শম্পা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।তার বিশ্বাস হচ্ছে না কামরুল সামনে খবরের কাগজের উপর চোখ রেখে কাঁচা গরুর মাংস খেয়ে যাচ্ছে । বাজার থেকে কিছুক্ষণ আগে মাংস কিনে এনে টেবিলের উপর রেখেছিল কামরুল ।টেবিলে খবরের কাগজ দেখে ওখানেই বসে নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছিল।শম্পা নাস্তা দেওয়ার সময় মাংসটা সরিয়ে নেবে বলে রান্না ঘর থেকে আর আসে নি। এখন নাস্তা নিয়ে এসে এভাবে দেখল। একহাতে চোখের সামনে কাগজ মেলে ধরে অন্য হাতে প্যাকেটের মাংস ছিড়ে খাচ্ছে । বোঝাই যাচ্ছে কি খাচ্ছে সে সম্পর্কে তার কোন খেয়াল নেই ।খবরের কাগজে সম্পূর্ণ মনোযোগ । শম্পা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ভাগ্যিস বাড়িতে কেউ নেই। ছেলে মেয়ে দুটো গেছে খালার বাড়ি। সে এগিয়ে কামরুলের সামনে নাস্তা রাখতে রাখতে বলল ,যাও ,হাত মুখ ধুয়ে এসে নাস্তা করতে বস।কামরুল তার দিকে তাকাল যেন কোন দূর গ্রহ থেকে তাকাচ্ছে ।গাল বেয়ে পড়া রক্তের দাগ মুখটাকে বিভৎস দেখাচ্ছে । কামরুল কাগজ রেখ মুখ হাত ধুয়ে এল। শম্পা মনে মনে চাইছিল কামরুল যেন বেসিনের আয়নায় না তাকায়। কামরুল তাকায়নি এবং ধোয়া পানির সাথে মিশে থাকা রক্ত ও লক্ষ্য করে নি। কামরুল নাস্তা নিয়ে বসার পর মাংসের প্যাকেট টা নিয়ে রান্না ঘরে চলে এল। কামরুলকে এভাবে জগত হারা হতে সে কখনও দেখেনি । একজন মানুষ জগত্ হারা হলেও কাঁচা মাংস খাবে এ বিশ্বাস করা কঠিনই নয় বলতে গেলে অসম্ভব । কোন বড় ধরনের সমস্যা ? একটা কঠিন সময় সে পার করে এখনও স্থির আছে বলে নিজের উপর আস্থাটা একটু বাড়ল । খুব সতর্ক হতে হবে।কামরুল এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছে জানতে ইচ্ছে করছে । টেবিলে কয়েক ফোটা রক্ত পড়েছে ।একটা কাপড় নিয়ে মুছতে মুছতে কামরুলকে জিজ্ঞাসা করল , কি পড়ছ ? কামরুল বলল , কিছু না , প্রাচীন সভ্যতার উপর একটা আর্টিকল । কি লিখেছে ? ঐ রাজাদের কাহিনী আর কি ! তখনকার রাজনীতি । রাজনীতিতে শম্পার আগ্রহ নেই। আর কোন প্রশ্ন করত না কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তার কাছে অস্বাভাবিক । বলল , কি লিখেছে ? কামরুল গম্ভীর হল। কলেজে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করছে এমন ঢংয়ে শুরু করল , প্রাচীন গ্রীসে তখন রাষ্ট্র ছিল না। বস্তুত রাষ্ট্র ধারণাটা তখনও আসে নি... শম্পা বুঝল এসব শোনার কোন মানে নেই ।বলল ,এখন নয় পরে শুনব। রান্না ঘরে কাজ সেরে আসি। রান্না ঘরে তার নিজেকে খুব একা মনে হতে লাগল। একাকিত্ব কাটানোর জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আবার কামরুলের পাশে বসল। কলেজে যাওনি কেন ? ছুটি নিয়েছি। কত দিনের ? আপাতত এক সপ্তাহ । লাগলে আরও নিব। আমার অনেক ছুটি জমা আছে সমস্যা হবে না। হঠাত্ ছুটি নিলে কেন ? এমনি। কামরুল এড়াতে চাইল। গত কয়েকদিন তার জীবনে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে চলেছে । মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছে না। রাত্রে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন ব্যাখ্যা সে করতে পারছে না। একদিন স্বপ্নে দেখল , গোড়ায় চড়ে সে দ্রুত বেগে যাচ্ছে ।সাথে কয়েক জন সঙ্গী । সবাই হাতে তলোয়ার উচিয়ে ধরেছে। তারা কাউকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে । সে যেন নেতা। তার স্নায়ু সুতীক্ষ্ণ ভাবে সজাগ । সবাইকে সে নির্দেশনা দিচ্ছে । আর কিছু মনে করতে পারছে না। কেবল আবছা ভাবে মনে হচ্ছে পাহাড়ি জংলি পথ ছিল । আর একদিন দেখেছে , সে গুহায় বসে। সাথে আরও অনেকে। সবার পরনে গাছের বাকল কোমরে। মেয়েদের বুকে কিছু নেই। আগুন জ্বালিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে নিজেদের গরম রাখছে ।পুরুষ -মহিলা সবার মাথায় জট লাগানো লম্বা চুল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে ঐসময় কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় নি তার কাছে। ঐ সময়কার তার মানসিকতা ও সে বুঝতে পারছে না। শম্পা বুঝল কামরুল বলতে চাচ্ছে না। এতে তার চিন্তা আরও বেড়ে গেল। কামরুল তো কখনও কিছু লুকোয় না !