somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : উকুন বাছা রাত কিম্বা সর্ষেফুল দিনের গল্প

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.

আমরা এখন বৈদ্যুতিক আলোয় উকুন বাছি । বিদ্যুৎ আমাদের ফাঁকি দেয়, যেমন আমাদের ভাগ্য প্রায়শই আমাদের ফাঁকি দিতে থাকে । বিদ্যুতের ফাঁকিবাজিকে ফাঁকিবাজ ভাগ্যের মতনই আমরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চাই । কারণ, ভাগ্য বদলের কথা যদি বলি, যদি বলি ভাগ্যকে ধরবার জন্যই আমরা গ্রাম ছেড়ে নগরে এসেছি, তবে এ কথা বলা সঙ্গত হবে যে, রামপুর বস্তির দুর্গন্ধময় গলি-ঘুপচিতে আমাদের অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করবার আগ মুহূর্তগুলোতে রায়পুর গ্রামের সবুজের পরতে পরতে আমরা আমাদের সারল্যকে লুকিয়ে রেখে এসেছি । আমরা যথেষ্ট নির্লিপ্ত, খানিকটা নিষ্ঠুর আর আত্মপরায়ণ হতে শিখেছি ।

২.

রায়পুর গ্রামে আমরা তখন কুপির আলোতে উকুন বাছতাম । তাই, নাগরিক বিদ্যুতের গরহাজিরা আমাদের বিচলিত করতে অক্ষম । বড়জোর খিস্তি সহযোগে আমরা মোমবাতিতে আগুন দেই, উকুন বাছাতে মনযোগ দেই ফের । বস্তির ফাঁক - ফোকর গলে টুকরা -টাকরা জোছনা কখনও আমাদের অন্ধকারে হানা দিলে জোছনা খন্ড গায়ে মেখে আমরা বসে থাকি । ফিসফাস কথা বলি,- 'বাবা লোকটা কিরম, মা ?' পরীবানুর এহেন অকস্মাৎ প্রশ্নে তখন হয়তো আমাদের মাঝে অযাচিত একটা নীরবতা ভর করে । তখন, বাবার দু'টি চোখ, দু'টি কান, হাত-পা, একটি নাক এবং মুখমন্ডল রয়েছে.. এরকম ভাবনা স্কুলে পড়া রচনার মতো আমার ভেতরে জড়ো হতে থাকে । তখন নীরবতা আমাদের চারপাশে ক্রমশ ঘুরপাক খেতে খেতে একটা নিরবিচ্ছিন্ন জাল তৈরীতে সক্ষম হয় । সেই জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসবার তাগিদে মা হয়তো তখন কয়টি 'ডাঁশা' মারা পড়লো, সশব্দে সেই হিসাব কষতে থাকেন এবং হৃদয়ের খুব গহিন থেকে অজান্তে একটা শ্বাস ত্যাগ করেন । সেটা প্রচলিত ধারার প্রথাসিদ্ধ দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠলো কিনা, তা বুঝে উঠবার আগেই মায়ের হৃদয় পোড়া গন্ধ আমাদের নাক ঠিক ঠিক চিনে নেয় ! তখন পরীবানু, যে আমার এক বছরের ছোট, পরীর মতন না হলেও পরীর কাছাকাছি সুন্দর বলে গার্মেন্টসে যাবার পথে যাকে অহরহই নানারকম যৌন উৎপীড়ক মন্তব্য হজম করতে হয়, সে বলে, - 'বাবার কোন ছবি তোমার কাছে নাই, মা ?' মায়ের কঠিন দৃষ্টি পরীবানুতে যেতে যেতে শীতল হয় । ভালোবাসা মোড়ানো মায়ের হাত, হাতের আঙ্গুল পরীবানুর চুলে বিলি কেটে দেয় । আহ্লাদি কন্ঠে মা বলেন, - 'আয়নায় নিজেরে দ্যাখোস না ?' পরীবানু মায়ের মুখে চেয়ে থাকে । বুঝবার চেষ্টা করে,- 'দ্যাখিতো !'
-বাপের মতনইতো হইছস দ্যাখতে তুই !
- বাবার ঠিকানাটা দ্যাওনা !
- ক্যান , কি করবি তুই ?
- বাবার লগে দেখা করুম !
- দেখা কইরা কি অয়বো ?
-কিচ্ছু না, দ্যাখতে মন চায় !
- হের কোন ঠিকানা আমার কাছে নাই !
- আছে, আমি জানি, দ্যাওনা !
-চোপ ! আর কোনসম আমার সামনে হের কথা কইবি না !

