আলিম মাঝি শীতল পাটির আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে উঠোনের
শিশু গাছের তলায় একটা পিড়ি পেতে বসতে বাধ্য হল। শরীরময় আলস্য। মনে হচ্ছে চোখে ঘুম নেমে এই উঠোনেই কাত হয়ে যেন পড়ে যাবে। চোখ খোলা রাখতে দোজখের কষ্ট ভোগ করছে। এর মধ্যেই বিড়বিড় গাল পাড়া তড়িঘড়ি তামাক সাজানোয় ব্যাস্ত মাঝির বৌয়ের কান এড়ায় না। তড়িঘড়ি করতে গিয়ে সে আরো দেরি করে ফেলছে ।আজকের বাজার বারের কথা তার মনে ছিল না। অন্যান্য দিনের মতন খাওয়ার পর মাঝি পাটি পেতে শুয়ে পড়লে সে আড্ডায় চলে গিয়েছিল । দুপুরের খাওয়ার পর পান চিবোতে চিবোতে গল্পে মশগুল হয় সবাই কালাম মাঝির উঠোনে । মাঝি পাড়ায় কালামের অবস্থা অন্যদের চেয়ে ভাল। আজ আসর জমজমাট। গাঁয়ে আলোচনা করার মতো ঘটনা তেমন ঘটে না। মানুষ জাবর কাটতে কাটতে হয়রান হয়। মাড়িটাই কেবল ব্যথা হয়। কিছু বুড়ো কেবল হাল ছাড়ে না। আজকের অবস্থা সেই তুলনায় আরো অনেক দিন জাবর কাটার রসদ। জসিমুদ্দিনের জোয়ান তাগড়া ছেলেটা সকালে জমির জন্য রাখা সার খেয়ে ফেলল আড়াই মুঠো । তিন মুঠোই খেত পারে নি ভাগ্য বৌ তার দেখে ফেলে চেঁচামেচি শুরু করলে আশপাশের লোক এসে ঝাপটে ধরে অর্ধেক মুখ থেকে বের করতে পারে কোনমতে । এরপর কাঁচা গোবর খাইয়ে দেয়াতে বুমি করে পেটের ভেতরের সার সহ বের করে দিল। কালীপদ ডাক্তার ঐসময় কাছ দিয়ে যাচ্ছিল বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল আলিমুদ্দিন। কিন্তু তার এরকম বিষ খাওয়ার কারণ এখনও কেউ জানে না। সে মুখটি পর্যন্ত এখনো খোলেনি । বউটা কান্নাকাটি করতে করতে হয়রান হয়ে এখন জামাইয়ের পাশে চুপচাপ বসে আছে। কালাম মাঝির বৌ গিয়েছিল । গাঁ বেড়ানোর অভ্যাস কিছুটা আছে কালামের বৌয়ের কারণ কিছু কারবার আছে তার গাঁয়ের মহিলাদের সঙ্গে । মাঝি পাড়ার বৌরা খবরাখবরে তার উপরই আস্থা রেখেছে। তার গলার আওয়াজ চড়া হচ্ছিল । তার ভাষায় - ঢং দেখে আর বাঁচি নে। মনে হচ্ছিল বিষ ছোড়া খায় নি , বৌ টা খেয়েছে । মাঝির বৌ নানা চেষ্টা চরিত্র করেও ঘটনা যে বের করতে পারে নি তার গালিগালাজ দেখে খাদিজা বেশ বুঝতে পারছিল। তারপরেও কোনমতে একটা ঘটনার উল্লেখে যদি কিছু আন্দাজ করা যায় । এখন সবাই মিলে কারণ খুঁজছে । একেকজন একেক কথা বলছে। খাদিজা তার মনপ্রাণ দিয়ে তাদের কথাগুলো মেলানোর চেষ্টা যখন করছে তখন ডান চোখের কোনায় ধরা পড়ে একজন দুইজন করে লোক নৌকা ঘাটের দিকে যাচ্ছে । তারপর হঠাত্ মনে পড়ে যাওয়াতে কোনমতে কাপড় টা একহাতে গায়ের সাথে চেপে ধরে হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি পৌছে একটা লম্বা শ্বাস টেনে মাঝির গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জাগাল। আলিম পুরো জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম বাক্যটি বলল-হারামজাদি , এখন তোর জাগানোর সময় হল ? খাদিজা এমনিতেই দোষ করেছে তাই বাদানুবাদে না গিয়ে এক জগ পানি দাওয়ায় রেখে তামাক সাজাতে বসল। মাঝির ঘুম মনে হয় পুরো চলে গেছে কারণ তামাকের জন্য উঠোন থেকে গালি পাড়ছে। মাঝির সামনে তামাক রেখে কোমরে হাত দিয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে সে দাঁড়াল । মাঝির পেশিবহুল শরীরে তার চোখ দুটি ঘুরতে লাগল। আলিম তামাক নিয়ে ব্যাস্ত হওয়ায় খাদিজাকে লক্ষ্য করে নি। কয়েকটি টান দিয়ে যখন চোখ তুলে বউকে ঐ ভঙ্গিমায় দেখল চোখে কৌতুক নিয়ে জিজ্ঞেস করল , কি দেখছিস ?