দরজায় সামনে দাড়িয়ে রুপন এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। এটা সম্ভবত মাঘ মাস, গতকালের দৈনিক পত্রিকায় ও পড়েছিল। অথচ এই শীতকালেও টের পাচ্ছে ওর পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। এটা ওর নিজের রুম, তারপরও ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না ওর। পিছনে তাকিয়ে দেখে, সবাই ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! সব ছেলেরা বিয়ের পর নিজের বাসর ঘরে ঢুকার জন্য যেখানে অস্থির হয়ে থাকে, সেখানে ও ইচ্ছে করেই টালবাহানা করছে সময় কাটানোর। আসলে ও সিদ্ধান্তই নিতে পারছে না ওর ভিতরে আসলে ঢুকা ঠিক হবে কিনা! দরজার হ্যান্ডলে ধরা ওর ডান হাতটা হালকা কাঁপছে। সবাই হয়ত মনে করছে ওর লজ্জায় রকম হচ্ছে। কিন্তু ওর কাছে এখন লজ্জার চেয়ে দ্বিধাটাই বড় হয়ে দাড়িয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই মোবাইলে শোনা কথা গুলি বারবার ঘুরে ঘুরে ওর দুই কানে বাজছে।
এক
- আস্লালামালিকুম, আপনি কি রুপন ভাই বলছেন?
- জি৷ আপনি কে?
- আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার ক্লাসমেট রিমা আপুর কাজিন। আপনার ফোন নাম্বার আমি আপুর কাছ থেকে পেয়েছি।
- ও আচ্ছা। ফোন করেছেন কেন? কিছু বলবেন?
- রুপন ভাই, রিমা আপু একটা বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে বলেছেন। কিছু মনে না করলে কয়েকটা কথা বলি?
- বলুন।
- আপনি কি মুমু নামের কোন মেয়েকে বিয়ে করছেন?
- বিয়ে হয়ে গেছে অলরেডি। কিন্তু কেন মুমুর ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছেন?
- আপনি কি আগে থেকেই এই মেয়েটাকে চিনতেন?
- না, কেন? ওর সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে।
- মুমুর সাথে বিয়ের আগে আপনার কোন কথাবার্তা হয়নি?
- না, তেমন একটা না। কেন?
- মুমু কি ওর আগের এ্যাফেয়ার নিয়ে আপনাকে কিছু জানিয়েছে?
- কি বললেন আপনি?
রুপন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না? কি শুনল ও এটা? তাও বিয়ের দিন রাতেই! এখনও বাসর ঘরেই ও ঢুকেনি!
- রুপন ভাই, একটা বড় সমস্যা হয়েছে। মুমুর রাফি নামের একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ করে মুমু আপনাকে বিয়ে করে ফেলেছে শুনে রাফি অনেক ক্ষেপে গেছে।
-রাফি কে? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি রাফিকে চেনেন কিভাবে?
-আপনি চিনবেন না। মুমু চেনে। খুব ভালো করেই চেনে। আমার সাথেই পড়ে। ছেলেটা খুব একটা সুবিধার না। আমাদের মাথায় ঢুকত না কিভাবে মুমু এই ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াত।
- কি বলছেন আপনি এসব?
- রাফি আজকে মুমুর বিয়ের কথা শুনে ড্রিঙ্কস করে এসে আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে প্রচুর উল্টা পাল্টা কথা বলছে। ওর কাছে নাকি মুমুর সাথে ঘনিষ্ট বেশ কিছু ছবি আর ভিডিও আছে। মুমু যদি ওর কাছে ফিরে না আসে, তাহলে ও মুমুকে নাকি কঠিন শাস্তি দেবে। ছেলেটা একেবারেই বাজে ছেলে। আমার ভয় হচ্ছে রাফি বড় কোন অঘটন না ঘটায়! আপনি মুমু বা ওর বাসায় এক্ষুনি বিষয়টা জানান। আমার কাছে ওর ফোন নাম্বার নেই, থাকলে ওকেই বলতাম।
-মুমুর সাথে এখন এই বিষয় নিয়ে আমার কথা বলতে হবে? তাও আজকেই!
রুপনের মাথা বন বন করে ঘুরতে শুরু করেছে। হায় আল্লাহ, এই মেয়েকে বিয়ে করে আমি কি বিপদে পড়লাম? কি করব এখন আমি? এই মেয়েকে ও নিজে পছন্দ করে বিয়ে করছে তাও না। বাসার সবাই পছন্দ হয়েছে দেখে ও আর মানা করেনি।
- মুমুকে বলবেন রাফিকে ঠান্ডা মাথায় সামলাতে। নাহলে শুধু ও না, আপনিও কঠিন বিপদে পড়বেন।
- আপনি কেন গায়ে পড়ে আমার উপকার করতে চাচ্ছেন?
