প্লাটফর্মে গিজগিজ করছে মানুষ। হাটতে গেলে মানুষের গায়ের সাথে গা লেগে যাচ্ছে। অফিস শেষে বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা ও উৎকন্ঠা সবার চোখেমুখে। কোলাহল, ধাক্কাধাক্কি এড়িয়ে প্লাটফর্মের একপ্রান্তে এসে দাড়ালাম। বসার মতো সম্ভাব্য সকল জায়গা দখল হয়েছে অনেক আগেই। আমি দাড়িয়ে আছি। । কারণ ঢাকা ফেরার নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনটি এক ঘন্টা লেট।
আকাশে শেষ বিকেলের আলো এখনও মিলিয়ে যায়নি। ভ্যাপসা গরম পড়েছে। অনেকগুলো ফড়িং চক্রাকারে এলোমেলো অবিরাম উড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে..।
প্লাটফর্মের সবাই সবার মতো করে ব্যস্ত। আপাতত দাড়িয়ে-দাড়িয়ে মানুষের ব্যস্ততা দেখা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই... ।
প্রায় কোমর থেকে দুই পা নেই এরকম একজন ভিক্ষুক কাঠ দিয়ে তৈরি বিয়ারিং এর গাড়িতে চড়ে অপেক্ষমান মানুষের নিকট ভিক্ষা প্রার্থনা করছে। একজন স্থুলকায় বোরকাপড়া মধ্যবয়স্ক মহিলা পাঁচ টাকা ভিক্ষা দিল। বিয়ারিং এর গাড়িতে চড়া ভিক্ষুকটি পানচিবানো দাত বের করে হাসল। তারপর দুই হাতে পেছনে ধাক্কা দিয়ে তাকে বহনকারী বিয়ারিং গাড়িটির স্পিড বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
ভিক্ষুকটি সামনে এগিয়ে যাওয়ার সময় একজন লোকের ওপর দৃষ্টি আটকে গেল। লোকটি প্লাট ফর্মের একপাশে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। মাথা ভর্তি ময়লা জট পাকানো লম্বা চুল। মুখ ভর্তি লম্বা কুচকুচে কালো দাড়ি। পরনে একটা কালো প্যান্ট। প্যান্টটির ডান পায়ের অনেকখানি অংশের সেলাই খুলে গিয়েছে। এই গরমের মধ্যেও গায়ে একটা মোটা সোয়েটার । সমস্ত শরীরে ময়লার আন্তরন। কতদিন গোসল করেনা কে জানে! দেখে মনে হয় লোকটি পাগল। ডান হাত দিয়ে প্লাট ফর্মে পড়ে থাকা একটা সিগারেটের মোথা তুলে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে প্লাটফর্মের মেঝেতে ঘষছে। ঘষছে আর একটু পর পর মুচকি হাসছে। মনে হচ্ছে খুব আনন্দের কোন কাজ করছে।
পাগলটি যেখানে বসে আছে, তার সামন্য একটু দূরে প্লাটফর্মের ডান পাশে অব্যবহৃত খালি জায়গায় চারজন টোকাই ছেলে হাওয়া ছাড়া একটি ফুটবল নিয়ে খেলছে। সে কী আনন্দময় খেলা। একজন হাওয়া ছাড়া ফুটবলে কিক করছে আর অন্যজন হেসে সেই ছেলের গায়ের ওপড় লুটিয়ে পড়ছে। যেন পৃথিবীতে এর থেকে আনন্দময় খেলা আর নেই।
টোকাই ছেলেদের খেলার জায়গা থেকে একটু দূরে তাকালে দেখা যায় রেললাইনের ব্যবহৃত কিছু পুরনো কাঠের স্লিপার সারি করে সাজানো। তার সামনে ময়লার স্তুপ। চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো। দেখলেই ওয়াক উঠে আসে।
আমি মুখ ফেরালাম। যেখানে দাড়িয়ে আছি তার ঠিক উল্টো দিকে রেলরাইনের ঐ পাড়ের প্লাটফর্মে জামাকাপড়ের ব্যাগের উপর বসে আছে একজন মধ্যবয়স্ক লোক। তারপাশে একজন হিন্দু মহিলা । মনে হয় তার স্ত্রী। অন্যপাশে লুঙ্গি পড়া লিকলিকে গড়নের একজন তরুন ছেলে। সে বার বার অস্থির চোখে রেললাইনের দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয় ট্রেনের জন্য অপেক্ষা আর সহ্য হচ্ছে না। বয়স্ক লোকটি অসুস্থ। শ্বাস নেওয়ার সময় পাজড় বেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দম বেড়িয়ে আর ফিরবে না। হাপানি রোগের সমস্যা আছে হয়তো।
হঠাৎ মাইকে ঘোষনা এলো- ময়মনসিংহগামী কমিউটার ট্রেনের খবর হয়েছে। যারা শ্রীপুর, কাউরাইদ, গফরগাও, ... ময়মনসিংহ যাবেন....ইত্যাদি.ইত্যাদি...