তখন আমাদের মাতা-কন্যার সমাবেশে ক্ষণিকের জন্য হলেও পিন পতন নিস্তব্দতা নামে । সভাস্থল থেকে দ্রুত মা নিঃস্ক্রান্ত হলে কিঞ্চিত ছন্দপতন হয় ! তখন বস্তির মাতাল মঈজ তার ভান্ডারে থাকা বাংলা ভাষার যাবতীয় মন্দ শব্দ সমেত মুক্ত হস্তে এলোপাথারি কিল -ঘুষি অকৃপণভাবে তার প্রথম স্ত্রীতে বিলায় ! চার সন্তানের জননী তখন মাটিতে গড়াগড়ি খায় । তার সন্তানদের কান্নার রোল, চিৎকার , বস্তির দুর্গন্ধ বাতাসে মিশে যেতে থাকলে, বজলু মামার দোকানের সামনে ছেড়া পাউরুটি, ভাঙ্গা বিস্কিট খাওয়া , দু'পা সামনে ছড়িয়ে নতজানু ভঙ্গিতে বসে থাকা বাঘা নামের হাড্ডিসার কুকুরটিও তখন কুঁ...উঁ...কুঁ...উ.. চিৎকারে তাদের কান্নায় সুর মিলায় । বোবা প্রাণীটি শোকাহত মনুষ্য সন্তানদের সঙ্গে এভাবেই শোক প্রকাশে একাত্ম হয় হয়তো । তখন মাতাল মঈজের সদ্য বিবাহীত ছোট বউ হাত ভরতি কাঁচের চুরিতে রিনঝিন রিনঝিন শব্দ তুলে, দু'হাত কোমড়ে রেখে বড় বউয়ের মার খাবার দৃশ্য অবলোকন এবং উপভোগ করে আর বজলু মামার পাশের দোকান 'ঝিলিক অডিও ভিশন' থেকে তখন চড়া সুরে একটা গান মূর্হমূর্হ আমাদের কানে বাজতে থাকে- 'এই বেশ ভালো আছি... এই বেশ ভালো আছি... !'


৩.

রায়পুর গ্রামে ঝিলের জলে আমরা শাপলা তুলতাম । কচুরিপানার নিরাপদ আশ্রমে চুপটি মেরে থাকা ছোট চিংড়িদের ঘাপটি মেরে তালুবদ্ধ করতাম । শাপলা-চিংড়ি রেসিপি আমাদের বিদ্যুৎ চালীত টিভি
চ্যানেলগুলোতে 'সুস্বাস্থ্যবতী রন্ধন কর্ত্রীরা' দর্শকদের জন্য পরিবেশন না করলেও, শাপলা চিংড়ির মোলায়েম স্বাদ চৌধুরী বাড়ি থেকে পাওয়া, প্রথমবার খাওয়া সন্দেশের মতো বহু বছর আমাদের মুখের ভেতর থেকে যায় । অথবা সবুজ কলমিলতা আর কচু শাকের ঘ্রান শহুরে ধনীদের সুগন্ধ বিরানীও আমাদের ভোলাতে ব্যর্থ হয় !