- দেখুন, আমি আপনাকে চিনতামও না। রিমা আপু আমার পাশের বাসায় থাকেন। একটু আগে নীচে আপুর সাথে দেখা। আপনার বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে এসেছে। এত রাতে কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করতেই আপনাদের বিয়ের ছবি দেখাল। মুমুকে ছবিতে দেখে আমি হতভম্ব! আপুকে সবকিছু খুলে বলতেই, আপু আপনার নাম্বার দিয়ে এক্ষুনি ফোন করে আপনাকে রাফির ঘটনা জানাতে বলল।
- আমি কিন্তু রিমার সাথে অবশ্যই কথা বলব। শুধু শুধু মুমুর নামে বাজে কথা বলছেন না তো?
- প্লিজ, আপনি আমাকে খারাপ কিছু ভাববেন না। আমার ভয় হচ্ছে সিচুয়েশন অনেক খারাপ দিকে যেতে পারে। আপনি প্লিজ মুমুর সাথে কথা বলেন। কথা বললেই বুঝতে পারবেন। আর আমার কথা বিশ্বাস না হলে রিমা আপুর সাথে কথা বলুন। আস্লা লামালিকুম ভাইয়া, আমি ফোন রাখছি।
হতভম্ব হয়ে হাতে মোবাইল নিয়ে দাড়িয়ে রইল রুপন কিছুক্ষন!
দুই
একটু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পরই রিমাকে ফোন করে রুপন আরো ডিটেইলস জানতে পারল। ফোন করেই বুঝতে পারল রিমা আসলে ওর ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সুমন অনেক কিছুই ওকে বিস্তারিত ভাবে বলেনি, সম্ভবত ওকে বিব্রত করতে চায়নি। সব কিছু শুনার পর রুপনের মাথায় হাত অবস্থা! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা ও। কি ঘটতে পারে আর কত বড় বিপদে ও পড়তে যাচ্ছে এর কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে রুপন। হাত পা তখন থেকেই ওর ঠান্ডা হয়ে আসছে।
মুমুর সাথে কথা বলার সামান্য রুচিও রুপনের হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও ওকে কথা বলতে হবে। সত্যি না মিথ্যা জানতে হবে! সত্যি হলে পুরো ঘটনাটা জানতে হবে, ইন ডিটেইলস। Ins and Out. ওর আজকে মাত্র বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে আরেকটা ছেলের! ওহ, গড। ওর বাবা মা যখন জানবে, অবশ্যই জানবে তখন? ও নিজের বাবা মার কাছে মুখ দেখাবে কিভাবে? আচমকা দেয়াল ঘড়িতে এলার্ম বেজে উঠলো, সাথে সাথে রুপনের ভাবনাতেও ছেদ পড়লো। ঠিক রাত বারোটা বাজে। বিয়ে বাড়ি বলে বাইরে এখনও খানিকটা কোলাহল রয়েছে। প্রতিটা কোলাহল যেন ওর বুকে এসে বুলেটের মতো আঘাত করছে।
সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ পাশ কাটিয়ে দরজা খুলে রুপন বাসর ঘরে এসে ঢুকল। টিক্ টিক্ টিক্ টিক্ - ঘড়ির কাটার চলমান শব্দ ক্রমেই স্পস্ট হয়ে উঠছে ওর কানে। রুপন ঘরে ঢুকে মাথার পাগড়ীটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে মুমুর দিকে ফিরে তাকাল....
তিন
বাসর ঘরে ফুলে ফুলে সুসজ্জিত ওরই খাটের উপর বধূবেশে বসে আছে মুমু। রুপনের বিবেক একবার এসে খোঁচা দিয়ে গেল - এই পবিত্র রাতে ও কিভাবে মুমুকে এত জঘন্য একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করবে? ও অনেক রিজনেবল একটা ছেলে কিন্তু সত্যই ওর কিছুই করার নেই আজকে। ওকে জানতেই হবে। সত্য যতই তিক্ত হোক, যতই ভয়ংকর হোক! ওকে জানতে হবে মুমু কি সত্যই ওকে এত জঘন্য ভাবে ঠকিয়েছে? রুমের ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে এনার্জি লাইটটা বন্ধ করলো। মাথা এখন চরম ঠান্ডা রাখতে হবে। কোনভাবেই হইচই করা যাবে না এত রাতে। সারা বাসা ভর্তি আত্মীয় স্বজন। এতোক্ষনে নিশ্চয়ই বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়া শুরু করেছে!
