somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছবি ব্লগঃ ভাস্কর্যের পেছনে সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গল্প

২৭ শে জুন, ২০২১ দুপুর ১২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য । কিছু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে অন্যায়-অবিচার এর বিরুদ্ধে রুকে দাড়াঁনোর প্রতীক হিসেবে। আবার কিছু ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে ব্যক্তি বিশেষ কে সম্মান জানিয়ে । এসব ভাস্কর্য বহন করে দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংগ্রামী ইতিহাস ও দেশের প্রতি সম্মানিত ব্যক্তিদের অকুন্ঠ অবদান । জানা অজানা এই সব ভাস্কর্য নিয়ে আজকের ছবি ব্লগ ।

মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র ভাস্কর্য
স্থানঃ চন্দ্রনাথ পাহাড়, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।

১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যরা উপজেলার ছোট দারোগাহাট থেকে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ শুরু করেন। যুদ্ধ করতে করতে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় পৌঁছান ১৬ ডিসেম্বর। আর পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী। বিকেলে যখন বিজয়ের ঘোষণা আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় উল্লাস করতে থাকেন। অনেকে তাঁদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যান। এমন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় অর্ধশতাধিক ভারতীয় সেনা ও বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ফলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়, চলে ১৭ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত। ১৭ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। ভারতীয় সেনাদের তখন চন্দ্রনাথ পাহাড়ের নিচে গজারিয়া দিঘির পাড়ে দাহ করা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জীবন উৎসর্গকারী ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অর্ধশতাধিক সদস্যের স্মরণে নির্মিত ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ ভাস্কর্য। মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে চন্দ্রনাথ ধাম তীর্থের হনুমান মন্দিরের কাছেই। ভাস্কর্যটির পেছনে স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশের মানচিত্র রয়েছে। ভাস্কর্যটির সামনে করা হয়েছে ফুলের বাগান। মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র নির্মাণে ২৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।


কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
স্থানঃ ঢামেক, ঢাকা ।

শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থিত।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছিল অতিদ্রুত এবং নিতান্ত অপরিকল্পিতভাবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে রাত্রির মধ্যে তা সম্পন্ন করে। শহীদ মিনারের খবর কাগজে পাঠানো হয় ঐ দিনই। শহীদ বীরের স্মৃতিতে - এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর।
মিনারটি তৈরি হয় মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘেঁষে। উদ্দেশ্য বাইরের রাস্তা থেকে যেন সহজেই চোখে পড়ে এবং যে কোনো শেড থেক বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া। ডিজাইন করেছিলেন বদরুল আলম। সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালি এবং পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি। ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়, এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়।

বর্তমানে আমরা যে শহীদ মিনার দেখছি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই শহীদ মিনারের স্থপতি হামিদুর রহমান। ১৯৫৭ সালে নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে চূড়ান্ত নকশা তৈরি করে শুরু করা হয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ। এরপর ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। সেই থেকে এখনো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে গৌরবের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বাঙালি জাতির কাছে উজ্জ্বল করে রেখেছে ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদ দের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানায় অসংখ্য মানুষ।


জাতীয় স্মৃতিসৌধ
স্থানঃ নবীনগর, সাভার , ঢাকা ।

ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ কি. মি. দূরে সাভার থানার নবীনগরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ অবস্থিত। এ স্থানটি নির্বাচনের অন্যতম কারণ ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে অনেক গণকবর আবিস্কৃত হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
অধিগ্রহণকৃত ৮৪ একর জমির মাঝে প্রায় ৬৪ একর জুড়ে রয়েছে সবুজ ভূমি। ৪০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে স্মৃতিসৌধ। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৮২ সালের আগষ্ট মাসে সৌধের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধের মূল কাঠামোর নকশা তৈরি করেন স্থপতি মইনুল হোসেন। কংক্রিট নির্মিত ৭ টি ত্রিভূজাকৃতির স্তম্ভ দিয়ে মূল সৌধ গঠিত, যা ছোট হতে ধীরে ধীরে উচু হয়ে উপরে উঠে গেছে। এর উচ্চতা ১৫০ ফুট
প্রথম স্তম্ভটির উচ্চতা কম হলে ও প্রস্থে সবচেয়ে বড়। এটিকে আন্দোলনের সূচনা অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বোঝানো হয়েছে। পরবর্তী স্তম্ভগুলো দ্বারা যথাক্রমে ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ কে বুঝানো হয়েছে। সর্বোচ্চ স্তম্ভটির দ্বারা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে বুঝানো হয়েছে।