এতক্ষণ যে রাগ গুলো খাদিজার মাথায় জ্বলছিল নিমেষেই উধাও হল যেন। তারপর ,কিছু না ,বলে ঘরের ভিতর চালান হয়ে গেল। আলিম উঠোন থেকে হাঁক দেয়- কিছু লাগলে তাড়াতাড়ি বল , আমি উঠলাম । ভেতর থেকে কোন আওয়াজ আসে না। আলিম খুঁটিতে রাখা কাপড় নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে ঘাটের দিকে রওয়ানা হল । আজ চক্রবর্তী হাট। এই গ্রাম থেকে নৌকায় দুই ঘন্টার পথ। বিশাল হাট। গাঁয়ের মানুষ সপ্তাহে এই একটা দিন বলতে গেলে গাঁ থেকে বের হয়। আজকের দিনে খাদিজার কোন একটা ফরমাস নিশ্চয়ই থাকে কিন্তু আজ দিল না। একবার পেছনে ফিরবে কিনা ভাবতে গিয়ে মত বদলাল। মাইয়া মানুষকে বেশি প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না। নৌকার কাছে এসে দেখে তিন-চতুর্থাংশই ভর্তি । তার দেরির কারণে লোকজনের অসন্তোষ চাপা থাকে না। কোন উত্তর না দিয়ে হাল ধরে সে বসল। নৌকার বাঁধন খুলল না। রাস্তায় চোখ ,আর কেউ আসে কিনা অপেক্ষা । কোন কথা না বলেই সব যাত্রীর অনুযোগের উত্তর সে দিয়ে দিল । দুই একজন বলল ,ছাড় ,মাঝি ,আজ আর কেউ আসবে না। মাঝি কিছু বলে না , অপেক্ষা করতে থাকে । অন্যরা নিজেদের মধ্যে আলাপ শুরু করে দিয়েছে । আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাঝি ভাবে , ফেরার সময় হাট থেকে কিছু একটা কিনে আনলেই হয় ! তারপর দড়ি খুলে দেয়।ঘরে ঢুকে খাদিজা বিছানো পাটিতে বসে পড়ল। হঠাত্ এমন রাগ হওয়ার কারণ খুঁজতে ব্যস্ত আলিম যখন হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করছিল কিছু লাগবে কিনা একটা শব্দও না করে চুপচাপ বসে রইল। আলিম যাওয়ার পরেও সে উঠল না। আজ আর আড্ডায় গেল না। এমন রাগ হওয়ার কারণ কি ? এমন তো নয় আজ সে প্রথম গালি শুনল। তবে রাগটা তার নিজের উপর ! সে ভুলে গিয়েছিল আজ হাট বার? সকাল বেলা আলিমুদ্দিনের বিষ খাওয়ার কথা শোনার পর থেকে তার মন ভাল ছিল না। কারণ জানার জন্য সে অধীর হয়ে ছিল। আলিম যখন ঘরে ছিল না সে শুধু ছটফট করেছে একা একা। এমন সুন্দর জীবনের মায়া ত্যাগ করে মানুষ মরতে চায় কেন ? কিছুতেই তার মাথায় ঢুকে না। কেন মানুষ মরতে চায় , কি তার অভাব ! ভাবছিল আলিম দুপুরে ফিরলে তার সাথে কথা বলবে। আলিমুদ্দিনের ঘটনার কারণও হয়ত জানা যাবে কিন্তু আলিম কোন সুযোগই দিল না কথাটা পাড়ার । এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ ভাবখানা কিছুই ঘটেনি । অন্যদিন নৌকা নিয়ে ফিরে খেয়ে যেমন দুপুরে ঘুম দেয় তেমনই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল । এইজন্য মাঝির উপর তার রাগ ! তার নির্বিকার ভঙ্গি ভাল লাগে নি ! কিন্তু মাঝির কি দোষ ? সে কি করবে ?আঠারো-ঊনিশের ছোড়া আলিমুদ্দিন । বিয়ে করেছে মাস চার পূর্ণ হয় নি। এমন মায়া কাড়া চেহারা বউটির । তার পরেও যে কেন মরতে গেল খাদিজার মাথায় আসে না। আহা ,এমন সুন্দর দুনিয়ার মায়া ছেড়ে মানুষ কেন মরতে চায় !