রুপনের ঘরটা বেশ পরিপাটি। এটাচ্ড বাথ। ঘরের একপাশে একটি টেবিল ও বুক সেল্ফ। সেলফে অনেকগুলো গল্পের বই সাজানো। অন্যপাশে একটি আলনা, তাতে যত্ন করে কাপড় গুলি গোছানো। বিছানাটা দরজার একদম বিপরীতে। ফুলে ফুলে খাট টা সাজানো। নানান রকমের ফুল, তবে বেশীর ভাগই গোলাপ আর রজনীগন্ধা। ডিম লাইটের সবুজ আলোতে ঘরের ভিতরটা অদ্ভুত সুন্দর লাগছে! কিন্তু এসবের কোন কিছুই রুপনকে আজকে স্পর্শ করতে পারছে না।
রুপন বিছানায় এসে বসলো। ওর হৃদস্পন্দন হঠাৎ-ই বেড়ে গেলো। মাথা নীচু করে কিছুক্ষন বিছানায় বসে রইলো। ও দ্বিধাগ্রস্ত, কি বলবে, কিভাবে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না।
- মুমু, আমি আপনার কাছে একটা ব্যাপারে সত্যি কথা জানতে চাই?
মুমু চুপ করে আছে দেখে রুপন আবার শুরু করলো।
- রাফি কে? তার সাথে আপনার কি ধরনের সম্পর্ক আছে বা ছিল সেটা আমি জানতে চাই?
মুমু হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। হতভম্ব হয়ে রুপনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে!
- কথা বলছেন না কেন? অবাক হয়েছেন?
মুমু এখনও চুপ করে আছে দেখে রুপন একটু বিরক্ত হলো।
- আমি অলরেডি এই বিষয়ে অনেক কিছু শুনে এসেছি। সত্যি কি মিথ্যা জানি না। আমি আপনার মুখ থেকে আসল সত্যটা জানতে চাই। এটা আমার অধিকার।
মুমু মাথা নীচু করে ফেলল, এখন নীচু করে লাভ কি?
- বিয়ের আগে একটা মেয়ের অ্যাফিয়ার থাকতেই পারে, কিন্তু আপনি আমাকে মিথ্যা কথা বলেছেন। আমি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বিয়ের আগে। তাইনা?
- আমি আপনাকে সেদিন বলতে পারিনি। আমার পক্ষে সেটা বলা সম্ভব ছিল না। আপনার সাথে তখন আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল।
- বাহ, যখন আরেকজনের কাছ থেকে আপনার মজাদার কাহিনী শুনব, আমার কেমন লাগবে সেটা কি কখনো ভেবেছেন? সুমন কি নিশ্চয়ই চিনেন? ও আমার এক ক্লাসমেটের ছোট ভাই।
- আমি স্যরি। আমার আসলে বলা উচিত ছিল।
- স্যরি? কোনটার জন্য স্যরি? আমাকে আগে না বলার জন্য, না যা বিয়ের আগে করে এসেছেন সেটার জন্য?
- সবকিছুর জন্য।
- এত সহজ? সব কিছু এতই সহজ। আমি আপনার কোন কথা কিভাবে আর বিশ্বাস করবো? আপনি তো সেই ছেলেকে নিজের সব কিছুই দিয়ে এসেছেন। একবারও কি বিয়ের আগে ভাবছেন, এটা কত বড় একটা প্রতারনা করছেন আমার সাথে? আমি আপনার সাথে কি অপরাধ করেছিলাম? আপনাকে বিয়ে করতে চেয়েছি এটাই তো মনে হচ্ছে আমার মস্ত বড় অপরাধ?
- আমার সাথে রাফির এখন কোন সম্পর্ক নেই। আপনি চাইলেই বা ইচ্ছা করলেই আমরা এটা একদম ভুলে যেতে পারি!
- তাই কি? কিন্তু আপনার প্রেমিক পুরুষ রাফি তো কিছুতেই ভুলতে চাচ্ছে না। এত এত সুন্দর অন্তরঙ্গ ছবি আর ভিডিও করে এখন নিজেই ভুলে যেতে চাইছেন। এটা কেমন কথা?
