাশুড়ি বেশ ক্ষেপে গেলে শেষমেশ পরীক্ষাটাই দেয়া হবে না।
রাতের বেলা আইরিনের জামাই আবিদ বাসায় ফিরলে মন খারাপ করে সবকিছু খুলে বললো আইরিন। ওর জামাইও নিরুপায়। একমাত্র ছেলে। এইসময়ে বাবা মা’কে অন্যকারো বাসায় যেয়ে রেখে আসবে সেই উপায়ও নেই। একসাথে সবরকমের বিপদ এসে হাজির হয়েছে সংসারে। আইরিনের পেটে প্রথম বাচ্চা এসেছে। এইসময়ে বেশি কাজকর্ম করতে ডাক্তার এমনিতেই মানা করে দিয়েছে, ওর মা সেটা জানা পরেও কেন এইসব আচরণ করছে সেটা আবিদ ভালো করেই বুঝতে পারলো। আইরিন’কে হাত ধরে আশ্বস্ত করে বললোঃ
-এত টেনশন করো না। আমি যতদিন আছি ততদিন তোমার লেখাপড়া বন্ধ হবে না। কালকে সকালবেলা অফিসে যাবার আগে বাবা মা’র সাথে আমি অবশ্যই কথা বলে যাবো।
আবিদ পরেরদিন কী কথা বলেছিল সেটা আইরিন পুরোপুরি জানতে পারেনি, কিন্তু এইচ.এস.সি পরীক্ষার আগে তেমন আর কোন ঝামেলা হলো না। ন্যাশনাল ভার্সিটির আন্ডারে বি.এ এবং এম.এ পরীক্ষাগুলিও শ্বশুরবাড়ির সবার অজান্তেই পাশ করেছিল আইরিন। আবিদ কিভাবে কিভাবে যেন সবকিছু গোপনে ম্যানেজ করে দিত। আবিদ না চাইলে আইরিনের পক্ষে কোনদিনও লেখাপড়া এত দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।
এই পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতাগুলির মাঝে একটি নির্মম বাস্তবতা হলো, যখন কেউ সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে যেয়ে পৌছায় আর তখনই তার প্রিয় মানুষটি হারিয়ে যায়। চাকুরী করতেই হবে এমন ইচ্ছে আইরিনের খুব বেশি ছিল না। কিন্তু হুট করেই আবিদ ওকে একদম একা ফেলে দিয়ে এই পৃথিবী থেকে চলে যাবে সেটা ও কখনই কল্পনাও করতে পারে নি। আবিদের অফিস থেকে যখন ফোন করে এই দুঃসংবাদটা ওকে দিল, প্রথমে বিশ্বাসও করতে পারেনি আইরিন।
আবিদের বয়স তখন ছিল মাত্র বেয়াল্লিশ।
এত অল্প বয়সে এভাবে আবিদ চলে যাবে সেটা কে জানতো?
আইরিন ততদিনে দুই বাচ্চার মা হয়ে গেছে। মাস্টার’স পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে পেয়েছে আইরিন মাত্র চারমাস হলো।
আবিদ নিজের বৌ’কে দেয়া কথা ঠিকই রেখেছিল।
আইরিন’কে ঠিকই শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়ে দিয়ে গেছে।
শ্বশুর সাহেবের চাকুরীও একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছিল। বেসরকারী চাকুরী, অবসরে চলে গেলে আর কোন অর্থনৈতিক সুবিধাও নেই। নিজের এবং বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিঃসীম অকূল পাথারে পরে গেল আইরিন।
যেভাবেই হোক অন্ততঃ বেচে থাকার জন্য হলেও আইরিন’কে কিছু একটা এখন করতেই হবে।
দুইটা বাচ্চার জন্য হলেও কোনভাবেই জীবনের হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না।
কয়েক মাসের মধ্যেই অনেক চেষ্টা তদ্বির করে একটা বেসরকারী স্কুলের চাকুরী যোগাড় করলো আইরিন। যেই শ্বশুর কোনদিনও চাকুরী করতে দেবেন না বলেছিলেন, তিনিই এই চাকুরী পাইয়ে দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দৌড়াদৌড়ি করলেন। উনি নিজেও বেশ উৎকন্ঠায় ছিলেন। আইরিনের চাকুরী পাবার পর উনিই মনে হলো সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছেন।
সারা আকাশ জুড়ে মেঘ জমলেও আবার তা ঠিকই সরে যায়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের জীবনের আকাশ সবসময় ঘন কালো মেঘেই অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। মাত্র দুইবছর পরেই আইরিনের শ্বশুরও ওদের সবাইকে ফেলে না ফেরার দেশে ছেলের কাছে চলে গেলেন। না চাইতেও পুরো সংসার চালিয়ে নেবার সব দায় দায়িত্ব এসে আইরিনের কাঁধে পরলো। বিরাট বড় ভার কিন্তু এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই আইরিনের।