রায়পুর গ্রামে আমরা তখন বেদে -বেদিনীদের সাপের খেলা দেখতাম । নাগ-নাগিনী ছবির সুরের মতন বেদে দলের বংশী বাদন শুনতাম ! আমার তখন বেদিনী সাজে, বেদে দলের যে ছেলেটি চোরা চোখে বারবার আমাকে দেখতো, তার সঙ্গী হয়ে যাবার সাধ জাগতো ! যদিও , রায়পুরের হলুদ সর্ষফুলের গায়ে হলুদ প্রজাপতিদের ছেড়ে যাবার বাসনা সহজ ছিলো না । তখন যখন তীব্র ক্ষুদায় কখনও আমাদের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠতো, সর্ষেফুলগুলোকে হঠাৎই নৃত্যশিল্পি বনে যেতে দেখতাম ! আমাদের ক্ষুদার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দলবদ্ধ সর্ষেফুলেরা চোখের সামনে দলীয় নাচন নাচতো !

তখন, চৌধুরীদের দখিন ভিটায় দু'চালা ছনের ছাউনিতে আমাদের ফরমাশ খাটা দিনগুলো এভাবেই অম্লমধুর কাটতো । চৌধুরী বাড়িতে দিনভর বুয়ার কাজ করতেন মা । দিনশেষে চৌধুরাণী যে খাবার দিতেন, তাতে আমাদের তিনটি প্রাণীর আধপেটা রাত মন্দ যেতো না ! চৌধুরী সাহেব লোক ভালো ছিলেন । স্কুলের সভাপতির পদবলে আমাকে তিনি নিখরচায় দশ ক্লাশ পর্যন্ত পড়বার সুযোগ করে দিয়েছিলেন ।

সেই সময় এক সন্ধ্যায়, রায়পুর গ্রাম তার বুক থেকে আমাদের ত্যাগ করবে মনস্থির করলো ! সেই সন্ধ্যায় চৌধুরীদের সুপারী বাগানে, চৌধুরীদের ছোট ছেলে, আমাদের পরীর কাছাকাছি সুন্দর পরীবানুর পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলো । পরীবানুর দু'বাহু খামচে ধরে, পরীবানুর ঠোঁটে সে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়েছিলো ! সেই সন্ধ্যায় ঠিক সেই মুহূর্তেই ভাগ্যক্রমে মা সেখানে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন ! সে মধ্যরাতের শেষ নিস্তব্দতায়, আমাদের একমাত্র আশ্রয় চৌধুরীদের দু'চালা ছনের ঘর ছেড়ে বাধ্য হয়েই আমাদের রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলো !

৪.

রামপুর বস্তিতে আমাদের অন্ধকার ঝুপরির সমুখ ভাগে টলায়মান একটি মনুষ্য অবয়ব এসে দাঁড়াতে দেখা যায় ! খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ির চোয়ালভাঙ্গা মুখটির সঙ্গে পরীবানুর চেহারার সাদৃশ্য আমাদের অভিভূত করবার আগেই , হুড়মুড় করে লোকটিকে মাটিতে ভেঙ্গে পড়তে দেখি । আমাদের বিস্ময়াভিভূত তিনজোড়া চোখ তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! পরীবানু ছুটে লোকটির কাছে যায়, মাথা কোলে তুলে নেয়, কপালে হাত রেখে বলে,- 'জ্বর !'

আমার তখন মনে হতে থাকে, বোধকরি একেই বাবা বলে,বা বাবা এরকমই হয় ! পরীবানুর জন্মের পর মাকে আঁতুরঘরে রেখেই যে পালিয়ে গিয়েছিলো !

............................................................................


[বস্ত্রশিল্পিদের গর্বের অনুষ্ঠান,গানের প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান 'গর্ব' চলছে বাংলা ভিশনে । বিচারকদের সামনে একজন তাঁর জীবনের গল্প শুনাচ্ছিলেন , প্রবাসের ব্যস্ততার ফাঁকে এক ঝলক দেখেছি । নামটিও মনে রাখতে পারিনি ! তিনি বলছিলেন,-- "বাবা ! তুমি যেখানেই থাকো, আমাকে দোয়া করো... !"

এই গল্প তার হাতে তুলে দিতে পারলে খুব খুশী হতাম ! এই গল্প তাঁর জন্য, তাঁদের জন্য ]
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৪৬
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×