এই স্মৃতিসৌধের বৈশিষ্ট্য হলো এক এক দিক থেকে এক এক রকম আকৃতির মনে হয়। এটি শুধু স্মৃতিসৌধ নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স। এখানে রয়েছে আকর্ষণীয় প্রশস্থ প্রবেশ পথ, গাড়ি পার্কিং এর সুব্যবস্থা। প্রবেশ পথের দু'পাশে নানা জাতের ফুলগাছ পাশেই আছে কৃত্রিম জলাশয়, যেখানে স্মৃতিসৌধ ছবি প্রতিফলিত হয়। আরো রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ, সেতু, ফুলের বাগান, অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও হেলিপ্যাড, মসজিদ, রেস্তোরা এবং একটি মনোরম সবুজ–শ্যামল বনানী। এ বনানীতে দেখা যায় নানা জাতের ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের সমাহার। আধুনিক স্থাপত্য নকশার এক অপূর্ব নিদর্শন এ স্মৃতিসৌধ দেখার জন্য সারা বছর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকের ভিড় লেগে থাকে ।


স্বাধীনতা স্তম্ভ
স্থানঃ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা ।

স্বাধীনতা স্তম্ভ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে নির্মিত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অভ্যন্তরভাগে নির্মাণ করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর পাশে স্থাপিত শিখা চিরন্তন-এর বরাবর দক্ষিণ দিকে এটির অবস্থান। ভূমি থেকে কিছুটা ওপরভাগে নির্মিত একটি প্রশস্ত চৌকো কংক্রিটের চাতালের দক্ষিণ পাশে এটির অবস্থান। এই চাতালের পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি কৃত্রিম জলাধার এবং পূর্ব পাশে রয়েছে টেরাকোটায় আচ্ছাদিত একটি অনতিউচ্চ দেয়াল যার পেছনেই ভূগর্ভস্ত স্বাধীনতা জাদুঘর-এ যাওয়ার সিঁড়ি। সন্ধ্যা বেলায় কাঁচ নির্মিত স্তম্ভটি একটি আলোকস্তম্ভে পরিণত হয়। এ থেকে বিচ্ছুরিত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোক রশ্মি চারপাশের আকাশকে আলোময় করে তোলে।

স্বাধীনতা স্তম্ভটি বস্তুত ১৫০ ফুট উচ্চ একটি গ্লাস টাওয়ার। গ্লাস টাওয়ারে স্থাপিত লাইটের আলোকরশ্মি ৫ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে প্রক্ষেপিত হয়।তিনি বলেন, বাঙালির জাতীয় জীবনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে সুগভীর তাৎপর্য, তার সঙ্গে সংগতি রেখেই সুউচ্চ স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং গগনচুম্বী আলোকরশ্মি মালার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই অনিন্দ্য সুন্দর স্বাধীনতা স্তম্ভের স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম


বিজয় '৭১ (ভাস্কর্য)
স্থানঃ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ।

ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য 'বিজয় ৭১'। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের প্রবেশপথেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনেই স্মৃতিসৌধটি স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, মুক্তিকামী মানুষের অঙ্গীকার এবং দৃঢ় প্রত্যয় এই স্মৃতিসৌধের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। এই তিনটি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে একটি বেদীতে। এই বেদীর দেয়াল জুড়ে আছে পোড়া মাটিতে খোদাই করা মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনাবলি। বেদীর সমানে রয়েছে অর্ধচন্দ্রাকার আঙিনা। এই আঙিনায় উঠার জন্য রয়েছে তিনধাপের সিঁড়ি।

