□ পরিবর্ধিত সংষ্করণের ভুমিকার শুরুতে লেখক বলেছেন-
‘‘ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন বিন্যাস’ রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল উনিশ শ’ বাহাত্তর সালে। এখন উনিশ শ’ সাতানব্বই। এরই মধ্যে পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। যখন লেখাটি প্রকাশিত হয় আমার বয়স বড়জোর আটাশ। বিগত পঁচিশ বছরে এই লেখাটির অনেকগুলো সংস্খরণ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমাকে এই লেখাটি লিখতে বাধ্য করেছিল। দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সতেরোটি কিস্তিতে আমি লেখাটি লিখি। পরে বই আকারে প্রকাশ করি। গ্রন্থকারে প্রকাশিত হওয়ার পর লেখাটি নানা লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বিশেষকরে রাজনীতি সচেতন তরুণদের কাছে লেখাটি আশাতীত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই পুস্তকে প্রকাশিত নানা মন্তব্য পাঠকদের মধ্যে এত সাড়া জাগিয়ে তুলেছিল, সেকালে তাঁরা এখনো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে থাকেন।’ ’’ (সংক্ষেপিত)
আহমদ ছফা
১৫ আগষ্ট, ১৯৯৭
৭১ আজিজ সুপার মার্কেট
শাহবাগ, ঢাকা- ১০০০
□ প্রথম সংষ্করণের ভুমিকা
প্রথম সংষ্করণের ভুমিকায় বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন-
“ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন বিন্যাস’ এর লেখক আহমদ ছফা বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের কতকগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁদের বিশিষ্ট মানসিকতার বিবর্তনের ধারা এই প্রবন্ধ সংকলটিতে কিছুটা আলোচনা করেছেন। এই আলোচনাকে মূলত বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদেরই একজনের স্বশেণীর বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদের একটা ঝোঁক যে তাঁদের একটা শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য এ বিষয়ে এই তরুণ লেখকের যে কিছুমাত্র সংশয় নেই সেটা তাঁর লেখায় প্রতিটি ছত্রে সুস্পষ্ট, কিন্তু তবু তিনি স্বদেশের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক সুবিধাবাদিতায় নিদারুণভাবে বিক্ষুদ্ধ।
তাঁর এই বিক্ষোভের কারণ একদিকে মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে সুবিধাবাদের সাধারণ আবহাওয়ার মধ্যে থেকেও কোন কোন ক্ষেত্রে পুরোপুরি এবং অনেক ক্ষেত্রে আংশিকভাবে সুবিধাবাদ উর্ত্তীণ হতে সক্ষশ, এই ধারণার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের এই শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাস্তব কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে একটা সামগ্রিক ও দিগন্তপ্রসারী সুবিধাবাদের অবাধ রাজত্ব। বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ সুবিধাবাদের পাশাপাশি তাঁদের একাংশের সুবিধাবাদ উত্তীর্ণতার যে সন্ধান তিনি করেছেন সেই সন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার মধ্যে তাঁর বিভিন্ন বিক্ষুদ্ধ মন্তব্যের মর্মকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং সে চেষ্টা করলে বর্তমান বাংলাদেশে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংষ্কৃতিক সংকট শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন-মধ্যশ্রেণীভুক্ত জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত ও বিধস্ত করছে তারও কতকগুলো মূলসূত্রের সন্ধান এ প্রবন্ধগুলোর মধ্যে পাওয়া যাবে। ” (সংক্ষেপিত)
বদরুদ্দীন উমর
৩-১২-৭২
প্রথম সংষ্করণের ভুমিকায় ডক্টর আহমদ শরীফ লিখেছেন-
দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ যখন বিলাপে, স্মৃতিচারণে, কৃতিত্বের রোমন্থনে কিংবা চাটুকারিতায় নিরত, অথবা প্রাণভয়ে বিব্রত, তখন আহমদ ছফা 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস', চিন্তায় নিষ্ঠ। সংগ্রামোত্তর দলিত জীবনে প্রাণশক্তির উন্মেষ ও ঋদ্ধির এবং মনন বিকাশের আবশ্যিকতা এমনি করে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আর কেউ ভাবেনি।
আহমদ ছফা বয়সে কাঁচা, মনে পাকা, সঙ্কল্পে অটল। দৃষ্টি তার স্বচ্ছ, বাক্য তার ঋজু, বক্তব্য স্পষ্ট, উদ্দেশ্য তার সাধু। মাটি এবং মানুষের প্রতি প্রীতিই তার কল্যাণকামিতা ও কর্ম্প্রেরণার উৎস এবং তার প্রাণ শক্তির আকর। এজন্যই ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে সে সত্য কথা বলার সৎসাহস রাখে। এবং গুণই তাকে আজকের লিখিয়ে-বলিয়েদের সমাজে অনন্য করেছে। লিখিয়ে হিসেবে সেও শেলীর মত বলতে পারে - fall upon the thorns of life, I bleed, অথবা, নজরুলের মত সেও যদি বলে,
"গাহি গান, গাঁথি মালা, কন্ঠ করে জ্বালা,
দংশিল, সর্বাঙ্গ মোর নাগ নাগ বালা।"
তবে অত্যুক্তি হয় না। সুবিধাবাদির Life is a compromise তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরও কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়সেয় পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।
মানববাদী ছফার 'সূর্য তুমি সাথী', 'নিহত নক্ষত্র', 'ওঙ্কার', 'জাগ্রত বাংলাদেশ' যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা 'বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস' - এর তাৎপর্য ও গোড়ার কথা সহজেই বুঝবেন এবং সংস্কৃতি-প্রাণ, মানবদরদী ছফাকে উগপ্রগতিবাদী বলে ভুল করবেন না। হিতচেতনাদানই এ গ্রন্থের লক্ষ্য, যা ছফা বা যে-কোন সৎলিখিয়ের কর্তব্য।
ডক্টর আহমদ শরীফ
বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডিসেম্বর, ১৯৭২
লেখকের জবানবন্দি-
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এত অন্যায়, অবিচার এত মূঢ়তা এবং কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলে না। এই স্বল্পপরিসর গ্রন্থে যা বলছি সব আমার কথা নয়। হামেশাই যা আলোচিত হতে শুনেছি তাই-ই একটু জোর দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে বলবার চেষ্টা করেছি। তাও সবসময় পেরেছি তেমন দাবি করতে পারব না। সৎ সাহসকে অনেকে জ্যাঠামি এবং হঠকারিতা বলে মনে করে থাকেন, কিন্তু আমি মনে করি সৎ সাহস হল অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা যথাযথভাবে দেখতে পারার ক্ষমতা।
এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের যাবতীয় তত্ব এবং তথ্য আমি কোথাও না কোথাও থেকে আহরণ করেছি, কেবল উচ্চকন্ঠে উচ্চারণ করার সাহসটুকুই আমার ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। দৈনিক ‘গণকণ্ঠে’ যখন লেখাটা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল অনেকে প্রশংসা করেছেন, অনেকে নিন্দা করেছেন! নিন্দা-প্রশংসার প্রত্যক্ষ কারণ বলে আমি মনে করি, অসংকোচে আমাদের সংষ্কৃতির কতিপয় প্রখ্যাত অমানুষের নাম-সাকিন উল্লেখ করতে পেরেছিলাম। কুৎসার প্রতি মানব সাধারণের মমতা সুবিদিত। বই আকারে বের করার সময় নামগুলো ছেটে দিলাম। সুযোগ সন্ধানীরা অল্প-বিস্তর চিরকাল থাকে। মোটা বুদ্ধি, ভোঁতা অনুভুতি, পুরো চামড়াই তাদের টিকে থাকার মূলধন। তার বাইরেও দেশের মানুষের হয়ে, অকৃত্রিমভাবে কিছু অনুভব করতে চেষ্টা করেছি। (সংক্ষেপিত)
আহমদ ছফা
২০৬ আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৫-১২- ১৯৭২
● একনজরে…
বইয়ের নামঃ সাম্প্রতিক বিবেচনা- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস
লেখকের নামঃ আহমদ ছফা
প্রকাশক: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৭
দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুযারি ২০১১
প্রচ্ছদ: মোবারক হোসেন লিটন
ঘরানার: প্রবন্ধ সংকলন
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৩
মূল্য : ১২৫ টাকা
ভাষা: বাংলা
ISBN: 984-408-137-8
বইয়ের রেটিং (ব্যক্তিগত) : ৫ এ ৫
■ বইয়ের রিভিউ:
গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়ার অভ্যাস বেশি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ বই পড়ি, তবে তার পরিমান খুব কম। অনেকের মুখে শুনেছি আহমদ ছফার লেখার গাধুঁনি অনেক মজবুত।
চোখের দৃষ্টিতে পড়েনি কিংবা হাতের কাছে পাইনি বলে পড়বো পড়বো বলে পড়া হয়নি এতদিন। যাইহোক অবশেষে সেই গুনি মানুষটার বই হাতে পেলাম । দেরি করলাম না অদ্ভুত এক টান নিয়ে পড়া শুরু করেদিলাম।
যখন বইটি পড়া শুরু করলাম উপন্যাস কিংবা গল্পের বই যেমন শেষ না করে উঠা দায় ঠিক তেমটি উনার এই প্রবন্ধ সংকলনটি আমাকে মোহবিষ্ট করলো। যতই পড়ছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। তিনি যে সময়ে যে চিন্তা গুলো সরল মনে প্রকাশ করেছেন বর্তমান সময়ে এসেও তার পরিবর্তন হয়নি।
এখনো আমরা সেই গুনে ধরা, মরিচা পড়া কলুষিত সমাজ, সরকার আর লেজুড় বৃত্তির গোলকধাঁধা থেকে বের হতে পারিনি। আপনি যখন বইটি পড়বেন। আজকের বাস্তবতার সাথে কোন অমিল খোঁজে পাবেন না। অবাক হবেন স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা চিন্তার স্বার্থপরাতা, আর নিচু মানসিকতা থেকে দুরে থাকতে পারিনি। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পারিনি।
ছফা কেবলমাত্র তা-ই লিখতেন যা তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন। ভান ধরা বা কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা তিনি একদম পছন্দ করতেন না। আমাদের দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য লিখতেন তিনি, তাদের প্রতিনিধিত্ব করেই লিখতেন তিনি। লেখালেখি ছিল তার নেশা।
ছফার গভীর চিন্তাশীলতার প্রতিফলন ঘটেছে তার উল্লেখযোগ্য রচনা ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ (১৯৭৩) গ্রন্থে। এ বইটি বিশেষ চিন্তামূলক রচনাসহ দেশ, সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক নিবন্ধাবলি ছফাকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী লেখকের মর্যাদাপূর্ণ আসন দিয়েছে। এতকিছু সত্ত্বেও আরাম-আয়েশের জীবন তাকে কখনোই টানতে পারেনি।
খুব সাধারণ আর চাকচিক্যহীনভাবে দিন কাটাতেন ছফা। দীর্ঘকাল যাবত তিনি একটি মাত্র ঘরে থাকতেন যার মধ্যে আসবাব বলতে ছিল শুধু একটি খাট, চেয়ার, টেবিল আর বইয়ের তাক।
বইটির পরিবর্ধিত সংষ্করণের ভুমিকা সংযোজিত হয়েছে পৃষ্ঠা ৫-৪৩ এর মধ্যে যেখানে তিনি তার নতুন পরিবর্তিত ভাবনাগুলো আটটি সেকশনে লিপিবদ্ধ করেছেন ( ১৫ আগষ্ট ১৯৯৭ )। বইটির প্রথম সংষ্করণের ভুমিকা সংযোজিত আছে পৃষ্ঠা ৪৪-৪৮ এর মধ্যে (১৯৭২)। মূল রচনা শুরু হয়েছে পৃষ্ঠা ৪৯ থেকে শেষ হয়েছে ৯৩ পৃষ্ঠায়। বইটি পড়ার পর আপনি লেখকের ২৫ বছর আগের রচনা ও ২৫ বছর পরের ভাবনা পড়ার দুইটির ভিন্নরকম স্বাদ পাবেন।
□ লেখক পরিচিতিঃ
আহমদ ছফা জন্ম ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
মৃত্যু- ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আটাশে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের সাধারণ গোরস্থানে তাঁর দাফন হয়।
আহমদ ছফা (জুন ৩০, ১৯৪৩ - জুলাই ২৮, ২০০১) একজন বাংলাদেশি লেখক, কবি ও সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী তিনি। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নির্মোহ, অকপট দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন।