অসহায় শ্বাশুড়ি নিজের সব দ্বিধা সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আইরিনের কাছে নিজেকে সমার্পণ করলেন। নিজের ছেলে এবং স্বামী এভাবে ফাঁকি দিয়ে এক এক করে যে চলে যাবে সেটা উনি কোনদিনও কল্পনাও করেন নি। সৃষ্টিকর্তার কী আজব লীলা খেলা? যেই শ্বাশুড়ি চাকুরী তো দূরের কথা আইরিনের লেখাপড়া করাই পছন্দ করতো না, তিনিই সংসারের রান্না থেকে শুরু করে সবকিছু দেখাশুনা শুরু করলেন যেন আইরিন শান্তিমতো চাকুরী করতে পারে। বুকের ভিতরে অবাক বিষ্ময় নিয়ে চারপাশের সবকিছু বদলে যাওয়াটা শুধু দেখেই গেল আইরিন।
প্রতিটা মানুষেরই বুকের ভিতরে নানা রকম ইচ্ছের রঙ বেরঙয়ের ফুল ফোটে। জীবনকে নিজের মতো করে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার অভিলাষ হয়। কিন্তু আইরিনের জীবন যত বাড়তে থাকে আর স্বপ্নের ফানুশগুলি ততই চুপসে যেতে থাকে সংসার, ছেলেমেয়ে এবং পারিপার্শ্বিকতার চাপে। ইচ্ছের স্বপ্নগুলো বুকের ভিতরে দানা বেঁধে উঠার আগেই হারিয়ে যায় অনিশ্চিত অধরায়, স্পর্শের বাইরে, ধরার চেষ্টার আগেই হাত ফসকিয়ে চলে যায় দূরে বহু দূরে। হৃদয়ের মাঝে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ক্রমাগত বয়ে যায় অতৃপ্ততার ঢেউ, বেদনার নিরন্তর রোদন, দুঃখের অবিনাষী দহন আর না পাওয়ার জ্বলন-পোড়ন। নিজের অজান্তেই হারিয়ে যায় জীবনের সব চাওয়া না পাওয়ার আনন্দ বেদনার মহাকাব্য।
শ্বশুর চলে যাবার পর বিগত সাতটা বছর ধরে কলুর বলদের মতোই সংসারের ঘাণি টেনে গেছে আইরিন। ছেলেমেয়ে, শ্বাশুড়ি সবার ভালোমন্দ খেয়াল রাখতে যেয়ে নিজের খেয়াল রাখতেও ভুলে গেছে ও। বুকের মাঝে আগলে রাখা হাজারো অব্যক্ত কথা আর চাপা কষ্টগুলি কারো কাছে বলার মতো মানুষটাও আজ আইরিনের পাশে নেই, স্বার্থপরের মতো ওকে একা ফেলে রেখে চলে গেছে বহুদিন আগেই।
দুঃখ নামের স্টেশনেই থেমে গেছে জীবন গাড়ী,
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সব সুখেরই বাড়ী,
সৃষ্টিকর্তার কলমে বুঝি শেষ হয়েছে কালি
সুখের জায়গা পরেই আছে সবটুকুটাই খালি!
কাঁধে কে যেন হাত রাখতেই সহসাই আবার আইরিন বাস্তবে ফিরে এলো। ডায়ালাইসিস সেন্টারের ভিতর থেকে একজন নার্স বের হয়ে ওকে ডাকতে এসেছে। আইরিনের শ্বাশুড়ির ডায়ালাইসিস আজকের মতো শেষ হয়েছে। রুগীকে এখন বাসায় নিয়ে যেতে পারবে। বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফলে চেয়ার থেকে উঠে এলো আইরিন। ডায়ালাইসিস শেষ হলে রুগী বেশ দুর্বল হয়ে যায়, নিজে থেকে উঠে দাঁড়াতেও পারবে না ওর শ্বাশুড়ি। ধরে ধরে এখন বাসায় নিয়ে যেতে হবে।
পিছে ফেলে আসা দিনগুলির কথা স্মরণ করলে আজো অনেক কথাই আইরিনের মনে পড়ে যায়। আজ আইরিনের বেতনের টাকায় পুরো সংসার চলছে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চলছে, অসুস্থ শ্বাশুড়ির চিকিৎসা পর্যন্ত ওর টাকাতেই হচ্ছে।
আইরিনের শ্বাশুড়ি এখন মাঝে মাঝেই খুব অনুতপ্ত স্বরে ওর কাছে এসে অতীতের কার্যকলাপের কথা ভুলে যেতে বলে।
চাইলেই কি সবকিছু আসলেই ভুলে যাওয়া যায়?
মানুষের জীবনে আসলে কখন কি ঘটবে কেউই জানে না! আশাহীনতা, হাহাকার, ব্যর্থতা, বেদনা সবকিছু সময়ে সময়ে ছাপিয়ে উঠে জীবন নামের উন্মত্ত নদীটা সবকিছু প্লাবিত করে দিয়ে যায়।
গতকালকে যে বীরদর্পে হেঁটে বেড়িয়েছিল এই মর্ত্যের বুকে, আজকেই সে হয়তো হারিয়ে গেছে সময়ের নিদারুণ কালস্রোতে।
আজকে যে রাজা বাদশাহ, কালকে তার হয়তো কোন অস্তিত্বই নেই।
কিসের এত অহংকার আর দাম্ভিকতা মানুষের জীবনের?
শেষমেষ তো চিরস্থায়ী জায়গা হয় সেই সাড়ে তিন হাত মাটির নীচেই! সাথে নিজের কিছুই নিয়ে যেতে পারেও না।!
সবাই’কেই জীবনের কোন একটা মুহূর্তে এসে সময়ের দায়ভার ঠিকই পরিশোধ করে যেতে হয়।
আজ পর্যন্ত কেউই সেটা এড়িয়ে যেতে পারেনি, কেউ কখন পারবেও না।
অফটপিকঃ গল্পের থীম একটা সত্য ঘটনার উপর লেখা হয়েছে।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, অক্টোবর ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:৪৯