কোন কঠিন সমস্যায় পড়েছে নাকি । তার আবার সমস্যা কি। কলেজে যায় ,ছাত্রদের পড়ায় আর বাসায় ফিরে আসে। কলেজে অন্য কোন টিচারের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠেনি। বাসায়ও সারাক্ষণ বই নিয়েই থাকে। বাচ্চাদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা নেই। সে বাচ্চাদের সাথে কখনও কঠিন গলায় কথা পর্যন্ত বলে না। তবু কেন জানি বাচ্চারা ঘেঁষতে চায় না। তার ও কি বিয়ের পর প্রথম দিকে কেমন অস্বস্তি হত না। মাঝে মাঝে ভয়ও করত। কিন্তু এরকম নিরীহ একজনকে এভাবে ভাবার কোন কারণ পায়নি । তার কি সমস্যা হতে পারে যেটা লুকোতে চায় ভেবে মাংশ খেতে দেখার সময় যে একটা আতঙ্কের ভাবকে মন থেকে জোর করে সে বের করে দিয়ে ছিল সেটা আবার হানা দেয়ার চেষ্টা করে। ভাবল জানতেই হবে কি নিয়ে সে চিন্তিত । বলল , এমনি মানে কি ? কামরুল বুঝল আর এড়াতে পারবে না। শম্পা কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে। সে অস্বস্থি বোধ করে ঐ দৃষ্টির সামনে ।সে নিজেই তো কিছু বুঝতে পারছে না। নাকি শম্পার সাথে আলোচনা করবে। শম্পার কোন বিষয় শোনার ধৈর্য আছে। শুনে সে হাসবে নাকি । হাসুক , ঘটনা অন্তত একজনকে বলা দরকার। সে হালকা হতে চায়। অনেকদিন বোঝার মতো চেপে আছে মনে। কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না বলে মাথা চুলকোতে শুরু করল। শম্পা বলল , মাথা চুলকোচ্ছ কেন ? কঠিন সমস্যা নাকি ? না না তেমন কিছু নয় , কয়েকদিন ধরে স্বপ্ন দেখছি। এতো ভালোই হল। সব মানুষ ঘুমে স্বপ্ন দেখে । তুমি কখনও স্বপ্ন দেখতে না। সেটা অস্বাভাবিক ছিল ।এখন তুমি স্বাভাবিক হয়েছ। আরো আগে বলনি কেন ? কিভাবে বলি প্রথম কয়েক দিন তো আমি নিজেও বুঝতে পারিনি আমি স্বপ্ন দেখেছি। কলেজে মাঝে মাঝে অদ্ভূত সব স্মৃতির মত হঠাত্ মনে এসে আবার হারিয়ে যেত। ঠিক স্মৃতি ও না। একধরনের ভাব।কিন্তু পরে ভাব গুলো ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে স্মৃতির আকার পেতে লাগল। কিন্তু স্মৃতি হলেও এগুলোর সাথে আমার অভিজ্ঞতার কোন মিল নেই । আরও পরে বুঝতে পারলাম আমি স্বপ্ন দেখেছি। জানো তো ,আমি জীবনে স্বপ্ন দেখিনি। তাই স্বপ্নের কথা একবার ও মনে হয় নি। সে শম্পার দিকে এবার একটু স্বস্তি নিয়ে তাকাল। শম্পা জিজ্ঞেস করল , যখন বুঝতে পারলে তখন বলনি কেন ? এবার কি বলবে সে ? তার স্বপ্ন তো সাধারণ মানুষের সাথে মিলে না। মানুষ আজগুবি স্বপ্ন দেখলেও তার একটা ব্যাখ্যা করা যায় কিন্তু তার গুলোর মাথামুণ্ডু তো সে বুঝতে পারছে না। সে নিজে স্বপ্ন দেখত না বলে ছাত্র অবস্থায় স্বপ্ন নিয়ে লেখা অনেক বই সে পড়েছিল । সেই আবছা জ্ঞান দিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করেছে। লাভ হয় নি। নতুন করে আবার পড়তে হবে মনে হয়। বলল , যখন বুঝলাম তখন এও বুঝতে পারলাম আমার স্বপ্ন গুলো নিতান্তই অদ্ভুত রকমের । কাউকে বললে নিশ্চিত হাসবে। শম্পা বলল , দেখি একটা স্বপ্ন বলোতো ,আমি একটু হাসি !কামরুল বলল , একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি কাঠি দিয়ে নদীতে মাছ ধরছি। কাঠিটা একদিকে তীক্ষ্ ফলার মত। আমি ঔদিক দিয়ে গেঁথে মাছ ধরছি। সে শম্পার দিকে তাকাল। শম্পা বলল , কই আমার তো তেমন অদ্ভুত মনে হচ্ছে না। কামরুল বলল , অদ্ভুতই। কেন ? কারন আমার পরনে কিছুই ছিল না। আমার সাথে অনেকেই ছিল। কারও পরনে কিছু ছিল না। বলো কি ? সবাই একেবারে নেংটো হয়ে ! তারপরও আমার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে না। ছোটবেলার কোন ভাবনা মনে পড়ে গিয়েছে হয়ত। ছোটবেলায় ন্যাংটো হওয়া অপরাধ তেমন কিছু না। কামরুল বলল , ছোটবেলা না ,আমার এখনকার বয়স। ভারি আশ্চর্য ! আমিও ছিলাম নাকি ? না । বাহ্ ,স্বস্তি পেলাম। তারপরও আমার কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে না। স্বপ্ন তো একটু ভিন্ন রুপই নেয়। অদ্ভুত ! কেন অদ্ভুত ? মানসিকতা । মানে ? স্বপ্নে আমার মানসিকতা অন্য রকম ছিল। কি রকম ? সেটাই ভাল মত বুঝতে পারছি না। কেমন যেন বুনো। বুনো মানে কি রকম ? আমি কেবল ধরছিলাম না। খুব খিদে লেগেছিল বলে খাচ্ছিলামও। তুমি কাঁচা মাছ খাচ্ছিলে। শম্পার বুকটা হঠাত্ কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে বলল , কাঁচা মাছের স্বাদ কেমন ? আমার একটুও অস্বাভাবিক মনে হয় নি। কোন কিছুই না। এমনকী কাপড় যে পরিনি তাও। শম্পা কি বলবে বুঝতে পারল না। সে লক্ষ্য করল সে চায়ে চুমুক পর্যন্ত দেয়নি । কমরুলের টাও পড়ে আছে। বলল ,চা টা ঠান্ডা হয়ে গেলো ! দাঁড়াও ,আবার বানিয়ে নিয়ে আসি। চায়ের কাপ হাতে নিতে একলা রান্না ঘরে যাওয়ার কথা ভাবতেই মনটা দমে গেল। কামরুল কে বলল , তুমিও চল রান্না ঘরে। কথা বলতে বলতে চা বানানো যাবে। কামরুল উঠে দাড়াল তার নিজের কাপটা হাতে নিয়ে । শম্পা হাত বাড়াতে বলল ,থাক্ না আমার কাছে । ছোট একটা কথা তবু শম্পার মনের ভার যেন অনেক হালকা হয়ে গেল। সে ভাবল , কামরুলের স্বপ্ন প্রসঙ্গ আর না তোলাই বুদ্ধির কাজ হবে। এরপর না জানি আবার কি শোনায় ! রান্না ঘরে চায়ের কাপটা রেখে কামরুল বলল , খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে , দাঁড়াও ,সিগারেটের প্যাকেট টা নিয়ে আসি। শম্পা কিছু বলল না। কামরুলের স্বাভাবিক ব্যবহার তার দুশ্চিন্তা গুলো তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছে । কামরুল একটা সিগারেট ধরিয়ে শম্পার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । গ্যাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া পিন পতন নিস্তব্ধতা। একপাশে মাংসের প্যাকেট টা পড়ে রয়েছে । সেদিকে তাকিয়ে শম্পা বলল , আচ্ছা , কাঁচা মাংস খেতে কেমন হবে ? সেটা আবার কেমন কথা ? না , স্বপ্নে তুমি কাঁচা মাছ খেতে দেখে ছিলে তো তাই এমনি মশকরা করলাম । কামরুল বলল ,খেতে বোধহয় খুব খারাপ হবে না। অভ্যাসটা একবার করে ফেলতে পারলে হবে । ডিসকভারি তে দেখায় না ! আর মানুষ যখন আগুনের আবিষ্কার করেনি তখন তো কাঁচাই খেত, আদিম যুগে। আদিম শব্দটি শম্পাকে কামরুলের স্বপ্ন টা মনে করিয়ে দিল। আচ্ছা ,কামরুল কি আদিম যুগের কোন স্বপ্ন দেখেছিল? কামরুলকে জিজ্ঞাসা করল , স্বপ্নে যখন মাছ খাচ্ছিলে তখন মানসিকতা নিয়ে কি যেন বলতে চেয়েছিলে। সেটা কি এরকম যে তুমি আদিম মানুষদের মত আচরণ করছিলে ? কামরুল বলল , হ্যাঁ ,সেটাই । বললাম না কেমন জন্তুর মত ! কিন্তু মনোভাব টা ব্যাখ্যা করতে পারছি না। চা বানাতে বানাতে শম্পা ভাবল ,যাক্ স্বপ্নটা একেবারে অর্থহীন নয়। কামরুলের বিষয় সমাজ বিজ্ঞান । এদিকে একটা যোগসূত্র থাকতে পারে। হয়ত ঘুমোনোর আগে সে এসব নিয়েই ভাবছিল । কামরুলকে নিয়ে সে বাগানে এসে বসল। ঘাসের উপরের শিশির বিন্দু গুলো এখনো শুকোয়নি সূর্যের উড়ে আসা মিহি তাপে। হিমেল বাতাস থেকে বাঁচতে নিজের চাদরটা আরো টেনে জড়িয়ে দিল শরীরে । চারদিক সুনসান ,স্নিগ্ধ । আহ্ এমন দিনের শুরুটা কেবল ছোট একটা ঘটনার জন্য নষ্ট করে ফেলবে ! কোনওমতেই না! শম্পা আজকের দিনের পরিকল্পনা করতে লাগল। দুপুরে বাইরে খেলে কেমন হয় ! ভাবনাটা আসতেই আর একটা অস্বস্তি থেকে সে মুক্তি পেল। মাংসটাতে তার হাত দিতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু দুপুরে খাবার জন্য রাঁধতেই হত। বাসায় আর কিছু নেই । কামরুল কে আবার বাজারে পাঠাতে চাইলে সে মাংসের প্রসঙ্গ তুলত।পুরো দিন তারা বাইরে ঘুরল। রেস্তারাঁয় খেল ,পার্কে বসল , বাদাম খেতে খেতে গল্প করল সেই পুরনো দিনের মত। শম্পার মনে পড়ছিল ,কতদিন দুজনে একসাথে বের হয় নি কেবল নানান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া ছাড়া ! সময় গুলি কীভাবে চলে যাচ্ছে । এখন জীবনের বড় অংশটাই কাটে ছেলে-মেয়েদের পেছনে । নিজের যে একটা জীবন আছে তা ভূলতে বসেছে প্রায় । সন্ধ্যায় টিকেট কেটে থিয়েটারে ঢুকে পড়ল। শম্পার উদ্দেশ্য ছিল রাতেও বাইরে খাওয়া ।আজকে আর রান্না ঘরের দিকে যাওয়ার তার ইচ্ছে নেই। থিয়েটার থেকে বের হয়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়েছে এমন সময় এক তরুণী এসে তাদের সামনে দাড়াল। স্যার , স্লামালেকুম। কামরুল অভিবাদনের জবাব দিয়ে হাসি মুখে মেয়েটির দিকে তাকাল। তরুণী সহজেই বুঝে নিল কামরুল তাকে চেনে নি। বলল ,স্যার , আমি ফাইনাল ইয়ারে। কামরুল বলল , আচ্ছা ,সরি কিছু মনে করো না। আমি চিনতে পারিনি। আমি কিছু মনে করিনি স্যার। আমি জানতামই আপনি চিনতে পারবেন না। তারপর শম্পাকে ইঙ্গিত করে বলল ,কে স্যার ? কামরুল বলল , ও শম্পা ,আমার ওয়াইফ। মেয়েটি শম্পাকে লক্ষ্য করে বলল , স্লামালেকুম ম্যাডাম । শম্পা বলল ,আমাকে ম্যাডাম বলছ কেন , আমি তো আর তোমাকে পড়াই না। তাহলে কি বলে ডাকব ? শম্পা থতমত খেয়ে গেল। মেয়েটাতো আচ্ছা ফাজিল ! বলল , কিছু সম্বোধন করার প্রয়োজন তো দেখছি না। তোমার স্যারের সাথেই কথা বল। আমাদের বোধহয় দেখাও তো আর হচ্ছে না। কি যে বলেন ? দেখা হবে না কেন ? আমি তো আমার থিসিসের কাজ স্যারের সাহায্য নিয়ে করব ভাবছি। তখন তো অবশ্যই দেখা হবে। শম্পা বলল ,আচ্ছা সে তখন দেখা যাবে । কামরুল এতক্ষণ ওদের কথা শুনছিল । বলল , আমি মনে হয় তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। আমি কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি। জানি স্যার ,সে তো এক সপ্তাহের। তারপর না হয় আমার থিসিসের কাজ শুরু করব ? তাও হচ্ছে না মনে হয় ,আমি ছুটি বাড়াবো। কখন কলেজে আসব জানি না। সে কি স্যার , কোন সমস্যা ? না না তেমন কিছু নয়। বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ । সবাই দূরে কোথাও বেড়াতে যাব ভাবছি। শম্পা চমকাল। কামরুল তো সাধারণত মিথ্যা বলে না। এখন কি অবলীলায় মিথ্যা বলে দিল। মেয়েটাও বোধহয় একটু দমে গেল। আমতা আমতা করে বলল ,কিন্তু স্যার ,আমি যে অনেক আগে থেকে ভেবে রেখেছি থিসিস টা