ব্লগে আজকাল বেশ কিছু ব্লগারদেরকে ইসলাম ধর্ম সর্ম্পকীত বিভিন্ন পোস্ট দিতে দেখি। কিন্তু এইসব পোস্টের জন্য যা অবশ্যই প্রয়োজন সেটা হলো, এইসব পোস্টে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে সমর্থন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কীত ব্যাখ্যা, মুসলিম জীবন যাপন পদ্ধতি সম্পর্কীত কিংবা যে কোন ফতোয়া বা মাসায়েল দেবার সাথে সাথেই এর সমর্থনে পবিত্র কুরআন শরীফের নির্দিস্ট আয়াত এবং সহী সনদ সহ হাদীস দেয়া জরুরী। কিন্তু এইসব পোস্টে সহী হাদীস তো দেয়াই হয় না, বরং পোস্টে যেয়ে পোস্টের সমর্থনে কোন সহী হাদীস আছে নাকি সেটা জানতে চাওয়া পরেও কোন উত্তর পাওয়া যায় না। অল্প কিছুদিন আগে একজন ব্লগার (কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাকি কোন ধর্মীয় বই প্রকাশ করবেন, আল্লাহ মাপ করুন!) সম্পূর্ণ অসত্য একটা ধর্মীয় পোস্ট দেবার পর তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, উনি নির্লজ্জের মতো সহী বুখারী শরীফ, সহী তিরমীজি শরীফে হাদীস ভুল আছে এবং তিনিই একদম ঠিক বলেছেন বলে মন্তব্য করলেন। যখন কোন হাদিস ভুল আছে সেটা জানতে চাওয়া হলো তারপর শুরু করলেন প্যাঁচানো, কোনভাবেই আর সঠিক উত্তর তিনি দিলেন না! এইব্লগার ক্রমাগত ভাবেই ব্লগে বিভিন্ন বিতর্কিত, আন্দাজে উলটাপালটা ধর্মীয় পোস্ট দিতেন। এর সাথে সাথে ব্লগে মাঝে মাঝেই অসত্য এবং ভয়ংকর সব ভুলে ভরা ধর্মীয় পোস্টও দেখা যায়। বর্তমানে বিভিন্ন মিডিয়ায় লেখা, ইন্টারনেটে কিংবা পুস্তকে অনেক অনেক মনগড়া কথা বা কাহিনী বা ব্যাখ্যা ইসলাম ধর্মের নামে চালিয়ে দেয়া হয়, যা আসলে কখনই সত্য নয় অথবা আসল/সত্য থেকে নিজেদের প্রয়োজনে কিছুটা পরিবর্তন করে নেয়া হয়েছে, যেটা পুরোপুরিই ইসলামে নিষিদ্ধ।
সবার জানা উচিত, ইসলাম ধর্মে নতুন কিছু মনগড়া প্রবেশ করা কিংবা তৈরী করা সম্পুর্ণ বিদায়াত।
ইসলামের নামে মিথ্যা হাদীস কিংবা নতুন পন্থা বের করা এবং প্রচার করা নিয়ে সর্তক হউন।
আল্লাহ পবিত্র কুরআন শরীফে ইরশাদ করেনঃ
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ন করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পন্ন করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম”। (সুরা মায়েদা, আয়াত নং ৩)
সুতরাং এরপর থেকে দ্বীনের জন্য নতুন নতুন রাস্তা খোঁজা, কিংবা পন্থা বের করা বিদায়াত ছাড়া আর কিছু নয়।
শুধুমাত্র যা আল্লাহর জন্যে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তরীকায় অনুসরন করা হয় তাই ইবাদত। যদি রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সুন্নতকে, তার প্রদর্শিত আদর্শকে বাদ দিয়ে নতুন কোন তরীকা, আকীদায় কাজ করা হয় তাকে বিদায়াত বলে। বিদায়াত মানে হল ধর্মের নামে নতুন কাজ, বেশী বুঝা, যা কিছুর প্রয়োজন নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও আল্লাহ মনে করেন নি নিজেরা সেটা আবিষ্কার করা (হতে পারে সেটা দেখতে ভাল অথবা মন্দ) এবং সেটা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামে চালিয়ে দেয়া। আর বিদায়াতের ব্যাপারে মহানবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর সতর্কতা মনে রাখুন:
وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ) رواه أبو داود والترمذى وقال حديث حسن صحيح
“তোমরা (দ্বীনের) নব প্রচলিত বিষয় সমূহ থেকে সতর্ক থাক। কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয় বিদায়াত এবং প্রত্যেক বিদায়াত ভ্রষ্টতা”।
(সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৯৯১ ও সুনান আত-তিরমিযী, হাদীসনং ২৬৭৬। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান ও সহী বলেছেন)
মহানবী রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর এক খুতবায় বলেছেন:
إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِي النَّارِ. رواه مسلم والنسائى واللفظ للنسائى
“নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহ্র কিতাব এবং সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। আর নব উদ্ভাবিত প্রত্যেক বিষয় বিদায়াত এবং প্রত্যেক বিদায়াত হলো ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম”।
(সহী মুসলিম, হাদীসনং ১৫৩৫ ও সুনান আন-নাসায়ী, হাদীসনং ১৫৬০, হাদীসের শব্দচয়ন নাসায়ী থেকে)
সুতরাং ইসলাম ধর্মীয় কোন বিষয়ে নিজের কোন চিন্তাভাবনা লিখার আগে ফতোয়া কি সেই সর্ম্পকে সুস্পষ্ট ধারনা থাকা প্রয়োজন। যে কেউ ফতোয়া দিতে পারে না। এটার অনুমতিও সবাইকে দেয়া হয়নি ইসলামে।
ফতোয়া পরিচয়ঃ
আরবি ফতোয়া শব্দটির বহুবচনিক রূপ ফাতাওয়া। অর্থ: মতামত, রায়, অভিমত, বিশেষজ্ঞ বা আইনবিদের পরামর্শ, সিদ্ধান্ত, প্রশ্নের বা সমস্যার জবাব-সমাধান ইত্যাদি। পরিভাষায় ফতোয়া হলো, সমসাময়িক মানব সমাজে উদ্ভূত নিত্য-নতুন সমস্যা সম্পর্কে সে যুগের চিন্তাশীল গবেষক আলেম কিংবা মুফতি কর্তৃক কোরআন-হাদিসের ভিত্তিতে ও পূর্বসূরী বিদগ্ধ সত্যাশ্রয়ী আলেমদের অনুসৃত নীতির আলোকে শরিয়তের বিধান বর্ণনা করা।
লক্ষণীয়, যিনি ফতোয়া দিবেন তিনি সময়ের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরিয়ার বিধান বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করবেন আর তা করবেন কোরআন-হাদিস থেকে আহরিত দলিল-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে। তাই দলিল-প্রমাণহীন কোনো মত বা ব্যাখ্যা শরিয়ার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা বিধান হতে পারে না এবং তা ফতোয়াও নয়। সেটা বক্তিগত অভিমত বলে মনে করা হবে।
ফতোয়া উৎপত্তিঃ
আল্লাহর রাসূল (সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম) তার জীবদ্দশায় ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা ছিল তার প্রতি নাযিল হওয়া নবুওয়তের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। সূরা আন-নাহল এর ৪৪নং আয়াতে এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা নবী (সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম) এর ওপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ইরশাদ করেন, ‘তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষের প্রতি যা অবতরণ করা হয়েছে তা তুমি তাদের উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দাও এবং যাতে লোকেরাও চিন্তা-ভাবনা করে।’ এ আয়াতে আরবি ‘তুবাইয়্যিনা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ ‘ব্যাখ্যা করে বুঝানো।’ বিশেষজ্ঞ আলেমরা ফতোয়াকে এ শব্দটির বিশেষ্য পদ দিয়েই সংজ্ঞায়িত করেছেন।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম) এর পর যারা ফতোয়া দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন বা ভবিষ্যতে দিবেন তারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্ব পালনে তার প্রতিনিধি। আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের তাদের কাছ থেকে জেনে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন যারা এই জ্ঞান জানেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যদি নিজেরা না জেনে থাকো তাহলে যাদের কিতাবের জ্ঞান আছে তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।’ এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হচ্ছে, যাকে জ্ঞানের অমূল্য নিয়ামতে ভূষিত করা হয়েছে তিনি তা গোপন করবেন না। অন্যদিকে যিনি আলেম নন তার জন্য ফতোয়া প্রদান কখনই বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি না জেনে ফতোয়া প্রদান করবেন, এ সংক্রান্ত পাপ তার ওপর বর্তাবে।’
দার্শনিক ইবনুল মুনজিরের ভাষায় যিনি ফতোয়া দিবেনঃ “তিনি হচ্ছেন স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সেতুবন্ধন, সুতরাং তার উচিত লক্ষ্য রাখা এই দুইয়ের মাঝে তিনি কি অবস্থান গ্রহণ করছেন। তার বিচারবুদ্ধির মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্রিকতা এতদূর উন্নত হতে হবে যে, তিনি শুধু অতীত পণ্ডিতদের কথা ও যুক্তির উদ্ধৃতিকার হবেন না বরং তাদের সম্পাদিত ইজতিহাদে অধিকতর সঠিক ও শক্তিশালী মত কোনটি তা চিহ্নিত করতে সক্ষম হবেন। তিনি ফতোয়া দিবেন আল্লাহর বাণীর ভিত্তিতে অথবা রাসূলের সুন্নাহর ভিত্তিতে অথবা এ দুইয়ের সঙ্গে তুলনার ভিত্তিতে অথবা এ দুই উৎস থেকে লব্ধ মনীষার মতামতের ভিত্তিতে। আদর্শ মুফতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো- বাস্তবতা, সমসাময়িক জনজীবন ও এর সমস্যা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা। শরিয়ার লক্ষ্য উপলব্ধি না করে কোনো মুফতির ফতোয়া ঘোষণা করা উচিত নয়”।
আমি ব্লগের বিজ্ঞ ব্লগারদের কাছে একান্ত অনুরোধ করব, ইসলাম ধর্মীয় কোন পোস্ট দেবার আগে সেটা ভালো করে দেখে নিবেন। পবিত্র কুরআন শরীফের নির্দিস্ট আয়াতের নাম্বার কিংবা সহী হাদিসের নাম্বার দেয়া থাকলে সেটা খুব সহজেই মিলিয়ে দেখা যায় সঠিক কিনা। হাদিসের নাম্বার ছাড়া সেটা সহী কিংবা এর সনদ বিচার করা সম্ভব না। বহু জঈফ হাদিস আছে যেইগুলিকে আপাত দৃষ্টিতে ভুল মনে হয় না। কুরআন শরীফের আয়াত এবং সহী হাদিসের মূল অর্থ বাদ দিয়ে/বিপরীতে কারও মনগড়া কোন ব্যাখ্যা কখনই গ্রহনযোগ্য নয়।
ফেসবুক কিংবা কোন সোশাল মিডিয়াতে প্রাপ্ত কোন ধর্মীয় লেখা ব্লগে কপি পেস্ট করে ব্লগে পোস্ট দেবার আগে অবশ্যই যাচাই করে নিবেন। কারন পোস্ট দেবার পরে সমস্ত দায় দায়িত্বই কিন্তু পোস্টদাতারই।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে চলার তৌফীক দান করুন, আমীন।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, সেপ্টেম্বর ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:১৩