এই ভাস্কর্যটিতে তিনটি মূর্তি বিপরীত দিকে মুখ করে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তি তিনটি হলো একজন নারী একজন কৃষক এবং একজন ছাত্র। এই তিনজনই মুক্তিযোদ্ধা। কৃষক বাংলাদেশের আকাশের দিকে তাঁর রাইফেল তুলে ধরেছেন। এই রাইফেলের মাথায় রয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের বার্তা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার কথা।

সংগ্রামী কৃষকের ডান পাশে আছেন শাশ্বত বাংলার সর্বস্বত্যাগী ও সংগ্রামী নারী। যিনি দৃঢ়চিত্তে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছেন। এই নারীর হাতেও রয়েছে রাইফেল। তাঁর দৃঢ়দৃপ্ত পদক্ষেপে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাতৃশক্তির প্রকাশ। এই নারীর পাশে রয়েছে একজন তেজোদীপ্ত চিত্তে দণ্ডায়মান যোদ্ধা ছাত্র। তার ডান হাত গ্রেনেড ছোড়ার ভঙ্গিমায় রয়েছে, আর তার বাম হাতে রয়েছে রাইফেল

এই ভাস্কর্যটির শিল্পী শ্যামল চৌধুরীর। শিল্পীর তত্ত্বাবধানে ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। সম্পন্ন হয়েছিল ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে শেষ হয়। ভাস্কর্যটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ২৪ লাখ টাকা।


মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলা
স্থানঃ কলা ভবন, ঢাবি, ঢাকা ।

স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সুতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অবস্থিত ভাস্কর্যটির নাম অপরাজেয় বাংলা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নিবেদিত একটি ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি বিষয়বস্তু তিনজন দণ্ডায়মান মুক্তিযোদ্ধা
এটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরণটি করেন মুক্তিযাদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী
১৯৭২ সালে কলা ভবনের সামনে ভাস্কর্যটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কাজ শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। আর ১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে অপরাজেয় বাংলা উদ্বোধন করা হয়।

৬ ফুট বেদীর উপর নির্মিত ভাস্কর্যটির উচ্চতা ১২ ফুট, প্রস্থ ৮ ফুট ও ব্যাস ৬ ফুট। এতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ও আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়। সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের প্রতীক ‘অপরাজেয় বাংলা’।

এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। চোখমুখ স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারীমূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ।

১৯৭৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় এ ভাস্কর্যের উদ্বোধন করা হয়। তবে অপরাজেয় বাংলার কাছে ভাস্করের নাম খচিত কোনো শিলালিপি নেই। স্বাধীনতার এ প্রতীক তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন গুণী শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বেদীতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে দেশে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কালক্রমে ভাস্কর্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের অন্যতম পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।


অঙ্গীকার
স্থানঃ চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর ।

মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কে লেকের উপর স্বাধীনতা যুদ্ধে চাঁদপুরের শহীদের স্মরণে ১৯৮৯ সালে এ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য অঙ্গীকার নির্মিত হয়। যার স্থপতি প্রফেসর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। এর উদ্বোধক ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এটি চাঁদপুর কেন্দ্রীয় স্মৃতিসৌধ হিসেবে বিবেচিত। প্রতি বছর মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসের সূচনায় অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিটে এ ‘অঙ্গীকার’ বেদীতে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গীকৃত বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।


সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য
স্থানঃ টিএসসি, ঢাবি, ঢাকা ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়টি ভাস্কর্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে রাজু ভাস্কর্য। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি চত্বরে অবস্থিত। পথচারী তো বটেই, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত এ ভাস্কর্যের ইতিহাস জানে না। অনেকে মনে করে, এটি মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনের একটি স্মারক। কিন্তু এই ভাস্কর্যর আসল ইতিহাসটি প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষই জানে না।

উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ তদান্তিন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহের জোট গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে মিছিলের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু নিহত হন। রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় এই ভাস্কর্যটি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মইন হোসেন রাজু ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। কিছুটা একরোখা, জেদি অথচ আশ্চর্যরকম সরল রাজু ছিল সেই স্বপ্নবানদের একজন, বলা যায় মধ্যমণি। সকলের প্রিয়। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতো তারা মোটামুটি একই রকম হলেও রাজু ছিল একটু আলাদা। সে ছিল অন্য সবার চেয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র টিএসসি’র মোড়ে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি ১৬ ফুট দীর্ঘ, ১৪ ফুট প্রশস্ত এবং ১০ ফুট উঁচু। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যটি আট জন নারী-পুরুষ একে অন্যের হাত ধরে সন্ত্রাসদের বিরুদ্ধে ঐক্য এবং হার না মানা মুখাবয়ব প্রকাশ করছে। সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য এখন আর শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন দেশের সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার প্রেরণায় রূপান্তরিত হয়েছে।


স্বাধীনতা ভাস্কর্য , বিপ্লব উদ্যান
স্থানঃ ষোলশহর ২ নম্বর গেট, চট্টগ্রাম ।

১৯৭৯ সালের ১৯ এপ্রিল স্থাপিত হয় পার্কটি। এই স্থানটিতেই নাকি বিপ্লবের মূলমন্ত্র নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হযেছিলো। তাই পার্কটির নামকরণ করা হয় বিপ্লব উদ্যান নামে।


স্মৃতিসৌধ ‘রক্তধারা’
স্থানঃ তিন নদীর মোহনা, বড় স্টেশন, চাঁদপুর ।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর শহরের পশ্চিম প্রান্তে মেঘনা ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় পুরাণবাজার এবং বড় স্টেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কয়েকটি নির্যাতন কেন্দ্র (টর্চার সেল) স্থাপন করে। নৌকা-লঞ্চ-স্টিমার ও রেলগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে যারা চাঁদপুরে পৌঁছাতো, সন্দেহ হলে তাদেরকে এবং জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন ও নারীদের এই টর্চার সেলে নিয়ে এসে অমানুষিক নির্যাতন করে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত, অর্ধমৃত অথবা হত্যা করে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর খর স্রোতে ফেলে দিতো। হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসররা এ হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করতো। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার শহীদের স্মরণে ২০১১ সালে মোলহেডের সন্নিকটে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ ‘রক্তধারা’। এ স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।


বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য
স্থানঃ সোনারগাঁও জাদুঘর, নারায়ণগঞ্জ ।

৭ মার্চ ১৯৭১: ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণটি এই ভাস্কর্য এর মূল থিম ।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে স্থবির ছিল ঢাকা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে সকাল থেকেই লাখো জনতা সমবেত হতে থাকেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)। ঢাকার আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালিরা এসেছিলেন তার ভাষণ শুনতে।
বেলা সোয়া ৩টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাস্থলে উপস্থিত হন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি ও কালো কোট (মুজিব কোট) পরিহিত শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে জনতা করতালি ও ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের মধ্য দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়।
তৎকালীন রেসকোর্সের জনসমুদ্রে ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমরা যখন মরতে শিখেছি; কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”


রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য
স্থানঃ এম এ আজিজ স্টেডিয়াম, কাজির দেউরি, চট্টগ্রাম ।

১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রাম সার্কিট সাউসে নিহত হন। ব্রিটিশ আমলে তৈরি চট্টগ্রামে পুরাতন সার্কিট হাউসকে গড়ে তোলা হয়েছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাদুঘর হিসেবে। সামনে রয়েছে তার বিশাল ভাস্কর্য । জিয়ার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসকে ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার জিয়া স্মৃতি জাদুঘরে পরিণত করে।
২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমানের নামে এ ভাস্কর্যটি স্থাপন করে নতুন আঙ্গিকে ‘জিয়া স্মৃতি জাদুঘর’-এর সংস্কার কাজের উদ্বোধন করেন।

আরো ছবি ব্লগঃ
সবুজের মিতালী মনে আনে প্রশান্তির ঢালি
জীবন যেখানে যেমন


তথ্য সূত্রঃ
http://www.dhaka.gov.bd
http://savar.dhaka.gov.bd
https://bn.wikipedia.org
https://www.banglanews24.com
https://www.channelionline.com
http://onushilon.org
http://www.chandpur.gov.bd
https://www.bd-pratidin.com
https://www.prothomalo.com
https://www.kalerkantho.com
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২১ দুপুর ১২:৪০
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×