ছবি আর ভিডিওর কথা শুনে মুমু মাথা আরও নীচু করে ফেলল।
- মুমু, আমি আপনার আর রাফির মধ্যের সম্পর্কের পুরোটা শুনতে চাই। আর গোপন করে কি করবেন? প্রায় সবই তো শুনে আসলাম! দেখি, এবার আপনি কতটুকু সত্য কথা বলেন?
- কতটুকু আর কতবার নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে আমার কাছে এসেছেন, সেটা আপনার মুখ থেকেই শুনি। কি বলেন?
মুমু হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বারবার করজোরে করে মাপ চাইলো। কিন্তু রুপনের এক কথা। আমি প্রথম থেকে সব কিছু শুনতে চাই, তারপর আমি আপনার ব্যাপারে চুরান্ত সিদ্ধান্ত নিবো।
চার
মুমুর কাছ থেকে বার বার জেরা করে এই অবৈধ সম্পর্কের আদ্যপান্ত শোনার পর রুপনের সমস্ত পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে এলো। যেন হুট করে একটা ঘন কালো পর্দা এসে ওকে সমস্ত পৃথিবী থেকে আচমকাই আলাদা করে ফেলল। প্রচন্ড ঘৃনা নিয়ে বেড থেকে উঠে আসল ও। এটা প্রতারনা, চরম প্রতারনা। ও এটা কোনভাবেই ডিসার্ভ করে না, কোন ভাবেই না। মুমু দিকে তাকিয়ে ওর বমি পাচ্ছে। স্পর্শ করা তো দুরের কথা, মুমুর দিকে এখন তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। সমস্ত স্বপ্নকে বনবাসে পাঠিয়ে আজ বাস্তবতার রাজত্বে এক নিতান্তই তুচ্ছ আর নিঃস্ব একজন মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি এখন কি করবো? আমার কি করা উচিত? কোন কিছুই এখন ওর মাথায় ঢুকছে না। আজ আমার বাসর - একটি স্বপ্নহীন বাসর। না না এটা, জাহান্নামের বাসর। এই মেয়েটা হতে পারতো ওর সারাজীবনে স্বপ্ন অথচ নির্মম বাস্তবতা ওর সমস্ত স্বপ্নকে টুকরো টুকরো করে দিলো! কি অসহ্য মানসিক যন্ত্রনা ওকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, এটা একমাত্র ওই জানে! এর চেয়ে বরং এই মেয়েকে বিয়েটা না করাই অনেক ভালো ছিল!
পাঁচ
বাসর রাত, যে রাত অজানা দু’টো মানুষের একান্তই কাছে আসার সময়, অচেনা দু’টোর হৃদয় নিজেদেরকে চেনার সময়, অনুভব করার সময়, সেখানে সুতীব্র একটা ঘৃনা নিয়ে রুপন মুমুর দিকে ফিরে তাকালো। একটা মানুষকে কতটা গভীর ভাবে কতটা অবিশ্বাস নিয়ে ঘৃনা করা যায় ও জানে না, কিন্তু এই জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কাউকে ও কখনো ঘৃনা করেনি। বাসর রাতটা রুপনের কাছে মনে হচ্ছে চরম অভিশপ্ত কোনো এক রাত। একটা জঘন্য কুৎসিত দুঃস্বপ্ন। ও যা নিজের কানে শুনেছে, তা শোনার চেয়ে মরে যাওয়াও মনে হয় ভালো ছিল। কি অপরাধ করেছিল ও? এমনকি এই ধরনের সমস্যা হতে পারে দেখে, বিয়ের আগে মুমুকে সামনা সামনি এবং সরাসরি এই বিষয়ে জিজ্ঞেসও করেছিল। মেয়েটা এত বড় বদ যে, কথাটা জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। মুমুর দিকে আবার মুখ ফিরে তাকাল রুপন। বদ মেয়েটা ওর জীবনের বিয়ের স্বপ্নকে ধংস করে দিয়ে এখন কি সুন্দর মাথা নীচু করে বেডে বসে আছে! ওর ইচ্ছে করছে উঠে যেয়ে মেয়েটার ফর্সা গলাটা এখনই টিপে ধরতে। গলাটা টিপে ধরে মেরে ফেলতে! তারপর যা হবার হবে! মানুষ কখন খুন করে, কোন পরিস্থিতি করে, হঠাৎ করেই আজকে ও বুঝতে পারলো।
রাত একটা বাজে। একটু আগে বাথরুমে যেয়ে ভালো করে মাথা মুখ ধুয়ে এসেছে। ওর মাথার পিছনে ঘাড়ে দপ দপ করে ব্যথা করছে। রুপন ভালোভাবেই বুঝতে পারছে, ওর প্রেসার আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে। যে ভাবেই হোক নিজেকে ওর কন্ট্রোল করা দরকার। এই বদ মেয়ের জন্য ওর লাইফের সব স্বপ্নগুলি নষ্ট করতে দেয়া যায় না, উচিৎও না। আবারও মুমুর সাথে ওর বাকি কথোপকথন গুলি আবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
- আপনার যখন এই ছেলেকেই পছন্দ তাহলে ওকেই বিয়ে করতেন? ওকে বিয়ে করলেন না কেন?