আপনার সাথে করব। কামরুল বলল , আমি দুঃখিত । তুমি বরং সাবের সাহেবের সাহায্য নাও। মেয়ে টি একটু কি যেন ভেবে বলল , আচ্ছা স্যার ,সে পরে দেখা যাবে। আপনারা কোথায় যাবেন ? চলুন নামিয়ে দিই। ধন্যবাদ । তুমি যাও , আমরা এই কাছেই যাবো। মেয়ে টি মনে হয় খুশি হয় নি। মুখ নামিয়ে সালাম দিয়ে চলে গেল। শম্পার ভেতর একটু অস্বস্তি কাজ করতে লাগল। মেয়েটির আচরণ তার ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। তার নিজের কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ল। নিজে কম সুন্দরী ছিল না। একটা হাসি দিয়ে তরুণ লেকচারার দের বক্তৃতায় গোলমাল বাধাতে পারত। আপন মনে হেসে কামরুলকে বলল , এমন সুন্দরী একটি তরুণীকে এভাবে প্রত্যাখ্যান করতে একটুও চিন্তা করলে না ? খুব সুন্দরী বুঝি ? সাধু হয়ে গেলে নাকি ? কৌতুহলী দৃষ্টি দিয়ে কামরুল শম্পার দিকে তাকাল। ঐ দৃষ্টি এড়ানোর জন্য শম্পা বলল , তুমি মেয়েটাকে মিথ্যা বললে কেন ? কি আবার মিথ্যা বললাম ? ঐ যে আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা। মিথ্যা বলিনি তো! আজকেই ভাবলাম। মনে হচ্ছিল কতদিন ঘুরতে যাওয়া হয় নি। একবার ঘুরে আসলে হয়। কোথায় যাবে ? সেটা তোমার সাথে আলোচনা করে ঠিক করবো ভাবছিলাম । বাচ্চাদের মতামত টাও নিব ভাবছি। তাদের কোন পছন্দের জায়গা থাকতে পারে। দ্যাট্স লাইক আ গুড বয় , বলে শম্পা একহাত কামরুলের হাতে রাখল। কি ভয়ংকর ভাবেই না একটা দিন শুরু হয়েছিল আর কি দারুন সমাপ্তি । ঘুমন্ত কামরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে শম্পা ভাবতে লাগল। কি শান্তি নিয়েই না সে ঘুমোচ্ছে । একসময় সেও ঘুমিয়ে পড়ল। 2# কামরুলের ভোরে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস । সে যখন বিছানা ছাড়ল শম্পা ঘুমে অচেতন। ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা নিয়ে সে পড়ার ঘরে এসে বসল। গত রাতে সে স্বপ্ন দেখছে আবার । পুরো স্বপ্নই তার মনে আছে। স্বপ্নে সে আর শম্পা পরস্পরের হাত ধরে সমুদ্রের পাড় ধরে হাটছিল। একটা স্বাভাবিক স্বপ্ন । গতকাল বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছিল। তার ইচ্ছা সমূদ্রের কাছে যাওয়া । কিন্তু সে বলতে পারেনি । অন্য দের কি ইচ্ছা জানা দরকার । তার মনে হচ্ছিল অন্যরা হয়তো অন্য কোথাও যাওয়ার কথা বলবে। তার মনে যে একটা বৈরিভাব তৈরি হয়ে ছিল স্বপ্ন সেটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছে। তার এখন মনে হচ্ছে অন্য কোথাও গেলেও খারাপ হবে না। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে আগের স্বপ্ন গুলো নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করল। সব দেখা স্বপ্ন একটা একটা করে মনে করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। যতগুলি স্বপ্ন সে দেখেছে তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র সে অবশেষে সে খুজে পেল। তার সব স্বপ্নই মানব সভ্যতার বিকাশের এক একটা পর্যায়ের। বিভিন্ন সময়ের। তার স্বস্তি পাওয়ার কথা কারন তার বিষয়ই তো মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানো । কিন্তু অন্য একটি ভাবনা তার মধ্যে একটা অস্বস্তিই তৈরি করে দিল। স্বপ্নে সে যদি কেবল একজন দর্শক হত তাহলে সহজ সমাধানে সে আসতে পারত। ঐ সমস্ত বিষয়ে সে ভাবে বলে স্বপ্নে এসব দেখেছে। কিন্তু সে তো দর্শক ছিল না। বরং স্বপ্নে সেও একটা চরিত্র । এর কি ব্যাখ্যা ? রান্না ঘর থেকে টুং টাং আওয়াজ শুনে তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। শম্পা উঠে পড়েছে তাহলে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে চমকাল। এরই মধ্যে দুঘণ্টা চলে গেছে ! এরই মধ্যে ক্ষিদেটাও মোচড় দিয়ে উঠল। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রান্না ঘরের দিকে সে এগোল। শম্পা গত কালের বাসি বিরিয়ানি গরম করছে। কমারুল উৎফুল্ল স্বরে বলল ,বাহ্ বাসি বিরিয়ানির চাইতে মজার নাস্তা আর হতে পারে না। কামরুলের স্বর শুনে শম্পা পেছনে তাকাল। সে একটু লজ্জিত হল। বলল ,আমাকে জাগাওনি কেন ? তুমি এমন ভাবে ঘুমুচ্ছিলে জাগাতে ইচ্ছে করল না। আর অত ভোরে উঠে কি হবে ? বাচ্চারা তো কেউ নেই। আমারও কলেজ নেই । তুমি উঠেছ কখন? সবসময় যেরকম উঠি । এতক্ষণ খালি পেটে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছ ? আরে না। এটা মাত্র দ্বিতীয় সিগারেট । ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা বানিয়ে খেয়েছিলাম। তারপর একটা সিগারেট জ্বালিয়েছিলাম । এটা দ্বিতীয় । চায়ের সাথে কি খেয়েছিলে ? কিছু খায় নি তো। এমনি খালি চা। একদম খালি না খেয়ে দুটো বিস্কিট তো খেতে পারতে! সরি একদম ক্ষিদে ছিল না আর স্টাডি রুমে সময় টা যে কিভাবে কাটল সেটা বুঝতেই পারিনি। শম্পি বলল, যাও ,খাওয়ার টেবিলে বস। খাওয়ার টেবিলে শম্পা বলল , ঘুম কেমন হল ? ভাল । কোন স্বপ্ন দেখেছিলে ? রাতের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই লজ্জা পেল। চুপচাপ খেতে লাগল। কি হল উত্তর দিচ্ছ না কেন ? তেমন কিছু না। ওটা তোমার না জানলেও চলবে । সেটা আমি বুঝব। তুমি বল । বললাম তো তেমন কিছু না। খুব সাধারণ একটা স্বপ্ন । সাধারণ স্বপ্নটাই বল।কামরুল বলল। শুনতে শুনতে হাসিতে শম্পার মনটা কৌতুকে নেচে উঠল। মুখ যথাসাধ্য গম্ভীর রেখে বলল , বল কি ! এটা সাধারণ স্বপ্ন ? বুড়ো বয়সে স্বপ্নে প্রেম করে বেড়াচ্ছ ! শম্পার গলার স্বরে উচ্ছাসটুকু কামরুল বুঝতে পারল। সে একটা হাত শম্পার হাতে রাখল। কামরুলের হাতে মৃদু একটা চাপ দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়ে সে খেতে লাগল। রাতে শম্পার ভালো ঘুম হয় নি।রাতে এলোমেলো স্বপ্ন দেখে শেষ রাতের দিকে একটু ভাল ঘুম হয়েছে। গতকাল নিজের ভেতরের উদ্বিগ্নতা চাপা দিয়ে সারাদিন কষ্ট করে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছে। আজ কামরুলের স্বপ্ন বিবরণ শুনে মনটা একটু হালকা হল। কিন্তু মাংসের ব্যাপার টা মাথা থেকে যায় নি। স্বপ্ন গুলি এড়ানো যায় কিন্তু এটা যায় না। একজন মনোবিদের সাথে কথা বলতে হবে । অবশ্যই কামরুলকে না জানিয়ে । কেন জানি মনে হচ্ছে কামরুল বড় কোন সমস্যার ভেতরে আছে। কামরুল কে বললে হয়তো সে মনোবিদের কাছে যেতে রাজি হবে কিন্তু শম্পা আগে ব্যাপারটা বুঝতে চায়। বিকেলে একজন মনোবিদের এপোয়্যিন্টম্যান্ট নিল। সারাদিন কামরুলের উপর সতর্ক নজর রাখল। বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না। পুরো দিন কামরুল পড়ার ঘরে বসে কাটাল। মাঝে মাঝে তাকে খুব গম্ভীর হতে দেখল। একবার সে জিজ্ঞাসা করল, এত মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছ ? কামরুল বলল , স্বপ্ন গুলোর ব্যাখ্যা বের করতে চেষ্টা করছি। সে বলল , স্বপ্ন নিয়ে এত ভাবার দরকার কি। থাক না ,ছুটি নিয়েছ যখন ছুটির মতোই কাটাও। কামরুল বলল , ওগুলো মাথা থেকে যাচ্ছে না। আর ছুটি তো নিয়েছিই ওগুলো নিয়ে ভাবার জন্য ।একটা সমাধান বের করতেই হবে। কিছু পেয়েছ ? হ্যাঁ ,মনে হচ্ছে স্বপ্নে আমি মানব সভ্যতার বিভিন্ন সময়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এর মানে কি ? সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছি। ভাল মত ভাব। শোন বিকেলে আমি একটু বের হব ঘন্টা দুয়ের জন্য । তোমার কি কিছু লাগবে ? না। তুমি কোথায় যাবে ? একটু কেনাকাটা আছে। কামরুল আর জিজ্ঞাসা করল না কি কেনাকাটা । সংসারের কাজে সে কখনও আগ্রহী নয়। বলল ,কখন যাবে ? চারটার দিকে । আচ্ছা । কামরুল আর কথা বাড়ায়নি। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় শম্পা মনোবিদের চেম্বারে এসে পৌছায়। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে । কিন্তু মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। চোখ গুলি বুদ্ধিদীপ্ত । ঠোঁটে পুরু গোঁফ । গায়ের রং ফর্সা ।মনোবিদ ভদ্রলোক তাকে ইশারায় বসতে বললেন । শম্পা বসতে বসতে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , রোগী কোথায় ? শম্পা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি রোগী নই ? মনোবিদ হাসলেন । বললেন ,রোগী আপনার কে হন ? আমার স্বামী । তিনি কি করেন ? কলেজে পড়ান। কোন বিষয়ে ? সমাজবিজ্ঞান । এখন কোথায় ? বাসায়। ছুটি নিয়েছেন ? হ্যাঁ । কেন ? শম্পা মুগ্ধ হল। কীভাবে সে সমস্যার কথা বলবে ভেবে পাচ্ছিল না আর ভদ্রলোক কি সুন্দর ভাবেই না পথ তৈরি করে দিলেন । বলল , কয়েক দিন ধরে সে অদ্ভুত রকমের সব স্বপ্ন দেখছে। একারনে কলেজেও মনোযোগ দিতে পারছিল না। তাই ছুটি নিয়েছে। উনি কি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন ? হ্যাঁ ,তাই। মনোবিদ একটুক্ষন চুপ থেকে বললেন , উনার কোন বিষয়টা লক্ষ্য করে আমার কাছে এসেছেন ? শম্পা আর চমকাল না। সে মাংসের ব্যাপার টা বলল। কিন্তু মনোবিদ মনে হয় চমকাল। এতক্ষণের হাসিখুশি মুখটাতে অন্ধকারের ছায়া পড়ল। বললেন , উনার স্বপ্ন গুলো বলুন তো। শম্পা স্বপ্ন গুলো বলতে লাগল আর মনোবিদ গম্ভীর হতে লাগলেন ।