খাদিজার বিয়ে হয়েছে দুই বছরের কিছু বেশি । কোন সন্তান আসার নামগন্ধ নেই । সে নিজে কি কম অসুখী ! মরার ভাবনা তো তার মাথায়ও বার কয়েক উঁকি দিয়ে গেছে ! সে কি পেরেছে মরতে ? খাদিজার অলস সময় কাটে কাথা সেলাই করে। সেলানো কাঁথার উপর কত নকশা যে সে করে যায় । পরম যত্নে। তার অনাগত সন্তানের জন্য । পাটি ছেড়ে একটা অর্ধসমাপ্ত কাঁথা সে হাতে নেয়। তখন তার মনে পড়ে লাল আর বেগুনি দু রকমের সুতা শেষ হয়ে গেছে । আজ হাটে যাওয়ার সময় মাঝিকে বলবে ভেবে রেখেছিল , বলা হলো না। আজকের এরকম একটা দিনে কি আর সব কাজ ঠিকমতো করা যায় ! মমতা নিয়ে অর্ধসমাপ্ত কাঁথায় হাত বুলায়। স্পর্শে যেন তার অনাগত সন্তানের অস্তিত্ব এই কাঁথায় অনুভব করে। আবার প্রশ্নটা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। আহা ,মানুষ কেন মরতে চায় ! চুপচাপ কতক্ষণ বসেছিল খাদিজার খবর ছিল না। হুঁশ হতেই কাঁথাটা রেখে রান্নার যোগাড়ে মন দিল আর মাঝির জন্য ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগল। সন্ধ্যা পার করে মাঝি যখন ফরল তার হাতে রংবেরঙের কয়েকখানি চুড়ি। নৌকা ঘাটে বেঁধে হাটে ঘুরতে ঘুরতে কি কিনবে ঠিক করতে না পেরে এই চুড়ি গুলি সে কিনেছিল । তার হাতে চুড়ি দেখে খাদিজা যারপরনাই খুশি । মাঝি নিজে নিয়ে এসেছে । তার হাত থেকে নিয়ে যে মাটির কলসিকে সখের জিনিস রাখার কাজে ব্যবহার করে তাতে রেখে তামাক সাজিয়ে দিল। মাঝি যখন তামাক নিয়ে বসল সে পুনরায় চুড়িগুলো নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। কাঁচের চুড়ি ,একটার গায়ে আরেকটি লাগলে টুংটাং শব্দ হয়। এই শব্দই বারবার সে শুনতে লাগল। হাতের মাপে একটু বড় হয়েছে মনে হল তাই মাঝির সামনে পরার ভাবনা বাদ দিল। আলিম তামাক খেতে খেতে বউয়ের কাণ্ড দেখে ভাবল-আজব জাত এই মেয়ে মানুষ । সামান্য কখানা চুড়ি দিয়েও তাকে খুশি করা যায় । ঠাট্টার স্বরে বলল ,পরিয়ে দিব ?কথা কয়টি কানে গেলে খাদিজা হাল্কা আর্তস্বরে বলল ,আরে না-না-না। বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল । খাওয়ার পাঠ চুকলে খাদিজা আর অপেক্ষা না করে আলিমুদ্দিনের কথা তুলল। আলিম কোন সদুত্তর দিতে পারল না। ঘটনার কারণ কি এখনও কেউ জানে না। খাদিজা খানিক চুপ থেকে বলল ,আচ্ছা মানুষ মরতে চায় কেন বলোতো ! আলিম বিষম খেল। বলল , এ আবার কেমন ধারা কথা । মানুষ কেন শুধু শুধু মরতে চাইবে ?খাদিজার ভঙ্গি গুরুতর। বলল , অমন সুন্দর একটা বউ থাকার পরেও আলিমুদ্দিন যে মরতে চাইল ?খাদিজার বলার ভঙ্গি আলিমের দৃষ্টি এড়াল না। হাসতে হাসতেই বলল , সে তো আমারো মাঝেমধ্যে মরতে ইচ্ছে করে।খাদিজা বিস্মিত হয়ে বলল ,সে কি কথা গো ?আলিম বলল ,তা নয়তো কি ?খাদিজা আলিমের চেহারা ভালমতো চেয়ে একান্ত আন্তরিক ভাবে জিজ্ঞেস করল , কেন গো ?আলিম গম্ভীর মুখেই বলল ,যার ঘরে তোর মতন বৌ থাকে তার কি আর বাঁচার স্বাদ হয় ? কথা শেষ হতে না হতেই আলিম খাদিজার রক্তশূন্য মুখ দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল। বলল ,কি শুরু করলি বলতো ! ঠাট্টাও বুঝবি না ! বলে খাদিজার মাথাটা বুকের সাথে জোরে চেপে ধরল। বুঝতে পারল খাদিজা ফুঁপিয়ে কাঁদছে । মাঝেমধ্যে মধ্যে কান্নার ধমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। আলিম লিজেকেই বলছে এমন করে বলল ,আচ্ছা জ্বালা দেখি ! একটু ঠাট্টাও করা যাবে না ? ঐ অবস্থাতেই রাত বাড়তে থাকে। নদীর পানিতে রুপালি জোছনায় রহস্যের বেড়াজাল তৈরি হচ্ছিল কেবল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:১৮