বাবার হাতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় ছফার। ১৯৬০ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি। যদিও সেখানে খুব বেশি দিন ক্লাস করেননি ছফা। খুব সম্ভবত ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন ছফা। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা আর সম্ভব হয়নি তার।
সৃষ্টিশীল এই লেখক শুরু থেকেই ছিলেন প্রথাবিরোধী। পড়াশোনা চলাকালীন অবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি ন্যাপ বা তৎকালীন জনপ্রিয় গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে আহমদ ছফাকে। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে এবং পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুদিন আত্মগোপন করেন। এরপর ১৯৮৬ সালের দিকে এসে জার্মান ভাষার উপর গ্যেটে ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। গ্যেটের অমর সাহিত্য ‘ফাউস্ট’ অনুবাদের ক্ষেত্রে এটিই ছিল প্রথম সোপান।
ষাটের দশকে সাহিত্য জগতে পা রাখেন আহমদ ছফা। সমসাময়িক উপন্যাস লেখকগণের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। বক্তব্যের স্পষ্টতা আর তীব্রতার জন্য খুব দ্রুত পাঠকদের মাঝে সাড়া ফেলে দেন তিনি। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীনতার পথে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী সব মিলিয়ে ত্রিশটিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা আহমদ ছফা। তার লেখাগুলোর দিকে তাকালে একটি বিষয় নজরে পড়বে। প্রায় প্রতিটি লেখাই সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে।
বেশ কিছু পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক ছিলেন আহমদ ছফা। অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক গণকন্ঠ’ এর সম্পাদকীয় উপদেষ্টা এবং ‘সাপ্তাহিক উত্তরণ’ এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন তিনি। স্পষ্টভাষী ছফা সত্যের প্রচারে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া না গেলেও ধর্মের প্রতি তার বিশ্বাস ছিল প্রশ্নাতীত। ১৯৭০ সালে আহমেদ শরীফের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’, তিনি ছিলেন সংগঠনটির প্রথম সভাপতি। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রগতিশীল লেখকদের আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ব্যক্তিত্বের ছটায় তরুণ প্রজন্মের কাছে খুব সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আহমদ ছফা। তবে কখনোই সস্তা খ্যাতির মুখাপেক্ষী ছিলেন না তিনি। ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদ হিসেবে আলাদা কদর ছিল তার। কাব্যিক ভঙ্গিমায় স্থানীয় ভাষায় ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। গ্যোতের লেখার পাশাপাশি বার্ট্রান্ড রাসেলের অ্যাগনোস্টিক বা ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি অবস্থা নিয়ে বেশ কিছু লেখাও অনুবাদ করেন তিনি। তবে প্রাবন্ধিক হিসেবেই আহমদ ছফার পরিচিতি সবচেয়ে বেশি।
সাহিত্য সম্পাদনা-
তিনি সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনী মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহ- বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), ফাউস্ট - অনুবাদ (১৯৮৬), যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮)
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার- একুশে পদক (২০০২)
বই নিয়ে অন্য রিভিউ সমূহঃ
যদ্যপি আমার গুরু - আহমদ ছফা
প্রজাপ্রতি - সমরেশ বসু
মহাজীবন এক্সপ্রেস - নাদিম মজিদ
ছবি ও তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০২০ দুপুর ১:০৯