শম্পার বলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন । তারপর বললেন , ঘটনা একটু জটিল মনে হচ্ছে । তবে সবকিছুরই একটা ব্যাখ্যা থাকে । এটারও ব্যাখ্যা আছে । শম্পা জিজ্ঞেস করল , কি ব্যাখ্যা ? সেটা এখন বলতে পারছি না। উনার সাথে কথা বলতে হবে। আপনার কি আপত্তি আছে ? না। আপনার স্বামী কি আসতে রাজী হবেন ? বললে সে হয়তো না বলবে না। তাহলে তো ভাল। আর হ্যাঁ ,মাংসের ব্যাপারটা তাকে না বলে ভালো করেছেন । জানলে তিনি হয়তো আপসেট হয়ে পড়তেন । আপনি তাকে একদিন নিয়ে আসুন । কখন আসব ? কয়েকটি দিন দেখুন আর কিছু ঘটে কিনা। হয়তো উনিই স্বপ্ন গুলোর একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে ফেলবেন । আর মাংসের ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র । খোদা করুক ,তাই যেন হয়। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে কামরুল ঘুমিয়ে পড়েছিল । গভীর ঘুমে অচেতন অবস্থায় সে নিজেকে আবিষ্কার করে জঙ্গলে । গায়ে পাতার পোশাক । কাঁধে একটা মৃত হরিণ। অন্যরা যেখানে তাদের শিকার জমা করেছে সেখানে হরিণটা রেখে হাতের বর্ষাটি নিয়ে সে রাখে শিকারের অস্ত্র গুলো রাখার জায়গায় । তারটি সে নিজে তৈরি করেছে। এখানে প্রত্যেকে যার যার নিজের অস্ত্র তৈরি করে। তারপর সে বিশ্রাম নিতে গেল । তাদের পুরো গোত্রের মানুষের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে মাটির উপর এক ধরনের পাতা বিছিয়ে । বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপরেও এক ধরনের ছাদের মতো ব্যাবস্থা । কিন্তু কোন পার্টিশান নেই । নারী ,পুরুষ ,শিশু ,বৃদ্ধ সবাই একসঙ্গে ঘুমায়। একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সে একপাশে শুয়ে পড়ে । আশেপাশে আরো নারীপুরুষ । এ সময় দূর হতে প্রথমে মৃদু তারপর বিকট শব্দে বজ্রপাতের আওয়াজ সে শুনতে পায়। তার পাশে থাকা মেয়েটি কি যেন বলছে। সে বুঝতে পারছে তার নাম মেয়েটি উচ্চারণ করছে । ক্ষীণ হতে ক্রমশ কণ্ঠটা বড় হচ্ছে । মনে হচ্ছে চারদিকে হট্টগোল । ধড়মড়িয়ে শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে সামনের জগত্ অদৃশ্য হয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করে পড়ার রুমের মেঝেতে। প্রথম কিছু বুঝতে পারে না । যখন পূর্ণ চেতনা ফিরে আসে তখন সে শুনতে পায় বাইরে থেকে কড়া নাড়ার আওয়াজ আর শম্পার কন্ঠ। সে বুঝতে পারে ঘুমের মধ্যে সে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেছে । ঐ অবস্থায় সে দরজা খুলে দেয়। শম্পা জিজ্ঞেস করে , কি করছিলে এতক্ষণ , কখন থেকে ডাকছি ? ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । আমিও তাই ভাবছিলাম । যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। বাইরে থেকে মাংস পরোটা নিয়ে এসেছি। শম্পা রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। শম্পা রান্না ঘরে গিয়ে প্লেটে মাংস পরোটা নিয়ে টেবিলে এসে দেখল কামরুল তখনো আসেনি । এই , কি করো ? কামরুল বাথরুমের ভিতর থেকে বলে ,এই তো আসছি। একটু পরে বেরিয়ে এসে টেবিলে বসল। শম্পা লক্ষ্য করে কামরুলের চোখ দুটো লাল। জিজ্ঞেস করে ,তোমার জ্বর এসেছে নাকি ? না তো। চোখ লাল হয়ে আছে । আবার স্বপ্ন দেখেছো ? না। কাঁচা ঘুম তো এজন্য মনে হয়। কামরুল বুঝতে পারছে না তার স্বপ্নের কথা বলা যায় কিনা। ও নিশ্চয়ই ঠাট্টা করবে । আজ কয়েক দিন পর সে আবার স্বপ্ন দেখল এবং পুরো স্বপ্ন তার কাছে স্পষ্ট । আর কোন স্বপ্ন এত স্পষ্ট ছিল না। সে লক্ষ্য করছে তার স্বপ্ন গুলো দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে আর দীর্ঘ হচ্ছে । সে বুঝতে পারছে সে অতীতের কোন সময়ে ফিরে যাচ্ছে স্বপ্নে এবং সেও তখন আদিম মানুষই। কিন্তু তা কি করে সম্ভব ? তোমার স্বপ্নের কোন ব্যাখ্যা পেয়েছ ? মনে হচ্ছে আমি বিভিন্ন সময়ে ঘুরছি। সে তো আগেও বলেছো। নতুন কি পেয়েছ ? একটা অনুমান যা অসম্ভব। কি অনুমান ? কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কে হাজার হাজার বছরের পুরনো স্মৃতি জমা আছে যা আমরা জানি না। সেটা তুমি কীভাবে জানলে ? আমার স্বপ্ন গুলো তো শুনেছ ? সবগুলো স্বপ্নই হাজার হাজার বছরের পুরনো কোন কোন সময়ের । ঐসব স্মৃতি আমার মস্তিষ্কে না থাকলে আমি কীভাবে দেখছি ? তুমি ঐসব বিষয় একদম জানো না তা তো নয়। বলতে চাইছ আমি ওগুলো জানি ,ছাত্র দের পড়াই ,নিজে ভাবি বলে দেখছি ? হ্যাঁ । কিন্তু স্বপ্নে যে আমি স্বাদও পাচ্ছি ? ওটা মস্তিষ্কের খেলা। আমাদের মস্তিষ্কের এত ক্ষমতা যে সে যেকোনো ধরনের অনুভূতি তৈরি করতে পারে। যেমন ? ধর আমি একদিন স্বপ্নে দেখলাম আমি মিষ্টি খাচ্ছি এবং আমি কিন্তু মিষ্টির স্বাদও পাচ্ছি। মিষ্টির স্বাদ তুমি পাচ্ছ কারন মিষ্টির স্বাদের অভিজ্ঞতা তোমার চেতনায় আছে । স্বপ্নে মস্তিষ্ক কেবল সেটা জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু আমার যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে তা আমার চেতনায় কখনও থাকার কথা নয়। কারন আমি আদিম যুগে কখনও বাস করিনি কিন্তু আদিম মানুষের অনুভূতি আমি ধরতে পারছি। কাঁচা মাছ এ জীবনে আমি কখনও খাইনি আর স্বপ্নে কাঁচা মাছের স্বাদ আমি পেয়েছি। শুধু এটাই নয় আরো অনেক কিছু । এটা কীভাবে তুমি ব্যাখ্যা করবে ? শম্পা একটু চুপ থেকে বলল ,তুমি কীভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছ তুমি কাঁচা মাছের স্বাদ বলছো সেটা সত্যিই কাঁচা মাছের স্বাদ ? তুমি তো কাঁচা মাছ কখনও খাওনি। এটা একটা পয়েন্ট । আসলেই তো ! আচ্ছা ,একবার পরীক্ষা করে দেখব নাকি ? মানে ? কামরুল থতমত খেয়ে বলল , একটু কাঁচা মাছ খেয়ে দেখার কথা ভাবছি। শম্পা চিৎকার করে বলল , পাগল হয়েছ তুমি !অনেক হয়েছে এবার স্বপ্ন ব্যাখ্যা বাদ দাও। স্বপ্নে আজগুবি কি সব দেখছ আর তা পরীক্ষা করার জন্য কাঁচা মাছ খাবে ? লোকে বলবে কি ? একবার ভেবেছ ? কামরুল শম্পার উত্তেজনায় একেবারে চুপসে গেল। মৃদু স্বরে যেন নিজেকেই বলল , ঠিক , কি আবোল তাবোল ভাবছি। সত্যি এ বিষয়ে একদম ভাবা উচিত নয়। কি করা যায় বলোতো ? শম্পা কি বলবে ভেবে পেল না। তার মনে হচ্ছে কামরুল নিজের অজান্তে পরীক্ষা ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে। মাংস খাওয়ার ব্যাপারটা এরই অংশ । বলল , কোন মনোবিদের সাথে একবার কথা বলে দেখবে নাকি ? তাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা থাকতেও পারে। কামরুল বলল ,বাদ দাও। এসব স্বপ্ন চিন্তাই বাদ। বাচ্চা দের নিয়ে আস ,আমরা বরং ঘুরেই আসি। শম্পা বলল , না ,আগে মনোবিদের সাথে কথা বল। নাহলে বেড়াতে গিয়ে তুমি স্বপ্নের কথাই ভাববে। অস্বস্তি তোমার পিছু ছাড়বে না। আচ্ছা ,তাই হবে। শম্পা বলল ,আমার পরিচিত একজন মনোবিদ আছে। তার সাথে একটা সাক্ষাতের ব্যাবস্থা করি। এই সময়টায় তুমি একটু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করো। আমি তো স্বাভাবিকই আছি। তোমাকে অস্বাভাবিক বলছি না। মাছ খাওয়ার চেষ্টা করে অস্বাভাবিক না হতে বলছি। কামরুল এ কথায় লজ্জা পেল।পরদিন মনোবিদের কাছে গেল দুজনে। মনোবিদ শম্পাকে বাইরে রেখে কামুলকে নিয়ে বসলেন। শম্পার সাথে তিনি ফোনেই যা কিছু জানার জেনে নিয়েছেন।
কামরুল বসে আছে মনোবিদের মুখোমুখি । তার সামনে কফির কাপ।
মনোবিদ বললেন , আপনার ধারনা মস্তিষ্কে হাজার বছরের পুরনো স্মৃতি জমা থাকতে পারে ?
কামরুল বলল , হ্যাঁ ,আমার ওরকম সন্দেহ হচ্ছে ।
আপনার কি মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা পুরোপুরি অযৌক্তিক ? মানুষের মধ্যে শুধু ততটুকু স্মৃতি জমা থাকে যতটুকু সে তার জীবনের অভিজ্ঞতায় পেয়েছে। শুনেছি মায়ের পেটে থাকা অবস্থার স্মৃতি পর্যন্ত মানুষের মস্তিষ্কে থাকে কিন্তু এর বেশি না। হাজার বছরের স্মৃতি থাকার পক্ষে আপনার যুক্তি টি কি হবে ?
কোন যুক্তি নেই ,কিন্তু গত কয়েকদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সন্দেহ হচ্ছে ।
মনোবিদ একটু চুপ থেকে বললেন , আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে আমাদের এখনো অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে। বলতে গেলে সামান্য কিছুই আমরা জানি। শুধু এটার উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা একটা বড় ধরনের ঝুঁকি নেয়া হবে না আপনার জীবনের উপর । আপনি পুরোপুরি অন্য একদিকে চলে যাবেন । বাস্তব জীবন থেকে দূরে চলে যাবেন ?
এ কথা কেন বলছেন ?
আমার মনে হয় আপনি বুঝতে পারছেন কেন বলছি । বলে মনোবিদ ভদ্রলোক জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে তাকালেন ।
কামরুল উত্তর দিল না। কিন্তু কঠোর মুখে তাকাল।
মনোবিদ ভদ্রলোক যেন নিজেকে বলছেন এমনভাবে বললেন , পৃথিবীতে অনেক বড় বড় সাধক ধ্যানে মগ্ন হয়েছেন। তাঁরা তাদের চেতনার গভীরে ডুব দিয়েছেন । এ ধরনের কোন ব্যাপার যদি থেকে থাকে তবে কি তাদের কাছে ধরা পড়ত না! বলে কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে কামরুল কে প্রশ্ন করলেন , আমার এ পয়েন্ট টা কি আপনার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে না ?
কামরুল বলল ,মনে হচ্ছে ।
মনোবিদ ভদ্রলোক বললেন , আপনি আদিম মানুষের মনোভাব বুঝতে পারছেন বলে যেটা মনে করছেন সেটা আদিম মানুষের হবে কেন ! আদিমতা আবার কি , সভ্য জগতে বাস করেও আমাদের ভেতরে বুনো প্রবৃত্তি থেকে গেছে তো। কখনও কখনও সেটা বের হয়ে আসে। আদিম মানুষ যেমন অন্য গোত্রের মানুষ হত্যা করত তেমনি আমরাও তো সভ্যতার চুড়ায় বসে প্রতিপক্ষ মানুষকে হত্যা করে যাচ্ছি। কাজেই আদিমতা আমাদের ভেতরে রয়েছে । স্বপ্নে আদিম অনুভূতি আসা এমন কিছু কঠিন নয়। আপনি কি বুঝতে পারছেন ?