- ও আমাকে use করতো। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারি ওর এরকম আরো কয়েকটা মেয়ের সাথে relationship ছিল। জানার পর আমি ব্রেকআপ করে চলে আসি।
- আপনাদের relationship কত দিনের lasting করেছিল?
- প্রায় দেড় বছর।
- দেড় বছর ফুর্তিফার্তা করে এখন এসেছেন আমার সাথে সংসার করতে? লজ্জা করে না বলতে? প্রস মেয়েদের সাথে আপনার পার্থক্য কোথায়? অন্তত সেই মেয়েগুলি তো পেটের দায়ে শরীর দেয় আর আপনি? ওই ছেলেকে আমি কেন পুরোপুরি দোষ দিবো? আপনি প্রশ্রয় দিয়েছেন দেখেই তো সবকিছু হয়েছে? অস্বীকার করতে পারেন?
মুমু কোন শব্দ না করে চুপ করে মাথা নীচু করে রইল। ওর বলার কি বা আছে এখন!
ছয়
মুমুর আর কোন কথা শোনার ইচ্ছে হচ্ছে না রুপনের। কোন মানেও হয় না। ঘরের লাগোয়া বারান্দার দরজাটা খুলে ও বাইরে বের হয়ে আসল। দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওর, ফ্রেস বাতাসে ওর বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। নিজের বিয়ে, বউ আর সংসার নিয়ে ওর কতই না চমৎকার সব স্বপ্ন ছিল! ওকে যখন প্রথম বিয়ের কথা মা এসে বলেছিল, সেদিন ও অনেক অনেক লজ্জা পেয়েছিল। প্রথম যে মেয়েটার ছবি ওর হাতে পেয়েছিল, তখন ওর হাত প্রায় কাঁপছিল। কেন যেন মেয়েটার সাথে ওর বিয়ে হয়নি। কথাবার্তা ভেংগে যাবার তিনদিন পরে রাতে ও একটা অদ্ভুত সুন্দর স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নে একটা ডানাকাটা পরীর মতো মেয়ে সবুজ শাড়ী পড়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হাসছে আর ডানহাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। কি যে অসহ্য ভালো লাগার একটা অনুভূতি ওর মনকে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল যে, এখনও মাঝে মাঝে ও সেটা বুকের মাঝে অনুভব করে! যখনই কোন মেয়ের ছবি মা ওর হাতে এনে দেয়, ও ভালো করে মিলিয়ে দেখে মেয়েটা ওর স্বপ্নে দেখা সবুজ পরীর মতো নাকি! মুমুর ছবিটা অনেক ভালো লেগেছিল ওর, ভেবেছিল হয়ত এই সেই ওর স্বপ্নে দেখা সবুজ পরী। নির্মম বাস্তবতা যখন ওর সব স্বপ্নগুলি ভেঙ্গেচুড়ে একাকার করে দিল, তখন ও ওর বুকে শুধু নি:সীম হাহাকার ছাড়া আর কিছু অনুভব করতে পারছে না। মুমু ওর সবুজ পরী না, হতেই পারে না, কখনো না, প্রশ্নই উঠে না। ও ওর সবুজ পরীকে এখনো খুঁজে পায়নি। ওর মন বলছে, ওর সবুজ পরী ওর জন্য এখনও অপেক্ষায় আছে, কোথাও। ওকে খুঁজে বের করতে হবে। যত দিন লাগবে লাগুক। ওর শুন্যতায় তৃষিত হাহাকার করে উঠা বুকটা যেন বারবার সেই সবুজ পরীকেই খুঁজে ফিরছে!
বারান্দায় রুপন ভোরের আলোয় একটা নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন শুরু হবার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল….
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভ কামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, সেপ্টেম্বর, ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১১:১৫