"যদি আর বাঁশি না বাজে... আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, ভুলে যাবেন..."
ভুলে যেতে বলাটাই কবিকে মনে করিয়ে দেয় বারবার। আমরা ভুলতে পারিনা সাম্যের গান । আমরা ভুলতে পারিনা বৈষম্য বিরোধী গান । আমরা ভুলতে পারিনা কি দারুণ সাহসে কবি বলে গেছেন --
"তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ !"
প্রাণের ভেতরের যে সত্য , যে ধর্ম, তার উপর কোন ধর্ম নেই, নজরুলই আমাদের শিখিয়ে যান । কবি তার প্রথম সন্তানের নাম রাখেন "কৃষ্ণমোহাম্মদ"--ধর্মের উপরে যে মানুষ সত্য, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে সবার আগে আমরা যে মানুষ , তার অসাধারণ উদাহরণ এভাবেই কবি নজরুল (মে ২৫, ১৮৯৯ — আগস্ট ২৯, ১৯৭৬) রেখে যান । আর তাই আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কবি বেঁচে থাকেন ভালোবাসার উষ্ণতায়, আপন উজ্জ্বলতায়, । যে উজ্জ্বলতার জন্য কবির সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকার উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,-
"আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দূর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন
অলক্ষণের এই তিলকরেখা , রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন !"
উল্লেখ্য, ১৯২২ সালের শারদীয় সংখ্যা ধূমকেতুর দুটি কবিতার জন্য কবিকে ১ বছর কারাবরণ করতে হয় । কবিতা দুটো যথাক্রমে 'আনন্দময়ীর আগমন এবং বিদ্রোহীর কৈফিয়ত' (খন্ড-ত হীনতায় ভুগছি)!
এই ধারাবাহিক প্রিয় কবিতার সিরিজে ইতোমধ্যে নজরুলের 'মানুষ' এবং 'সাম্যবাদী' কবিতা দু'টো যুক্ত হয়েছে । আজ "আমার কৈফিয়ত" কবিতাটি যুক্ত করলাম । যে কবিতা পাঠে কবিমানস আমদের চোখে আরো বেশী স্পষ্ট হবে বলে বিশ্বাস ।
আমার কৈফিয়ত
কাজী নজরুল ইসলাম
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্-পেশী,
দু’কানে চশ্মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী!
কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?
বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাত জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!
আমি বলি, ওরে কথা শোন্ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্ খোশ্-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্, এবার এ দাঁও ফস্কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।
বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১ (পুর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-- ২ (যদি নির্বাসন দাও--সুনীল)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৩ (কেউ কথা রাখেনি ---সুনীল)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৪ (অন্ধকার--জীবনানন্দ দাশ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৫ (হায় চিল--জীবনানন্দ দাশ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৬ (গোলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশোর- আবুল হাসান)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৭ (মায়ের সুখ--ফজলুল বারী বাবু)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৮ ( নারী--সুনীল )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৯ ( তোমার চোখ এতো লাল কেন--নির্মলেন্দু গুণ )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১০ ( ছিন্নমুকুল--সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১১ ( শুদ্ধ করো আমার জীবন --মহাদেব সাহা)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১২ ( বদলে যাও, কিছুটা বদলাও--আবুল হাসান)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৩ ( আমি কিংবদন্তির কথা বলছি --আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৪ ( চিঠি দিও---মহাদেব সাহা )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৫ (নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়--হেলাল হাফিজ )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৬ (ফেরীঅলা --হেলাল হাফিজ )
ভালো
লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৭ (মানুষ -কাজী নজরুল ইসলাম )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৮ (ছাড়পত্র --সুকান্ত ভট্টাচার্য )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ১৯ ( সত্যবদ্ধ অভিমান --সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২০ ( আসাদের শার্ট--শামসুর রাহমান)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২১ (ওটা কিছু নয়--নির্মলেন্দু গুণ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২২ ( মানুষ--নির্মলেন্দু গুণ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২৩ ( বাতাসে লাশের গন্ধ --রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২৪ ( সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয় --জীবনানন্দ দাশ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২৫ ( আসমানী প্রেম--নির্মলেন্দু গুণ)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২৬ (উচ্চারণগুলি শোকের--আবুল হাসান)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২৭ (আগুনে পুড়বে ভস্ম এবং শৃঙ্ক্ষল--আবুল হাসান)
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ২৮ (পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতা । কথোপকথন ৩৯)
জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকীতে কবিকে স্মরণ । ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-২৯ (সাম্যবাদী--কাজী নজরুল ইসলাম )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৩০ (খেলাঘর--নির্মলেন্দু গুণ)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৩১ (উল্টোরথ--নির্মলেন্দু গুণ)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৩২ (কোথায় গেল, কোথায়--সুনীল)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা- ৩৩ (লোকটা জানলই না--সুভাষ মুখোপাধ্যায়)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৩৪ (দোতলার ল্যন্ডিং,মুখোমুখি দু'জন--আহসান হাবীব)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৩৫ (আমি কোনো আগন্তুক নই --আহসান হাবীব)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৩৬ ( যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো -শক্তি চট্টোপাধ্যায়)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৩৭ ( চতুর্দশপদী কবিতাবলী -শক্তি চট্টোপাধ্যায়)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৩৮ ( এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি--আবিদ আজাদ)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৩৯ (উটপাখি--সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪০ (মুখোশ--বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪১ ( যে শহরে আমি নেই আমি থাকবো না--আবিদ আজাদ )]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪২ ( বৃষ্টি ভেজা বাংলা ভাষা--জয় গোস্বামী )]
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৩ ( রিক্সাওয়ালা--অরুণ মিত্র )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৪ ( আপনি বলুন, মার্কস --মল্লিকা সেনগুপ্ত )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৫ ( দিন আনি, দিন খাই --তারাপদ রায় )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৬ ( চাবি --শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৭ ( আমার হবেনা, আমি বুঝে গেছি --আবুল হাসান )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৮ ( অদ্ভুত আঁধার এক-- জীবনানন্দ দাশ )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৪৯ ( একবার তুমি -শক্তি চট্টোপাধ্যায় )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৫০ (যা চেয়েছি, যা পাবো না --সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় )
ভালো লাগা প্রিয় কবিতারা-৫১ ( আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো-মহাদেব সাহা )
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১০ বিকাল ৩:৫১