কামরুল বলল ,হ্যাঁ ।
মনোবিদ ভদ্রলোক বললেন , আমার কথা আপনি মানতে চাইছেন না মনে হচ্ছে । আপনাকে একটা তথ্য দিতে চাইছিলাম না আপনি আপসেট হবেন বলে কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার জানা দরকার ।
কামরুল বলল , কি তথ্য ?
মনোবিদ একটু চুপ থেকে তারপর মাংস খাওয়ার ঘটনা বললেন ।
কামরুল সত্যিকার অর্থেই বিরাট ধাক্কা খেল। মনোবিদ তাকে একটু সামলে ওঠার সময় দিয়ে বললেন , আপনার স্বপ্নে কাঁচা মাছের স্বাদের একটা ব্যাখ্যা কি এখান থেকে আসতে পারে না ? আপনি স্মৃতির ব্যাপারটা অনেক আগে থেকেই ভাবছেন । এরকম আনমনা হয়ে কাঁচা মাংস খাওয়ার মত হয়তো কাঁচা মাছও খেয়েছেন কোন দিন যেটা কারও চোখে পড়ে নি !
মনোবিদ ভদ্রলোক হেসে কামরুলের দিকে তাকালেন ।
কামরুল মনোবিদের মনের কথাটা যেন বুঝতে পারল ,মনোবিদ ভাবছে -ব্যাটাকে এবার বেশ ঘায়েল করা গেল । কামরুল মনোবিদের যুক্তিটা না নিয়ে ভাবল তারচেয়ে এটাও তো হতে পারে যে শম্পাকে যেমন সে কাঁচা মাছ খেয়ে পরীক্ষা করার কথা বলছিল হয়তো অজান্তে কাঁচা মাংস খেয়ে ছিল সে পরীক্ষা করার জন্যই । এ ধরনের পরীক্ষা করার কথা বলার পর শম্পার প্রতিক্রিয়া তো সে দেখেছেই। সে নিজেও হয়তো সচেতন ভাবে এরকম করতে পারত না বলে অবচেতনে করে ফেলেছে । আর যার কারণে স্মৃতির ব্যাপারে নিজের অনুমান বলে যেটা সবাইকে বলছে সেটার উপর অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী !
তাকে এবার সাবধান হতে হবে। স্বপ্নগুলো আরও দীর্ঘায়িত করতে হবে। এতদিন পর্যন্ত যেসব স্মৃতি সে পেয়েছে তা সবই লৌহ যুগের কাছাকাছি । আরও পিছনে যেতে হবে। প্রস্তর যুগ , বরফ যুগ আরও পেছনে । এতদিন বইয়ের পাতায় পড়ে কি জানত আর এখন নিজে ঘুরে কি জানতে পারল তা কখনও কাউকে বোঝানো যাবে না। দেখা যাক কি হয়।
কিন্তু এখন মনোবিদের সাথে সে আলোচনায় যাওয়ার কোন মানে নেই । তাই তার সব কথা মেনে নেয়া উত্তম বলে ভাবল। বলল , হ্যাঁ , সেরকম হওয়ার কথা ।
মনোবিদ বললেন ,কথা কেন ? সেটাই সঠিক । এটা আপনাকে নিতে হবে এবং আপনি বরং কয়েক দিন ছুটি কাটান। এখনি কলেজে যাওয়ার দরকার নেই । ঐসব বিষয় থেকে দূরে থাকুন । বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে আসুন । বলে তৃপ্তির নিয়ে হাসলেন। ঐ হাসিতে কামরুলের যেন গা জ্বলল। বলল , ধন্যবাদ আপনাকে । বলে উঠে দাঁড়াল । তারপল হাত মিলিয়ে বের হয়ে আসল।
আসার পথে শম্পার সাথে স্বাভাবিক ভাবে গল্পও করল। মাংস খাওয়ার ঘটনা তাকে জানায়নি বলে একটা খোঁচা দিতেও ছাড়ল না।
শম্পাও অনেক হালকা বোধ করল।
3#
কয়েক দিন কেটে গেল। কামরুল আর স্বপ্নের নিয়ে চিন্তাও করছে না। বলতে গেলে মনে হয় সব মাথা থেকে ফেলে দিয়েছে। নিয়ম করে ঘুমোচ্ছে ,ঘুম থেকে উঠে পড়ার ঘরে বসে বই পড়ছে । শম্পাকে বাচ্চাদের আনার কথাও বলছে। কিন্তু শম্পা এখনই ঠিক সাহস পাচ্ছে না। আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করে আনবে । এরই মধ্যে একদিন সেই তরুণীটি আসল। জানালা থেকে গেট ঠেলে ঢুকতে কামরুলই দেখল। সে শম্পাকে বলল ,বলে দাও, আমি বাসায় নেই । ঐটাই শুধু একটু অস্বাভাবিক লেগেছিল শম্পার কাছে । পরে অবশ্য ভেবেছিল হয়তো কলেজের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইছিল না বলে হঠাত্ কামরুল ওরকম আচরণ করেছিল । শম্পা অবাক হয়ে বলেছিল ,শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন ? কামরুল যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলল , ঠিক তো। আসুক , দেখি কি বলতে এসেছে ।
কামরুল স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েটির সাথে কথা বলল। মেয়েটি নাকি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গেট খোলা দেখে কুতূহলী হয়েছিল। কামরুলের ছুটি বাড়ানোর কথা সে কলেজেই জেনেছিল । ভেবেছিল তারা বেড়াতে চলে গেছে । তাই।
সবকিছু যেন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে । বাচ্চা দের আনার কথা ভাবছে।এমন একদিন পাথর ঠুকার শব্দে শম্পার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল কেউ পাথরের সাথে পাথর ঠুকছে। শব্দের উৎস অনুসরণ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে যা দেখল তাতে শম্পার অন্তরাত্না কেঁপে উঠল।
কামরুল বাগানের এক ধারে কতগুলো শুকনো পাতা জড়ো করে তাতে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছে । তার পাশে মরা একটা বক আর তির -ধনুক পড়ে আছে ।।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৩:২৪