কমিউটার ট্রেনের খবর শুনে কিছু মানুষের ব্যস্ততা বেড়ে গেল। হিন্দু মহিলা ও লিকলিকে গড়নের তরুন ছেলেটি হাপানি রোগীকে নিয়ে ট্রেনে ওঠার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে গেল...।
আকাশে এখন আলোর স্বল্পতা । ছোপ-ছোপ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ হলো। বৃষ্টি মাখানো এক পশলা ঠান্ডা বাতাস আমাকে স্পর্শ করে এগিয়ে গেল। দেখতে দেখতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
আমি দৌড়ে প্লাটফর্মের যেদিকটাই ছাউনি আছে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। বৃষ্টির আক্রমন থেকে বাচার জন্য আমার মতো অপেক্ষমান আরও অনেক যাত্রী সবাই ছুটে এলো। আমি প্লাটফর্মের মাঝামাঝি একটি জায়গায় এসে কোনরকমে দাড়ালাম। আমার চারপাশে গায়ে গা ঘেষে দাড়ানো অসংখ্য মানুষ।
যেখানে দাড়ালাম তার ঠিক সামনে প্রসব আসন্ন একজন মেয়ে প্লাটফর্মের সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বেঞ্চের উপর বসে আছে। তার সাথে একজন বয়স্ক মহিলা। পাশে বেশ কয়েকটি ব্যাগ। মহিলাকে আড়াল করে দাড়িয়ে একজন যুবক। চেহারায় জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের ছাপ। প্রকৃত বয়সের থেকেও বয়স বেশি মনে হচ্ছে। অন্থিরতা ও দু:শ্চিন্তা চোখেমুখে। মনে হয় মেয়েটিকে ডাক্তারের কাছে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ঢাকা যাওয়ার ট্রেনের কোন খবর নেই।
প্রসব আসন্ন মেয়েটিকে দেখে খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটির চোখে মুখে লজ্জা, কষ্ট ও অসহায়ত্বের ছাপ। মেয়েটি এতক্ষন চোখ বন্ধ করে ছিলে। হঠাৎ ককিয়ে উঠল। ছেলেটি মাথা নিচু করে কি যেন জিজ্ঞেস করল। সাথে সাথে ছেলেটি অস্থির হয়ে উঠল। ছেলেটি কি মনে করে যেন আমাকে ডাকলো। আমি ছেলেটির কাছে গেলাম। ছেলেটি বলল তার বউয়ের প্রসব বেদনা উঠেছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। ছেলেটি দৌড়ে আশে-পাশের কয়েকজন মহিলাকে ডাকলো। মহিলারা এসে মেয়েটিকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখলো। কে একজন বলল তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। কাছেই একটি প্রাইভেট ক্লিনিক আছে। মহিলাদের মধ্যে কে একজন বললো ডাক্তারের কাছে নেওয়ার মতো সময় নেই। তাড়াতাড়ি প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাটফর্মের সকল মানুষের দৃষ্টি এখন প্রসব আসন্ন মেয়েটির দিকে।
আমি প্লাটফর্মের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দৌড়ে গেলাম। প্লাটফর্মে অবস্থানরত কয়েকজন ভাসমান মহিলাকে অনুরোধ করে নিয়ে এলাম। ভাসমান মহিলাদের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা বলল তার প্রসব করানোর অভিজ্ঞতা আছে। এসে দেখি প্রসব আসন্ন মেয়েটিকে এরই মধ্যে কাপড় দিয়ে গোল করে কয়েকজন মহিলা ঢেকে রেখেছে। সেই বৃত্তের মাঝখান থেকে আরও কয়েকজন মহিলার কন্ঠ ভেসে আসছে। একজন তরুন ছেলে কোথথেকে একটি বালতি জোগাড় করে এক বালতি নিয়ে এসেছে।
প্লাটফর্মের বাইরে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিছুক্ষন পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এরইমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। প্লাটফর্মের ল্যাম্পপোস্টের আলো এই পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। একজন লোক দৌড়ে এসে বললো এই যে মোমবাতি ও ম্যাচ নিয়ে এসেছি।
মেয়েটির প্রসব বেদনার কষ্টের শব্দকে ম্লান করে দিচ্ছে বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ। মেয়েটির স্বামী দৌড়ে এসে বলল এই যে ওষধপত্র নিয়ে এসেছি। একজন মহিলা হাত থেকে ওষধপত্রের প্যাকেটটি নিয়ে মহিলাদের তৈরি কাপড় বৃত্তের মধ্যে ঢুকে গেল।
বৃষ্টির ঝাপটা বাড়ছে। সাথে প্রচন্ড বাতাস। ছোট প্লাটফর্মের ছাউনিতে কাজ হচ্ছে না। আমরা অপেক্ষমান ট্রেন যাত্রীরা ভিজে যাচ্ছি। মশা কামড়াচ্ছে। বাতাসের সাথে দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। সিগারেটের ধোওয়া । কোলাহল ইত্যাদি। আর সহ্য হচ্ছে না। আমার মতো অন্য সবাইও কেমন উসখুস করছে। অস্থিরতা ও বিরক্তি নিয়ে ।
সকল কিছুকে বিদির্ন করে হঠাৎ কানে ভেসে আসলো একজন সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্না। প্লাটফর্মে অপেক্ষমান ট্রেনযাত্রীদের সকলের আগ্রহ এখন শিশুর কান্নার দিকে। এইমাত্র যে শিশুটি জন্মনিল তার জন্মটি যেন আর দশটি শিশুর জন্মের মতো না। সবার আলোচনার বিষয় এখন ঐ শিশু।
বৃষ্টি কমে এসেছে। আমি ছাউনি ছেড়ে একটু নিড়িবিলি জায়গায় এসে দাড়ালাম। শীতল এক পশলা বাতাস আমার শরীর জুড়িয়ে দিয়ে গেল। আমি একটি সিগারেট ধরালাম।
এরই মধ্যে মাইকে ঘোষনা এলো -“ঢাকাগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের খবর হয়েছে। আপনারা যারা নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে এয়ারপোর্ট ও কমলাপুর যাবেন, তাদেরকে কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে দুই নম্বর প্লাটফর্মে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।”
লাইনে দাড়িয়ে টিকেট কাটলাম। অবশেষে ট্রেন আসলো। বৃষ্টি ভেজা শরীর নিয়ে যুদ্ধ করে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন ছাড়লো। আমি এক গুচ্ছ জীবন্ত গল্প মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম।
-০-
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৯ রাত ৮:৫৮